কিশোরের আজ ৯২তম জন্মদিন

অভিনেতা কিশোর কুমার। ছবি: সংগৃহীত
অভিনেতা কিশোর কুমার। ছবি: সংগৃহীত

খোলা মঞ্চে হাজার হাজার দর্শকের দিকে চেয়ে গেয়ে উঠলেন এক কিশোরকণ্ঠী শিল্পী। করতালিতে ফেটে পড়লেন দর্শক। টালিগঞ্জের কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায় পরিচালিত ‘কিশোর কুমার জুনিয়র’ ছবিটায় কিশোরকে যেমনটি দেখানো হয়েছে, কিশোর কুমার কিছুটা সে রকম। তবে ছবিটায় প্রসেনজিতের অভিনয় দেখে কিংবদন্তিতুল্য গায়ক কিশোর কুমারের ব্যাপারে ধারণা তৈরি করা যাবে না। কিশোরের আজ ৯২তম জন্মদিন।

১৯২৯ সালের ৪ আগস্ট কিশোর কুমার জন্ম নেন ভারতের মধ্যপ্রদেশের খান্ডোয়ার এক মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবারে। বাবা কুঞ্জলাল গাঙ্গুলি আইনজীবী, মা গৌরী দেবী গৃহিণী। চার ভাইবোনের মধ্যে কিশোর ছিলেন সবার ছোট। কিশোরের জীবন শুরু হয়েছিল কাভার সিঙ্গার হিসেবে, ‘কিশোর কুমার জুনিয়র’ ছবিটার মতো। যে কারও গান শুনে সেটা কপি করে গাওয়া তাঁর জন্য ছিল ডাল-ভাত। বিশেষ করে সায়গলের গান তাঁর নিজেরও পছন্দের ছিল। ঘটনা ঘটাল সেই কপি করার ক্ষমতা।

বয়স যখন ৯, ছুটি কাটাতে বোম্বে গিয়েছিলেন কিশোর কুমার। বড় ভাই অশোক কুমার তখন বোম্বে টকিজের অন্যতম কর্ণধার, খ্যাতিমান অভিনেতা। একটা অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার সুযোগ এল কিশোরের। ‘অচ্ছুতকন্যা’ ছবির সাফল্যে পার্টি দিয়েছিলেন রায়বাহাদুর চুনিলাল। সেখানে উপস্থিত হওয়ার কথা তৎকালীন রাজ্যপালের। তাঁর দেরি হচ্ছিল বলে অশোক ছোট ভাই কিশোরকে বললেন গান ধরতে। কিশোর গান ধরলেন। ছোট্ট এক বালকের কণ্ঠে কে এল সাইগলের গান শুনে হতবাক হয়ে গেলেন হিমাংশু দত্ত, দেবিকা রানী, শশধর মুখার্জির মতো চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্বরা। এমনকি ‘অচ্ছুতকন্যা’ ছবির সংগীত পরিচালক সরস্বতী দেবীও। বোম্বের সিনেমার প্রথম নারী সংগীত পরিচালক তিনি।

গায়ক কিশোর কুমার। ছবি: সংগৃহীত
গায়ক কিশোর কুমার। ছবি: সংগৃহীত

বোম্বে টকিজের পরের ছবি ‘জন্মভূমি’র গান রেকর্ডিংয়ের সময় সরস্বতী দেবী অশোক কুমারকে বলেছিলেন, ছেলেটিকে একটু রেকর্ডিং রুমে পাঠিয়ো। অশোক রাজি হলেন না। ছোট ভাই সিনেমার সঙ্গে জড়িয়ে যাক, অশোক চাননি সেটা। কিন্তু সরস্বতীর তো তাঁর কণ্ঠ ভালো লেগে গিয়েছিল। ‘জন্মভূমি’ ছবির একটি দলীয় গানে কিশোরকে নিয়েছিলেন তিনি। ব্যস, শুরু হলো কিশোরের সংগীতজীবন, প্লেব্যাক জীবন।

