যত্নে বানানো নাটক, সংরক্ষণে অযত্ন

‘সংশপ্তক’ নাটকের একটি দৃশ্য। ছবি: সংগৃহীত
‘সংশপ্তক’ নাটকের একটি দৃশ্য। ছবি: সংগৃহীত

বিপুল জনপ্রিয় ‘সংশপ্তক’ নাটকটি পুনঃপ্রচার করছে বিটিভি। যে নাটকের হুরমতি বুয়া ও কানকাটা রমজান বিখ্যাত হয়েছিলেন গত শতকের আশির দশকে। রমজান চরিত্রের হুমায়ুন ফরীদি প্রয়াত হয়েছেন। কিংবদন্তিতুল্য ফেরদৌসী মজুমদার ঘরে বসে এখন উপভোগ করছেন সেই নাটক আর স্মৃতিতাড়িত হচ্ছেন।

নিজের অভিনয় করা নাটকটি আগে দেখার সুযোগ হয়নি অভিনেত্রী ফেরদৌসী মজুমদারের। ঘরে আটকে রেখে মহামারি সেই সুযোগ করে দিয়েছে। নিরবচ্ছিন্নভাবে নাটকটি দেখার সুযোগ পাচ্ছেন তিনি। ভীষণ আনন্দও পাচ্ছেন তিনি। পাশাপাশি জানিয়েছেন এক অনুযোগের কথাও। তিনি বলেন, ‘কত যত্নে আবদুল্লাহ আল মামুন এই নাটক বানিয়েছেন। কিন্তু নাটকটি যত্ন করে সংরক্ষণ করা হয়নি। এ নাটক আরও যত্ন করে সংরক্ষণ করার প্রয়োজন ছিল।’

১৯৮৭ সালের ‘সংশপ্তক’ নাটকের শুটিংয়ের স্মৃতিচারণা করলেন ফেরদৌসী মজুমদার। সময়টা এখনকার মতো ছিল না। যখন যে পর্বের শুটিং হতো, আগেই সেটার মহড়া করা হতো। পরিচালক আবদুল্লাহ আল মামুন নিজে বসে সবাইকে নিয়ে মহড়া করাতেন। মহড়ার পাশাপাশি আনন্দ করতেন সবাই মিলে। ফেরদৌসী বলেন, ‘আমি, ফরীদি, সুবর্ণাসহ সবাই খুব সিরিয়াসলি মহড়া করতাম। তবে আনন্দও হতো অনেক। যেখানে ফরীদি থাকবে, সেখানে আনন্দ হবে না, তা হয় না।’

ফেরদৌসী মজুমদার। ছবি: মাসুম আলী
ফেরদৌসী মজুমদার। ছবি: মাসুম আলী

নাটকটির উল্লেখযোগ্য একটি স্মৃতির কথা জানতে চাইলে ফেরদৌসী বলেন, ‘মনে পড়ে কপালে পয়সার ছ্যাঁক দেওয়ার দৃশ্যটা। পয়সা গরম করে আমার কপালে ছ্যাঁক দেয় লিয়াকত আলী লাকী। দৃশ্যটার জন্য যথেষ্ট সময় নেওয়া হয়েছিল। দুটো জায়গায় দুটো পয়সা রাখা ছিল। একটা গরম হচ্ছিল, একটা হচ্ছিল না। পরিচালক বারবার নেমে এসে বলে দিচ্ছিলেন, “লাকী ভুলে গরমটা লাগিয়ে দিও না, তাহলে কিন্তু সর্বনাশ হবে।” আমাকে বলছিলেন, “আপনার ভয় করছে না তো।” আমাদের প্রত্যেকেরই প্রত্যেকের প্রতি বিশ্বাস ছিল। লাকী কি ভুল করেও আমার কপালে গরম পয়সার ছ্যাঁক দেবে? আমার চিন্তা ছিল অভিনয়টা নিয়ে।’

