হারিয়ে যাননি সাদেক বাচ্চু

গুণী অভিনয়শিল্পী সাদেক বাচ্চু এখন অভিনয়ে অনিয়মিত। ছবি: সংগৃহীত
গুণী অভিনয়শিল্পী সাদেক বাচ্চু এখন অভিনয়ে অনিয়মিত। ছবি: সংগৃহীত

গুণী অভিনয়শিল্পী সাদেক বাচ্চু এখন অভিনয়ে অনিয়মিত। একটা সময় চুটিয়ে কাজ করেছেন। মঞ্চে, বেতারে, টিভিতে, সিনেমায়, সর্বত্র দাপুটে বিচরণ ছিল তাঁর। পাঁচ দশকের লম্বা ক্যারিয়ার তাঁর। তবে নব্বই দশকে এহতেশামের ‘চাঁদনী’ ছবিতে অভিনয়ের পর জনপ্রিয়তা পান খলনায়ক হিসেবে। এই পরিচয়েই দেশজুড়ে খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে সাদেক বাচ্চুর।

ভিলেন ছাড়াও নানামুখী চরিত্রে বলিষ্ঠ অভিনয় করেছেন। অভিনয়ের স্বীকৃতিস্বরূপ একটু দেরিতেই পেয়েছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। ২০১৮ সালে ‘একটি সিনেমার গল্প’–এর জন্য পুরস্কার পান। পুরস্কার সম্প্রতি পেলেও এখন আর আগের মতো তাঁকে পর্দায় ঘন ঘন দেখা যায় না। তিনি কি অভিনয় থেকে ছুটি নেওয়ার কথা ভাবছেন?

সাদেক বাচ্চুর মুখোমুখি হলে তিনি বলেন, ‘অভিনয়শিল্পীর কোনো অবসর নেই। এ দেশ পৃথিবীর একমাত্র দেশ, যেখানে মনে করা হয় অভিনয়শিল্পী সিনিয়র হয়েছেন মানে তাঁকে আর প্রয়োজন নেই। কীভাবে তাকে বিতাড়িত করা যায়, সেটা ভাবতে সবাই উঠেপড়ে লাগেন। ও সিনিয়র হয়ে গেছে? তবে ওকে বাদ দিয়ে দাও।’

সাদেক বাচ্চু জানান, তিনি ইচ্ছে করে অভিনয় কমিয়ে দেননি। ‘যে চরিত্রে আমাদের মানায়, তেমন চরিত্র আমাদের কাছে আসে না। গল্পে আমাদের রাখা হয় না। পরিচালকেরা আমাদের কাছে আসেন না। গল্প আমাদের পছন্দ হয় না। ব্যাটে–বলে মেলে না।’ এসব কারণে সাদেক বাচ্চুর অভিনীত কাজের সংখ্যা এখন কম।

সাদের বাচ্চু আক্ষেপ করেন, ‘যুগের পরিবর্তনের সঙ্গে পৃথিবীর সব দেশ তাল মিলিয়ে নেয়। পুরোনো মানুষকে নতুন প্রজন্মের মানুষেরা ছাড়ে না। পুরোনোরা পুরোনো অভিজ্ঞতা দিয়ে নতুনদের সমৃদ্ধ করে। নতুনেরা তাদের আধুনিকতা দিয়ে পুরোনোদের বরণ করে নেয়। এই যে দেওয়া–নেওয়া, এই যে দুই দলের সংমিশ্রণ, বাংলাদেশ একমাত্র দেশ, যেখানে এসব মানা হয় না।’

সাদেক বাচ্চু প্রশ্ন করেন, ‘সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় আজও অভিনয় করেন কীভাবে? রামেন্দু মজুমদারের মতো আর্টিস্টর কাজ কম। ফেরদৌস মজুমদারের মতো এত গুণী শিল্পীরও তুলনামূলক কাজ কম। আবুল হায়াতের কম। একটা কেয়া চৌধুরী, একটা মামুনুর রশীদ, একটা রাইসুল ইসলাম আসাদ আর খুঁজলেও পাওয়া যাবে? এতবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পাওয়া শিল্পী!’

