যেখানে করোনাও তাঁদের থামাতে পারেনি

সমসাময়িক দুই অভিনেত্রী দিলারা জামান ও শর্মিলী আহমেদের সঙ্গে ভালো সখ্য পরের প্রজন্মের তারকাদেরও। ছবি: সংগৃহীত
সমসাময়িক দুই অভিনেত্রী দিলারা জামান ও শর্মিলী আহমেদের সঙ্গে ভালো সখ্য পরের প্রজন্মের তারকাদেরও। ছবি: সংগৃহীত

সম্পর্কের বয়স প্রায় ৪০ বছর। পরিচয়ের পর থেকেই দিলারা জামান ও শর্মিলী আহমেদের মধ্যে বন্ধুত্ব বাড়তেই থাকে। পরে যা রূপ নেয় পারিবারিক ঘনিষ্ঠতায়। সেই থেকেই তাঁদের মধ্যে ফলমূল, পছন্দের খাবার, এটা-সেটার লেনদেন শুরু হয়। শুধু বন্ধুত্বের খাতিরেই ৭ বছর ধরে তাঁরা পাশাপাশি এলাকায় থাকা শুরু করেন। তখন থেকেই দুই পরিবারের মধ্যে শুরু হয় নিয়মিত রান্না করা খাবারের লেনদেন। করোনার সব অভ্যাস বদলে গেলেও বদলায়নি তাঁদের নিত্যদিনের এই অভ্যাস।


অভিনেত্রী দিলারা জামান বলেন, ‘১৯৮৩ সালের দিকে শর্মিলীর মায়ের সঙ্গে বিটিভিতে পরিচয়। সেই থেকেই তিনি আমাকে খুবই পছন্দ করতেন। প্রায়ই দেখা হতো। তখন তিনি তাঁর সন্তানদের বলে দেন সে তোমাদের আরেকটা বোন। তারপর থেকে একটু একটু করে বাড়তে থাকা আমাদের সম্পর্ক এখন পরিবারে রূপ নিয়েছে। ও ( শর্মিলী আহমেদ) আগে দূরে ছিল। এখন আমরা উত্তরাতেই পাশাপাশি থাকি। করোনায় দেখা করতে পারি না। প্রতিদিন কথা হয়। বাসায় ভর্তা করলে শর্মিলী আমাকে না দিয়ে খায় না। আমিও তাকে না দিয়ে খেতে পারি না। আমরা আগেকার দিনের মানুষ তো। কিছু রান্না করলেই মনে হয় ওকে দিই।’

দিলারা জামান ও শর্মিলী আহমেদের বন্ধুত্ব ৪০ বছরের বেশি। ছবি: প্রথম আলো
দিলারা জামান ও শর্মিলী আহমেদের বন্ধুত্ব ৪০ বছরের বেশি। ছবি: প্রথম আলো

অভিনেত্রী শর্মিলী আহমেদের অবশ্য মনে নেই ঠিক কোন দিন পরিচয় তাঁদের। তবে এটা জানেন, ৪০ বছরের কম না। তিনি বলেন, ‘সেই কত আগে থেকে দিলারা জামানকে চিনি। তারপর থেকে আমাদের ভালোবাসা বেড়েই চলেছে। পরিচয়ের পর থেকে আমরা বন্ধুর মতো। দিলারা জামান আমার বন্ধু, বোন দুটোই। এখনো নিয়মিত আমাদের কথা হয়। আমি ফোন করতে দেরি করলে আপা ফোন দেয়। এখন আমরা পাশাপাশি থাকি। আমার বাসায় ভর্তা, ভাজি, মাছ যা–ই রান্না করি, আগে দিলারা আপার বাসায় পাঠাই। আমার মেয়েরাও কিছু রান্না করলে আগে বলবে খালাকে পাঠিয়ে দাও। আবার ওনার দুই মেয়ে কানাডা ও আমেরিকা থাকে। তারা দেশে এলে সব সময় কিছু রান্না করলেই পাঠিয়ে দিত।’

সাত বছর ধরে তাঁরা উত্তরায় থাকেন। সেই থেকেই শুরু হয় তাঁদের মধ্যে খাবার লেনদেন। বিশ্বের সব নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটলেও করোনার এই দুর্যোগ থামাতে পারেনি তাঁদের খাবার লেনদেন। বাইরের কোনো কিছু স্পর্শ না করলেও এই দুই প্রবীণ গুণী অভিনেত্রী প্রায়ই অপেক্ষা করেন কে কী খাবার বাসা থেকে পাঠাবেন। তারপর খাবেন, ফোনে কথা বলবেন। কড়া নিরাপত্তার মধ্যে দিয়েই বাসার গাড়ির ড্রাইভারের মাধ্যমে রান্না করা তরকারি চলে যায় দুই বাসায়। খাবারের গায়ে থাকে তিন স্তরের পলিথিন, নিরাপত্তার নিশ্চিত করতে। গেল তিন মাস বাইরের কিছু স্পর্শ না করলেও তাঁরা দুই পরিবারের পাঠানো খাবার অনায়াসে খান। তবে সবই সারেন সাবধানতা অবলম্বন করে, সব নিয়মকানুন মেনে।

