সাইবার বুলিং: তারকাদের হয়রানির শেষ কোথায়

এই ধরনের অপরাধের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা না করলে সামনে আরও কঠিন সময় অপেক্ষা করছে বলেও মনে করছেন তারকারা। ছবি: সংগৃহীত
এই ধরনের অপরাধের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা না করলে সামনে আরও কঠিন সময় অপেক্ষা করছে বলেও মনে করছেন তারকারা। ছবি: সংগৃহীত

জনপ্রিয় অভিনেতা জিয়াউল ফারুক অপূর্বর সাবেক স্ত্রী নাজিয়া হাসান। কিছুদিন আগেই তাঁরা বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নেন। নাজিয়াকে জড়িয়ে বেশ কিছু অনলাইন পোর্টাল ও ইউটিউব চ্যানেল কয়েক দিন ধরে মিথ্যা ও বানোয়াট খবর প্রচার করে আসছে। ফেসবুকে সেসব খবরকে কেন্দ্র করে চলেছে কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য। একমাত্র সন্তানের মায়ের সঙ্গে এসব আপত্তিকর আচরণ ও ঔদ্ধত্যপূর্ণ মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে অপূর্ব থানায় অভিযোগ করেছেন। 

কদিন আগে মোস্তফা সরয়ার ফারুকী ও নুসরাত ইমরোজ তিশার দাম্পত্য জীবনের ১০ বছর পার করার খবরে ফেসবুকে অনেকে কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করেছেন। দেশবরেণ্য শিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যার করোনা আক্রান্তের খবরেও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে জড়ো হয়েছে আজেবাজে মন্তব্য। বিষয়গুলো দিন দিন প্রকট আকার ধারণ করছে বলে মত বেশির ভাগ তারকার। এখনই এই ধরনের অপরাধের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা না করলে সামনে আরও কঠিন সময় অপেক্ষা করছে বলেও মনে করছেন তাঁরা।

তারকাদের ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, টুইটারসহ ইউটিউবেও তাঁদের নিয়ে বহু কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য চোখে পড়ে, যা শিল্পীর মানসিক অবস্থাকে বিপর্যস্ত করে। বাংলাদেশে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোর ভেতর ফেসবুক সবচেয়ে জনপ্রিয়। তাই বাংলাদেশের তারকারা সবচেয়ে বেশি নিগৃহীত হন ফেসবুকে। অনেকে কেবল বুলিংয়ের শিকার হয়ে কাজের আগ্রহও হারান। বাংলাদেশ ও ভারতের জনপ্রিয় অভিনেত্রী জয়া আহসানের মতে, কাজের আগ্রহ হারানোটা খুবই স্বাভাবিক। তিনি বলেন, ‘আজেবাজে মন্তব্যের কোনো সীমা নেই। তারা পরিবার, মা-বাবা এমনকি জন্ম নিয়ে পর্যন্ত কথা বলে। কিছুই বাদ রাখে না। যেভাবে আক্রমণাত্মক মন্তব্য করা হয়, তাতে হীনম্মন্যতা তৈরি হয়। আমার মতো শক্ত মানসিকতার মানুষ তো সবাই না।’ 

সাইবার বুলিংয়ের বিষয়টা এতটাই প্রকট আকার ধারণ করে যে তারকারা অনেকে ভাবেন, এমন পেশায় এসে যেন মস্ত বড় অপরাধ করেছেন তাঁরা। কেউ কেউ বলছেন, যদি দৃষ্টান্তমূলক কিছু শাস্তির ব্যবস্থা করা যেত, তাহলে অবশ্যই এটা দমন করা সম্ভব। সাইবার বুলিংকে ক্যানসারের সঙ্গে তুলনা করেছেন নাটক ও বিজ্ঞাপনচিত্র নির্মাতা অমিতাভ রেজা চৌধুরী। তিনি বলেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এমন মন্তব্যের মধ্য দিয়ে একটা জাতির রুচির বহিঃপ্রকাশ পায়। একটা জাতির মধ্যে যদি অসম্ভব রকম বৈষম্য, নিপীড়ন আর সংস্কৃতিচর্চার চরম বন্ধ্যাত্ব থাকে, তখন এই পরিস্থিতি তৈরি হয়। ফেসবুকে যারা এই কথাগুলো বলে, তারা বেশির ভাগই দেশেরে বাইরে থাকে। দেশের সঙ্গে যাদের একমাত্র সংযোগ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। বা ফেক আইডির আড়ালে থাকে।

আপত্তিকর আচরণ ও ঔদ্ধত্যপূর্ণ মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে অপূর্ব থানায় অভিযোগ করেছেন। ছবি: প্রথম আলো
আপত্তিকর আচরণ ও ঔদ্ধত্যপূর্ণ মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে অপূর্ব থানায় অভিযোগ করেছেন। ছবি: প্রথম আলো