কিশোর কুমারের প্রথম প্লেব্যাক বোম্বে টকিজের ‘জিদ্দি’ ছবিতে। ওই ছবিতে অভিনেতা দেবানন্দ এবং গায়ক কিশোর কুমার দুজনকেই সুযোগ দিয়েছিলেন অশোক কুমার। ‘জিদ্দি’ ছবিতে কিশোর কুমার কণ্ঠ দেন যে গানে, তাতে ঠোঁট মিলিয়েছিলেন দেবানন্দ। ছবির সুরকার ছিলেন খেমচন্দ প্রকাশ। ১৯৪৮ সালের সেই ছবিতে কিশোর গেয়েছিলেন ‘মরণ কি দুয়ায়ে কিউ মাঙ্গু’ গানটি। ছবিটা তেমন চলেনি বটে, কিন্তু গায়ক হিসেবে কিশোর ডাক পেতেন নিয়মিত।

তারপরের ইতিহাস সবারই জানা। ভারতীয় চলচ্চিত্রের সবচেয়ে সফল এবং সর্বশ্রেষ্ঠ প্লেব্যাক গায়ক হিসেবে পরিচিতি পান কিশোর। গেয়েছেন বাংলা, হিন্দি, মারাঠি, অসমীয়া, গুজরাটি, কন্নড়, ভোজপুরি, মালায়ালম, ওড়িয়া এবং উর্দু ভাষায়। বাংলা বহু গান গেয়েছেন তিনি। সেগুলোর মধ্যে ‘আমার মনের এই ময়ূর মহলে’, ‘আমার পূজার ফুল’, ‘এক পলকের একটু দেখা’, ‘এ আমার গুরুদক্ষিণা’, ‘একদিন পাখি উড়ে যাবে যে আকাশে’, ‘এই যে নদী এই তো জীবন হিংসা’, ‘বিবাদ’, ‘লোভ হোক বিদ্বেষ’, ‘হাওয়া মেঘ সরায়ে’, ‘কি আশায় বাঁধি খেলাঘর’, ‘কি উপহার সাজিয়ে দেব’, ‘তোমায় পড়েছে মনে’, ‘নীল নীল আকাশে’, ‘প্রেমের খেলা কে বুঝিতে পারে’, ‘শুনো শুনো গো সবে’ উল্লেখযোগ্য। বিখ্যাত ‘নয়ন সরসী কেন, ভরেছে জলে’ গানটি সুর করেছিলেন তিনি নিজেই।

প্রথম স্ত্রী রুমা গুহঠাকুরতার সঙ্গে কিশোর। ছবি: সংগৃহীত
প্রথম স্ত্রী রুমা গুহঠাকুরতার সঙ্গে কিশোর। ছবি: সংগৃহীত

গানেই শেষ নয়। কিশোর একাধারে ছিলেন গায়ক, গীতিকার, সুরকার, অভিনেতা, চলচ্চিত্র পরিচালক, চিত্রনাট্যকার এবং রেকর্ড প্রযোজক। তাঁর অভিনীত কমেডি ছবিগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘বাপ রে বাপ’ (১৯৫৫), ‘চলতি কা নাম গাড়ি’ (১৯৫৮), ‘হাফ টিকিট’ (১৯৬২), ‘পারোসান’ (১৯৬৮), ‘হাঙ্গামা’ (১৯৭১), ‘পেয়ার দিবানা’ (১৯৭৩), ‘বাড়তি কা নাম দাড়ি’ (১৯৭৪)। এ ছাড়া তিনি অভিনয় করেছেন ‘নোকরি’, ‘বন্দি’, ‘দূর গগণ কি ছাঁও মে’, ‘দূর কা রাহি’ ছবিতে।

কিশোর কুমার অভিনয় করেছিলেন চারটি বাংলা সিনেমায়। তাঁর জীবনে চার নিয়ে একটি মজার মেলবন্ধন রচিত হয়েছে। সেটা কতটা সত্য তা অবশ্য জানা যায়নি। কিশোর কুমার ৪ আগস্ট ৪টায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি মা–বাবার চতুর্থ সন্তান। বিয়ে করেছেন ৪টি এবং মোট ৪টি বাংলা চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। কিশোর কুমারের প্রথম স্ত্রীর নাম রুমা গুহঠাকুরতা, দ্বিতীয় স্ত্রী মধুবালা, তৃতীয় জন যোগিতা বালি এবং চতুর্থ স্ত্রী লীনা চন্দ্র ভরকার। রুমা ছিলেন গায়িকা আর পরের স্ত্রীরা সবাই ছিলেন নায়িকা। ১৯৮৭ সালের ১৩ অক্টোবর প্রয়াত হন কিশোর কুমার।