শর্মিলী আহমেদ বলেন, ‘আমরা যখন রামপুরা থাকতাম তখন আমাদের বাসায় ডুমুরের গাছ ছিল, চালতাগাছ ছিল, পেঁপে, আপা এসব পছন্দ করতেন। আমি সব আপার বাসায় ব্যাগ ভরে পৌঁছে দিতাম। আগে থেকেই আমাদের দেওয়া–নেওয়া। আগে তো খাবার পাঠাতে ভয় লাগত না। এখন খুব সতর্কে খাবার পাঠাতে হয়।’

দিলারা জামান। ছবি সংগৃহীত।
দিলারা জামান। ছবি সংগৃহীত।

আগে শুটিংয়ে দেখা হতো। না হলেও প্রায়ই যাওয়া–আসা ছিল বাসায়। দেশের বাইরে কোথাও ঘুরতে গেলেও তাঁদের যাওয়া হয় একসঙ্গে। সেই প্রসঙ্গে শর্মিলী আহমেদ বলেন, ‘আমরা কোথাও গেলে আপাকে নিয়ে যাই। আমার পরিবারের সবাই আপাকে ভালোবাসে। বাসার ছোটদের সঙ্গেও তার খাতির আছে। আমি তো আপার চেয়ে বয়সে একটু ছোট। আপা আমার চেয়ে বড় হয়েও এখনো আমার চেয়ে আপার অনেক শক্তি। ঘুরতে গেলে আমি হাঁটতেই পারি না। আপা দেখি অনেক দূরে চলে গেছে। আপা সবকিছুতেই চির তরুণ। অথচ আপা সব সময় শুধু বলে, আমি বুড়ো হয়ে যাচ্ছি। আমি নিষেধ করে দিয়েছি, আপা, তুমি নিজেকে বুড়ো বলবে না।’ অভিমান মিশ্রিত ভালোবাসা থেকে কথাগুলো বলেন এই অভিনেত্রী।

ইতিমধ্যে শুটিং শুরু হলেও এই দুই অভিনেত্রী আরও মাসখানেক করোনা পরিস্থিতি দেখতে চান। অবস্থা বুঝে তবেই শুটিং করবেন তাঁরা। দিলারা জামান বলেন, ‘আমার ৪০ বছর ধরে ডায়াবেটিস। মাসে মাসে বিভিন্ন টেস্ট করতে হয়। শরীরটা এখন ভালো যাচ্ছে না। বাসায় একা থাকি। সবার জন্য খুবই চিন্তা হয়। এই অবস্থায় শুটিং করে কী হয়, এ জন্য ভয় লাগে। সবাই ফোন দিয়ে নিষেধ করে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমার বাসার তিন পাশে বিল্ডিং, বাইরেও তাকাতে পারি না। সবাইকে দেখার জন্য মনটা খারাপ হয়ে থাকে। আবুল হায়াত, এনামুল, দিপা খন্দকার, উর্মিলা কতজনের নাম বলব, সবাই মা এটা করবা না, ওটা ধরবা না, সচেতন থাকবা বলে অস্থির হয়ে যায়। দুই মেয়ে, আমার মিডিয়ার সব ছেলেমেয়েরা নিয়মিত ফোন দিয়ে খবর নেয়, সাহস দেয় তখন একটু ভালো লাগে।’

শর্মিলী আহমেদ। ছবি সংগৃহীত।
শর্মিলী আহমেদ। ছবি সংগৃহীত।

শর্মিলী আহমেদ বলেন, ‘আপার জন্য আমার খুব চিন্তা হয়। আমার পরিবারে অনেকেই আছে। তাদের সঙ্গে কথা বলে সময় কাটে। কিন্তু আপা একা থাকে। আপাকে আমার বাসায় আসতে বলি, আপা আসে না। আমি বলে দিয়েছি যখন মন খারাপ হবে আমাকে ফোন দিতে।’ কথা শেষে ৭৩ বছরে পা দেওয়া এই অভিনেত্রী বলেন, ‘অনেকেই ভাবে মিডিয়ার মানুষদের মাঝে ভালো সম্পর্ক থাকে না। তারা শেষ বয়সে একা থাকে। আমাদের ক্ষেত্রে সেটা ভুল। আমাদের সবার সঙ্গে যোগাযোগ আছে। আমাদের কোনো বিভেদ, রাগারাগি, হিংসা, মনোমালিন্য নেই। আবুল হায়াত, ডলি জহুর, রোজী, সেলিম, আফসানা মিমি, মনিরা মিঠু, রিচি, নওশীন, তিশা, শবনম ফারিয়া, সকাল আহমেদ আরও অনেকে ফোন দিয়ে খবর নেয়। আমাদের গভীর সম্পর্ক। সবাই আমাদের ভালোবাসে এটাই শান্তি। তা ছাড়া করোনায় আমাদের কী হয়, সেটা নিয়ে সবাই চিন্তায় আছে। বয়স হয়ে গেছে, আমাদের যা–ই হোক, মিডিয়ার এই পরিবারটা যেন ভালো থাকে। সবাইকে বলবেন বৃদ্ধদের ভালোভাবে বেঁচে থাকার জন্য দোয়া করতে।’