অমিতাভ মনে করেন, ইন্টারনেট আর স্মার্টফোনের কারণে আমরা সবাই খুবই শক্তিশালী। যা খুশি তাই মন্তব্য করতে পারি। একজন তারকাকে নিয়ে মুখে যা আসে তা বলতে পারি। আর তারকা যদি নারী হন, তাহলে তো কথাই নেই। ইন্টারনেট ব্যবহার করে আমাদের এই যে শক্তি, এটা কোনো আইন করে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব না। এই ধরনের অবক্ষয় সাংস্কৃতিক বিকাশের সঙ্গে সম্পর্কিত। অমিতাভ বলেন, ‘যেখানে সরকারের বিরুদ্ধে কেউ কথা বললে, রাতারাতি পৃথিবীর যেখানে থাকুক কিংবা বাংলাদেশের যে জায়গায় থাকুক না—আইনের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়। সেই ধরনের দৃষ্টান্ত অন্য কোনো ক্ষেত্রে দেখতে পাই না। আমাদের অনেক শিক্ষিত মানুষেরাও অভিনেত্রীদের ওপর বিদগ্ধ আক্রমণ করছি। সেখানে সাধারণ মানুষেরা তো বলবেই, এটাই স্বাভাবিক।’

তারকাদেরও পরিবার আছে। তাঁদেরও মা-বাবা, ভাইবোন, স্বামী সমাজ নিয়ে চলতে হয়। আজেবাজে মন্তব্যের কারণে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন তাঁরা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক তারকা বলেন, ‘আমরাও তো পরিবার নিয়ে থাকি, তাই না? সবারই ধৈর্যের একটা বাঁধ থাকে, এমন কার্যক্রম দেখলে মানসিকতা ঠিক রাখতে পারি না।’

জয়া আহসান জানালেন, তাঁর ধারণা, বুলিং তাঁর সঙ্গে অনেক বেশি হয়। যা তাঁর ফেসবুক পোস্টের মন্তব্যের ঘরে গেলে বোঝা যায়। জয়া বলেন, তিনি যে কী পরিমাণ বুলিংয়ের শিকার হয়েছেন, তা তাঁর যেকোনো পোস্টের মন্তব্যের ঘরে গেলেই টের পাওয়া যাবে। বলেন, ‘আমি তো দুই দেশেই কাজ করি। কিন্তু বাংলাদেশে যে পরিমাণ বুলিংয়ের শিকার হই, তা ভয়াবহ। এখন আর এসব গায়ে মাখাই না। তবে যখন ভারতের অনুসারীরা আমাদের দেশের মানুষকে উদ্দেশ করে বলেন, তোমরা তো তোমাদের দেশের নারীদেরই সম্মান দিতে জানো না, তোমাদের দেশের পুরুষদের মানসিকতা কেমন, মন্তব্য দেখলে বোঝা যায়, এসব দেখে খুব কষ্ট পাই।’ জয়া আরও বলেন, ‘সাইবার বুলিং যে শুধু অশিক্ষিতেরা করছে তা কিন্তু নয়। আমাদের দেশে যাদের অনেকে আদর্শ মনে করি, সফল, উচ্চশিক্ষিত, এ রকম মানুষেরাও অনলাইনে আমাকে বুলিং করছে। হাতেনাতে প্রমাণও আছে। আমার প্রতিবেশীও আমাকে, আমার পেশা আর কাজ নিয়ে আজেবাজে মন্তব্য করেছে।’


তারকাদের অনেকে আক্ষেপ করে বলেছেন, সরকারের বিরুদ্ধে কেউ কটূক্তি করলে সাইবার অপরাধ বিভাগ যত দ্রুত ব্যবস্থা নেয়, তারকাদের ক্ষেত্রে তা হয় না। তারকারা মনে করেন, স্বপ্রণোদিত হয়ে ব্যবস্থা নিলে এই ধরনের অপরাধ কমে যায়। বিষয় প্রসঙ্গে পুলিশের সাইবার ক্রাইম বিভাগের ডিসি আ ফ ম আল কিবরিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে বলেন, ‘অভিযোগ পেলে বেশির ভাগ সময় আমরা ব্যবস্থা নিই। কিন্তু কোটি কোটি ফেসবুক আইডি রয়েছে। আর যেসব আইডি থেকে এসব করা হয়, তার বেশির ভাগই ভুয়া। তবে এসব শাস্তিযোগ্য অপরাধ। যে কেউ বুলিংয়ের শিকার হলে থানায় অভিযোগ করবেন। আমরা অবশ্যই ব্যবস্থা নেব।’ সরকার কিংবা সরকারি কারও বিরুদ্ধে বুলিং হলে যত দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া হয়, তারকাদের ক্ষেত্রে তেমনটা হয় না। এমন অভিযোগ পুলিশের এই কর্মকর্তা অস্বীকার করে বলেন, ‘এটা পুরোপুরি স্বীকার করছি না। তারকারা বুলিংয়ে শিকার হলে তাঁরা আইনের আশ্রয় নেবেন। থানায় অবহিত করবেন। আমরা অবশ্যই ব্যবস্থা নেব।’


বাংলাদেশে সাইবার বুলিং আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে গেছে। যেকোনো সুস্থ শিল্পী এমনকি সুস্থ মানুষকে মানসিকভাবে অসুস্থ করে দেওয়ার জন্য এই একটা কারণই যথেষ্ট। শুধু তা–ই নয়, মানসিকভাবে শক্তিশালী না হতে পারলে আত্মহত্যার মতো ঘটনাও ঘটতে পারে বলে জানালেন তারকাদের কেউ। তাঁদের মতে, যারা এসব করছে, তারা ভেবেই নিচ্ছে তারা যা খুশি তাই করতে পারে। আর এসব করার পর তাদের কিছুই হবে না। তাই সবার উচিত এদের বিরুদ্ধে একযোগে প্রতিবাদ করা। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা।