জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পাওয়া রূপসজ্জাকারী বৃদ্ধাশ্রমে

রূপসজ্জাকারী আবদুর রহমান। ছবি সংগৃহীত
রূপসজ্জাকারী আবদুর রহমান। ছবি সংগৃহীত

প্রায় পাঁচ যুগ ধরে রূপসজ্জাকারী হিসেবে দেশ-বিদেশের অসংখ্য তারকার রূপসজ্জা করেছেন আবদুর রহমান। কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ দুবার পেয়েছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। এ ছাড়া প্রযোজক সমিতিসহ আরও অনেক পুরস্কার আছে তাঁর ঝুলিতে। দেশের চলচ্চিত্র ও নাট্যাঙ্গনের সুপরিচিত এই রূপসজ্জাকারীর এখন দিন কাটছে সাভারের একটি বৃদ্ধাশ্রমে।

‘আমার দেখাশোনা করার মতো কেউ নেই। আমার দুই বোন ছিলেন, তাঁরা মারা গেছেন। কার কাছে যাব? আগে টাকাপয়সা যা-ই আয় করতাম, সেগুলো সবার জন্যই খরচ করতাম। সে জন্য বাড়তি সঞ্চয়ও করিনি যে বাড়িভাড়া নিয়ে থাকব। এখন বৃদ্ধাশ্রমেই থাকি, কিন্তু থাকতে ইচ্ছে করে না।’ সাভারের একটি বৃদ্ধাশ্রম থেকে প্রথম আলোকে কথাগুলো বলেন প্রবীণ এই রূপসজ্জাকারী। তিনি আরও বলেন, ‘সারা জীবন পরিবার, মিডিয়ার মানুষদের সঙ্গে থেকেছি। এখন এভাবে একা থাকতে কষ্ট হয়। নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। আমার রক্তের সঙ্গে মিশে আছে কাজ। আবার সুস্থ হলে কাজ করব। একটা বাসা নিয়ে থাকব বা ভাগনের কাছে চলে যাব’।

প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে পুরস্কার নিচ্ছেন আবদুর রহমান। ছবি সংগৃহীত
প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে পুরস্কার নিচ্ছেন আবদুর রহমান। ছবি সংগৃহীত

গুণী এই রূপসজ্জাকারী এর আগে বাসা ভাড়া নিয়ে কলাবাগান ও কাঁঠালবাগান এলাকায় থাকতেন। কিছুদিন ছিলেন তাঁর এক সহকারীর বাড়িতে। তিনি জানান, জীবনে কখনো ভাবেননি, এভাবে শেষ দিনগুলো একা থাকবেন। টাকাপয়সা যখন আয় করেছেন, সেগুলো দুই হাত উজাড় করে খরচ করেছেন পরিবারের সদস্যদের জন্য। তিনি বিয়ে করেননি। তাই দুই বোন ছাড়া তাঁর আত্মীয় আর কেউ নেই। ৭০-এর দশকে ৩০০ টাকা দিয়ে ভাড়া বাড়িতে একসঙ্গে বাবা-মা আর বোনকে নিয়ে থেকেছেন। তিনি বলেন, ‘তখন কাজ করে প্রচুর টাকা আয় করেছি। জীবনে কল্পনাও করিনি এভাবে সময় আসবে। বাড়ি, গাড়ি, সরকারি চাকরি—সবই করার সুযোগ ছিল আমার। আমি কিছুই করিনি। ফ্রিল্যান্সার হয়ে কাজ করতে ভালো লাগত। লাখ লাখ টাকা আয় করলেও নিজের জন্য কিছু করব—এটা কখনো মনে হয়নি।’ কথাগুলো বলেই থেমে যান তিনি। ওপাশ থেকে দীর্ঘনিশ্বাস শোনা যায়। ফের বলতে থাকেন, ‘হয়তো নিজে বিয়ে করিনি জন্যই এমনটা হয়েছে। নিজের একটা পরিবার ছাড়া যা হয় আরকি। সঞ্চয় থাকলে আমার এমন অবস্থার মধ্যে পড়তে হতো না। ভবিষ্যতে আমার কী হবে, কীভাবে চলব—এগুলো নিয়ে পরামর্শ দেওয়ার মতোও কেউ ছিল না’।

অসুস্থ থাকা অবস্থায় আবদুর রহমান সরকারের কাছ থেকে পাঁচ লাখ টাকা অনুদান পেয়েছেন। সেই টাকা নিজের শেষ জীবনের নিরাপত্তার জন্য ব্যাংকে রেখেছেন। সেখান থেকেই প্রতি মাসে চিকিৎসা এবং নিজের জন্য প্রয়োজনীয় খরচ মেটান। আত্মীয়স্বজন বলতে তাঁর ভাগনে আবদুল হালিম ফোনে খোঁজখবর নেন। তিনি বলেন, ‘কামরাঙ্গীরচরে আমার এক ভাগনে থাকে। করোনা পর তার বাসায় যেতে পারি।’

