প্রিয় লাল রঙের পাঞ্জাবি গায়ে শায়িত এন্ড্রু কিশোর

ঘড়িতে সকাল ১০টা বেজে ৫ মিনিট। বুধবার, ১৫ জুলাই। রাজশাহী সিটি চার্চে শেষ বিদায়ের আনুষ্ঠানিকতা শেষে ভক্তরা ফুল দিয়ে প্লেব্যাক সম্রাট এন্ড্রু কিশোরকে শেষ শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন। মাইকে বাজছে তাঁর সব অমর গান। চারদিকে মানুষের কথাবার্তায় গমগমে পরিবেশ। এরই মধ্যে সিরাজগঞ্জ থেকে এক ভক্ত ছুটে এলেন। নাম খোকন শেখ। বয়স প্রায় ২৫। এই ভিড়ের ভেতরে দাঁড়িয়ে গাইতে শুরু করলেন...আমার ইচ্ছে করে বুকের ভেতরে লুকিয়ে রাখি তারে... গলা ছেড়ে গাওয়া ভক্ত খোকন শেখের এই গান যেন সব কোলাহল ছাপিয়ে গেল। উপস্থিত অনেকেই চোখের পানি ধরে রাখতে পারলেন না। গান শেষে খোকন শেখ নিজেও কাঁদতে শুরু করলেন। কাঁদতে কাঁদতে বললেন, ইচ্ছা ছিল এন্ড্রু কিশোরের কাছ থেকে গান শিখবেন। তাঁর সেই স্বপ্ন পূরণ হলো না।

এন্ড্রু কিশোর। ছবি: সংগৃহীত
এন্ড্রু কিশোর। ছবি: সংগৃহীত

রাজশাহী সিটি চার্চে সকাল ১০টা থেকে বেলা ১১টা পর্যন্ত ভক্ত-অনুরাগীরা ফুল দিয়ে তাঁকে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। তাঁদের দেওয়া ফুলে ফুলে ঢেকে যায় এন্ড্রু কিশোরের কফিন। কফিনের ভেতর লাল পাঞ্জাবিটাই ছিল শেষ পোশাক। জানা গেছে, এই পাঞ্জাবিটা তাঁর খুব প্রিয় ছিল।

শেষ শ্রদ্ধায় পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমের পক্ষ থেকে, রাজশাহী জেলা প্রশাসন, রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয় ও রাজশাহী জেলা শিল্পকলা একাডেমির পক্ষ থেকে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। সরাসরি শ্রদ্ধা জানাতে সেখানে এসেছিলেন রাজশাহী সদর আসনের সাংসদ ফজলে হোসেন বাদশা। তিনি বললেন, প্লেব্যাক সিঙ্গার হিসেবে সীমান্তের এপার ও ওপারের উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে উঠেছিলেন এন্ড্রু কিশোর। তিনি জাতীয় অনেক পুরস্কার পেয়েছেন কিন্তু রাষ্ট্রীয় কোনো পুরস্কার পাননি। প্রয়াত এই শিল্পীকে একটি রাষ্ট্রীয় পুরস্কার দেওয়ার জন্য তিনি সরকারকে আহ্বান জানান। তিনি বলেন, রাজশাহীতে তাঁরা এন্ড্রু কিশোরের নামে একটি সংগীত বিদ্যালয় করতে চান। এটির অনুমোদন দেওয়ার জন্য শিক্ষামন্ত্রীকে আহ্বান জানান। সরাসরি উপস্থিত হয়েছিলেন রাজশাহী মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ডাবলু সরকার, জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামানসহ অনেকেই।

রাজশাহী সিটি চার্চে শেষ বিদায়ের আনুষ্ঠানিকতা। ছবি: প্রথম আলো
রাজশাহী সিটি চার্চে শেষ বিদায়ের আনুষ্ঠানিকতা। ছবি: প্রথম আলো

এন্ড্রু কিশোরের ওস্তাদের নামে গড়া সংগঠন ‘আব্দুল আজিজ বাচ্চু স্মৃতি সংসদ’-এর সাধারণ সম্পাদক মঈনুল ইসলাম জানালেন, আজ বুধবার সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় সংগঠনের পক্ষ থেকে নগরের অলকার মোড়ে সামাজিক দূরত্ব মেনে মোমবাতি প্রজ্বালন করে এন্ড্রু কিশোরের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করা হবে। দেশে এবং দেশের বাইরে ভক্তরা যে যেখানে থাকবেন, সেখান থেকেই একটি মোমবাতি জ্বালিয়ে তাঁদের কর্মসূচির সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করার জন্য তিনি আহ্বান জানান।

বেলা ১১টায় সিটি চার্চ থেকে শিল্পীর কফিন রাজশাহী নগরের শ্রীরামপুর এলাকায় অবস্থিত চার্চ অব বাংলাদেশের ক্রিশ্চিয়ান কবরস্থানে নিয়ে আসা হয়। বেলা সাড়ে ১১টায় তাঁকে সমাহিত করা হয়। কবরস্থানের একেবারে সম্মুখভাগে তাঁর কবর করা হয়েছে। এই কবরস্থানেই রয়েছে তাঁর বাবা ক্ষিতীশ বাড়ৈ ও মা মিন বাড়ৈয়ের কবর।

রাজশাহী সিটি চার্চে শেষ বিদায়ের আনুষ্ঠানিকতা। ছবি: প্রথম আলো
রাজশাহী সিটি চার্চে শেষ বিদায়ের আনুষ্ঠানিকতা। ছবি: প্রথম আলো

শিল্পীর শেষ শেষকৃত্যানুষ্ঠানে ঢাকা থেকে এসেছিলেন সংগীত পরিচালক ইথুন বাবু। তিনি বললেন, তাঁর শেষ গানে এন্ড্রু কিশোর কণ্ঠ দিতে গিয়ে অসুস্থ বোধ করছিলেন। এ জন্য বলেছিলেন পরে একদিন এসে কণ্ঠ দেবেন। সেই গানে আর কণ্ঠ দেওয়া হলো না। গানের কথা ছিল, ‘একটি ঘরের ঠিকানা পেয়েছি আমি, শুনেছি এ ঘরের চেয়ে অনেকখানি দামি, ও ঘরে থাকতে হবে একা একা জানি।’ শেষ পর্যন্ত একা একা থাকার ঠিকানায় চলে গেলেন আমাদের প্লেব্যাক সম্রাট এন্ড্রু কিশোর।

৬ জুলাই রাজশাহী নগরের মহিষবাথান এলাকায় অবস্থিত এন্ড্রু কিশোরের বোন শিখা বিশ্বাসের বাসায় এন্ড্রু কিশোর শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন। তার পর থেকে তাঁকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে হিমঘরে রাখা হয়েছিল। তাঁর সন্তানেরা ফিরে এলে তাঁর শেষকৃত্যানুষ্ঠান করার কথা ছিল। অস্ট্রেলিয়া থেকে ছেলে ও মেয়ে এসেছেন। তারপর সেই আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করা হলো। সিঙ্গাপুর থেকে ফেরার পর গত ২০ জুন এন্ড্রু কিশোর ঢাকা থেকে রাজশাহীতে আসেন।