কী ঘটেছিল তারপর? নাটকটি যাঁরা দেখেছেন, তাঁদের মনে আছে। গগনবিদারী চিৎকার করে উঠেছিলেন ফেরদৌসী মজুমদার। আঁতকে উঠেছিলেন পরিচালক। লিয়াকত আলী লাকী ভুল করে গরম পয়সাটিই চেপে ধরেছিলেন ফেরদৌসী মজুমদারের কপালে? ফেরদৌসী বললেন, ‘আমি এমন জোরে চিৎকার দিলাম যে কেউ বিশ্বাসই করতে পারেনি যে আমার কপালে ঠান্ডা পয়সা চেপে ধরা হয়েছিল।’

ফেরদৌসী মজুমদার। ছবি: মাসুম আলী
ফেরদৌসী মজুমদার। ছবি: মাসুম আলী

ওই নাটকের পর হুরমতি বুয়া হিসেবে পরিচিতি হয়ে গেল ফেরদৌসী মজুমদারের। মগবাজারে বাসা ছিল তাঁর। বাজার করতে বের হলে মাছওয়ালারা ডাকতেন হুরমতি বুয়া নামে, ফলওয়ালারাও ডাকতেন হুরমতি বুয়া নামে। আবার নাটকের আরেকটি দৃশ্য মানুষের মনে দাগ কেটেছিল। সেটা ছিল হুমায়ুন ফরীদির কান কাটার দৃশ্য। ফেরদৌসী বলেন, ‘ফরীদি সেই দৃশ্যটি এত চমৎকার অভিনয় করেছিল যে বলে বোঝানো যাবে না। ওই দৃশ্যে আমার ঘরে এসে সে আমাকে ভোগ করার জন্য ফুসলাতে শুরু করে। সে একটু একটু করে আমার দিকে এগিয়ে বসে, আর আমি একটু একটু করে তার থেকে সরে বসি। হঠাৎ করে পকেট থেকে একটা রুমাল বের করে সে কপাল মুছতে শুরু করে। সে সব সময় আমাদের শুটিং সেট মাতিয়ে রাখত। আমার সঙ্গে একটু বেশি দুষ্টুমি করত। এ জন্য সে বকুনিও খেত। আবদুল্লাহ আল-মামুন মৃদুস্বরে বলতেন, “আপনারা সিরিয়াস না। মহড়ার সময় হাসাহাসি করছেন!” আমার একটা ভয়াবহ রোগ ছিল, একবার হাসতে শুরু করলে আর থামতাম না। আমিও ভয়ে থাকতাম, এই বুঝি ফরীদি আমাকে হাসিয়ে দেয়। পরিচালক আমাদের দুজনকে দূরে দূরে বসিয়ে দিতেন।’

প্রতি রাতে বিটিভির বাংলা সংবাদের পর দেখানো হয় ‘সংশপ্তক’ নাটকটি। এতে আরও অভিনয় করেছিলেন রাইসুল ইসলাম আসাদ, মুজিবুর রহমান দিলু, মামুনুর রশীদ, সুবর্ণা মুস্তাফা প্রমুখ। শহীদুল্লা কায়সারের উপন্যাস অবলম্বনে নাট্যরূপ দিয়েছেন ইমদাদুল হক মিলন। পরিচালনা করেন আবদুল্লাহ আল মামুন, আল মনসুর ও মোহাম্মদ আবু তাহের। প্রথমবার ১৯৭০ সালে মামুনুর রশীদের নাট্যরূপে নাটকটি প্রচারিত হয়েছিল তৎকালীন পাকিস্তান টেলিভিশনে। করোনা পরিস্থিতিতে সোনালি দিনের নাটকগুলো পুনঃপ্রচার করছে চ্যানেলটি। ইতিমধ্যে প্রচার শেষ হয়েছে ‘কোথাও কেউ নেই’, ‘বহুব্রীহি’, ‘এইসব দিনরাত্রি’সহ আরও বেশ কিছু নাটক।