‘ঘুড্ডি’, ‘মাটির ময়না’, ‘মেঘলা আকাশ’, ‘নাগবউ’সহ প্রায় ২০০ ছবির এই রূপসজ্জাকারী ২০১০ সালে ‘মনের মানুষ’ এবং ২০১৬ সালে ‘নেকাব্বরের মহাপ্রয়াণ’ ছবির জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান। চারবার পেয়েছেন প্রযোজক সমিতির পুরস্কার। যে পুরস্কারগুলো তাঁকে একবুক গর্ব দিয়েছে, সেই প্রিয় পুরস্কারগুলোকে সঙ্গে রাখতে পারেননি। তিনি বলেন, ‘আশ্রমে রাখিনি পুরস্কার। এখানে কীভাবে রাখব? ঢাকায় আমার ভাগনের কাছে রেখেছি। মাঝে খুবই খারাপ লাগে। অ্যাওয়ার্ডগুলো আজ ড্রয়িংরুমে থাকার কথা ছিল। সবই ভাগ্য’।

এর আগে আবদুর রহমানকে দেখভাল করেছেন তাঁর সহকারী রতন সরকার। তিনিও রূপসজ্জাকারী। রতন সরকার বলেন, ‘রহমান সাহেব আমার গুরু। তাঁর কেউ নেই, এ জন্য আরও অনেকের সঙ্গে সিদ্ধান্ত নিয়ে সাভারের একটি আশ্রমে রাখা হয়েছে। তাঁর সব দেখভাল করছি। মাঝেমধ্যেই কথা হয়। করোনা গেলেই হয়তো উস্তাদকে ঢাকার দিকে নিয়ে আসব।’

নাটকের শুটিংয়ের সময় আবদুর রহমান ও অন্যরা। ছবি সংগৃহীত
নাটকের শুটিংয়ের সময় আবদুর রহমান ও অন্যরা। ছবি সংগৃহীত

মাঝেমধ্যেই আবদুর রহমানের খোঁজখবর নেন নির্মাতা, অভিনেতা এবং সহকর্মীরাও। কিছুদিন আগে কথা বলার সময় তিনি জানালেন, কিছুদিন আগে তাঁর খোঁজখবর নিতে ‘ঘুড্ডি’ ছবির অভিনেতা রাইসুল ইসলাম আসাদ ফোন করেছিলেন। এই ‘ঘুড্ডি’ ছবির শুটিং থেকেই নাকি তাঁদের মধ্য সুসম্পর্ক। এ ছাড়া ছোট পর্দার নাটকের সংগঠন অভিনয় শিল্পীসংঘ থেকে শহীদুজ্জামান সেলিম, রওনক হাসানসহ আরও অনেকেই খোঁজখবর নিয়েছেন। তাঁরা কী বলেছেন, তা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আসাদ (রাইসুল ইসলাম আসাদ) মাঝেমধ্যেই খবর নেয়। শিল্পীসংঘ থেকে অনেকেই ফোন দিয়ে বলেছে কল্যাণপুরে যে সরকারি বৃদ্ধাশ্রম আছে, সেখানে নেওয়ার চেষ্টা করবেন। আমার কেউ নেই, তাঁরা ফোন দিলে ভালো লাগে। তাঁরাই আমার পরিবারের মতো।’

১৯৪৬ সালে তাঁর জন্ম। ১৯৬২ সালে মাত্র ১৬ বছর বয়স থেকে তিনি মঞ্চনাটকের রূপসজ্জা দিয়ে ক্যারিয়ারে পা রাখেন। টিভিতে চুক্তিভিত্তিক কাজ করতেন তিনি। স্বাধীনতার পরে আবদুর রহমান চলচ্চিত্রে রূপসজ্জার কাজ শুরু করেন। তিনি নির্মাতা নারায়ণ ঘোষ মিতা, সৈয়দ সালাউদ্দিন জাকী, কাজী জহির, হুমায়ূন আহমেদ, কলকাতার গৌতম ঘোষ, বাসু চ্যাটার্জিসহ অনেক গুণী নির্মাতার সঙ্গে কাজ করেছেন। অভিনেত্রীশিল্পীদের মধ্যে ভারতের শাবানা আজমি, সাবিত্রী চ্যাটার্জি, লাবণী সরকার, প্রসেনজিৎসহ অনেকের রূপসজ্জা করেছেন। দেশের নায়করাজ রাজ্জাক, কবরী, শাবানা থেকে শুরু করে প্রায় সবারই মেকআপ করেছেন এই শিল্পী। এখনো তাঁর কাজের কদর রয়েছে। তিনি জানান, ‘এখনো অনেকেই কাজ করার জন্য আমাকে ফোন দেন। কিন্তু শরীর কিছুটা অসুস্থ। করোনা পরিস্থিতির পর একটু ভালো অনুভব করলে কাজে ফিরব। কাজ ছাড়া আমার ভালো লাগে না। শেষ দিন পর্যন্ত কাজ করে যেতে চাই।’

আবদুর রহমান সর্বশেষ ‘ভুবন মাঝি’ ছবিতে কাজ করেছেন। ছবির ফাঁকে ফাঁকে অনেক নাটকেও কাজ করেছেন এই মেকআপ আর্টিস্ট। এ বছর অনুদানের জন্য ঘোষিত একটি ছবির নির্মাতা তাঁকে ফোন দিয়েছেন কাজের ব্যাপারে। তাঁর ইচ্ছা আছে শেষ কাজ হলেও এই ছবির কাজ করতে চান তিনি।