‘আমাদের জন্য কোন চরিত্র তৈরি হয় না। আমাদের কাছ থেকে শিখে নতুনেরা সমৃদ্ধ হতো। নতুনদের কাছে শিখে আমরা আধুনিক হতাম। কিন্তু এই মেলবন্ধনটা এখন নেই। আজকে সিনেমা হল বন্ধ হয়ে যাচ্ছে সব। কারও রিমোট বাংলাদেশি চ্যানেলের ওপর থাকে না।’ এসব দেখে ক্ষুব্ধ সাদেক বাচ্চু।

পুরোনো দিনের সঙ্গে বর্তমান সময়ের তুলনা করে সাদেক বাচ্চু বলেন, ‘আমি অভিনয় করি, আমাকে বলতে হয়, এই মঙ্গলবার একটা নাটক যাবে, দেখো। এর চেয়ে লজ্জার আর কিছু আছে? অথচ এমনও দিন গেছে, টেলিভিশনে একটা নাটক করে আমরা ছয় মাস রাস্তায় হাঁটতে পারিনি।’ বিশ্বাস করুন, রেডিওর নাটকে করেছি। রাস্তায় বেরোলে লোকে বলত, বাচ্চু ভাই, গত রোববার রেডিওতে আপনার অভিনয় যা ভালো লেগেছে!’

রেডিও, টেলিভিশনে যাওয়ার আগে মঞ্চে ওঠেন সাদেক বাচ্চু। ছবি: সংগৃহীত
রেডিও, টেলিভিশনে যাওয়ার আগে মঞ্চে ওঠেন সাদেক বাচ্চু। ছবি: সংগৃহীত

রেডিও, টেলিভিশনে যাওয়ার আগে মঞ্চে ওঠেন সাদেক বাচ্চু। শিশুকাল থেকে মঞ্চের সঙ্গে তাঁর বন্ধন। মতিঝিল থিয়েটার তাঁর নাট্যদল। দলের সভাপতি তিনি। এখনো নাটক রচনা করেন, নির্দেশনা দেন। গত বইমেলায়ও নাটক মঞ্চস্থ করেছেন।

মহিলা সমিতিতে এক নাটকে তাঁর অভিনয় দেখেন তখনকার প্রভাবশালী টিভি প্রযোজক আব্দুল্লাহ ইউসুফ ইমাম। তিনি সাদেক বাচ্চুকে নিয়ে যান টিভিতে। তিনি অভিনয় করেন ‘প্রথম অঙ্গীকার’ নাটকে। চুয়াত্তর সালের ঘটনা এটি। তাঁর অভিনীত নাটকের সংখ্যা হাজারের ওপর। প্রথম অভিনীত ছবি শহীদুল আমিন পরিচালিত ‘রামের সুমতি’।

‘সাদেক বাচ্চু’ নামটি তিনি পান এহতেশামের কাছ থেকে। তাঁর আসল নাম মাহবুব আহমেদ। ‘চাঁদনী’ ছবি থেকে তাঁর নাম বদলে যায়। বদলে যায় তাঁর খ্যাতির ধরনও। সাদেক বাচ্চু অভিনীত ছবির সংখ্যা পাঁচ শতাধিক। শেষ শুটিং করেছেন ‘বিদ্রোহী’ ছবির। এখনকার ছবির ধরন-ধারণ নিয়ে তাঁর আপত্তি আছে।

সাদেক বাচ্চু বলেন, ‘এখনকার বিখ্যাত একজন অভিনেতার একটা সিনেমার একটা গানের কথা বলুন? বলতে পারবেন না। কারণটা কী? কারণ হচ্ছে, তখন গানের শব্দচয়ন গল্পের সঙ্গে মিলিয়ে লেখা হতো। তারপর সুরারোপ করা হতো। সেই অনুযায়ী গাওয়া হতো, লিপসিং হতো। একটা মালা গাঁথা হতো। আর এখন কী হচ্ছে?’

‘এখন কথা নেই বার্তা নেই শুধু শুধু একটা লোক ঘুষি মারছে, চারজন আকাশে উড়ে যাচ্ছে, দুজন চিত হয়ে মাটিতে পড়ে থাকছে। এভাবে কোনো মারামারি হয় নাকি পৃথিবীতে? আগে একটা ফাইটের দৃশ্য এলেও প্রয়োজনে আসত। নারায়ণ ঘোষ মিতা ‘লাঠিয়াল’ নির্মাণ করেছেন। আনোয়ার হোসেন সাহেব শ্রেষ্ঠ অভিনেতা হয়েছেন। অভিনেতাকে পুরস্কৃত করা হয়েছে, নায়ককে নয়।’

একটি নাটকের দৃশ্যে সাদেক বাচ্চু। ছবি: সংগৃহীত
একটি নাটকের দৃশ্যে সাদেক বাচ্চু। ছবি: সংগৃহীত

অবসরেও সাদেক বাচ্চু পুরোনো দিনের ছবি দেখেন। বই পড়ে সময় কাটান। ২০১৩ সালে তিনি বাংলাদেশ ডাকঘরের চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন। ১৯৭০ সালে মাত্র ১৫ বছর বয়সে চাকরিতে ঢোকেন। তাঁর বাবা ছিলেন ডাকঘরের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। তাঁর মৃত্যুর পর সাদেক বাচ্চুকে চাকরি দেওয়া হয়। পাঁচ বোন, তিন ভাই, বিধবা দাদি, বিধবা মাকে নিয়ে ছিল তাঁর বিশাল সংসার। সেই সংসারের দায়িত্ব তাঁকে বহন করতে হয়।

সংসারের সব দায়িত্ব শেষ করে সাদেক বাচ্চু বিয়ে করেন। তাঁর বড় মেয়ে উচ্চমাধ্যমিকে পড়ে। ছোট মেয়ে এসএসসি দেবে। একমাত্র ছেলে ক্লাস সিক্সে পড়ে। স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে পারিবারিকভাবে সুখী সাদেক বাচ্চু। তবে জীবনের লম্বা সময় চাকরি, অভিনয়, সংসার নিয়ে সংগ্রামে কেটেছে তাঁর।

চাকরি করেও এত নাটক, ছবিতে কীভাবে কাজ করা সম্ভব হলো? সাদেক বাচ্চু জানান, একসময় তাঁর অফিস ছুটি হতো দুইটায়। ডে-শিফট ধরতেন দুইটার পর। নাইট শিফটে তাঁর অফিস নেই। শুক্র, শনি দুদিন অফিস বন্ধ। পরিচালকরা তাঁকে সহযোগিতা করতেন। ছাড় দিতেন অভিনয়শিল্পীরাও। সবার সহায়তায় এত কাজ করা সম্ভব হয়েছে।

সাদেক বাচ্চু খেয়াল করেছেন, করোনাকালেও প্রতিদিন টিভিতে তাঁর কোনো না কোনো ছবি প্রচার হয়। কোনো কোনো দিন একাধিক ছবিও প্রচার হয়। তাঁর কাছে জানতে চাওয়া হলো করোনা নিয়ে তাঁর ভাবনার কথা। ‘মানসিকভাবে বিপর্যস্ত আছি। উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে জায়গা করে নিচ্ছি আমরা। এ সময় বিশ্বায়নের যে আঘাতটা এল, তার বাইরে আমরা থাকতে পারলাম না।’

সাদেক বাচ্চু বলেন, ‘আমাদের আরও সচেতন হওয়া উচিত। আমরা কোনো নিয়মকানুন মানছি না। অল্প কয়েকটা নিয়ম। এগুলো মানলে আমি ভালো থাকব, আমি ভালো থাকলে আমার পরিবার ভালো থাকবে, সমাজ ভালো থাকবে, দেশ ভালো থাকবে। আমরা কেউ এদিকে নজরই দিচ্ছি না। এই একটা ব্যাপারে উদ্বিগ্ন হয়ে আছি।’