বহুমাত্রিক এক ক্ষণজন্মা নায়ক

নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি একটি অনুষ্ঠানে দেখা হয় বাংলাদেশের সালমান শাহ ও বলিউড অভিনেতা শাহরুখ খানের
নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি একটি অনুষ্ঠানে দেখা হয় বাংলাদেশের সালমান শাহ ও বলিউড অভিনেতা শাহরুখ খানের

মাত্র ২৫ বছরের জীবন তাঁর। এই স্বল্প সময়ে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে রেখে গেছেন অসামান্য অবদান। বলা যায়, দেশের চলচ্চিত্রে নতুন একটি ধারার সূচনা হয়েছিল তাঁর হাত ধরেই। ছবিতে তাঁর উপস্থিতি মানেই ছিল নিশ্চিত সাফল্য, প্রেক্ষাগৃহে উপচে পড়া দর্শকের সরব উপস্থিতি। ছবির ব্যবসায়িক সাফল্য আর জনপ্রিয়তা দুটিই সমান তালে এগিয়ে নিয়ে গেছেন তিনি। অভিনয়ের স্বতন্ত্রধারা আর ফ্যাশন সচেতনতা তাঁকে নিয়ে যায় ভিন্ন এক উচ্চতায়। এভাবে তিনি নিজেই নিজের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠেন। তিনি বাংলা চলচ্চিত্রের ক্ষণজন্মা নায়ক সালমান শাহ। পুরো নাম শাহরিয়ার চৌধুরী ইমন। দেখতে দেখতে তাঁর মৃত্যুর দেড় যুগ পেরিয়ে গেছে। আজ তাঁর ১৮তম মৃত্যুবার্ষিকী।
১৯৭১ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর সিলেটের দারিয়াপাড়ায় নানার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন সালমান শাহ। তাঁর বাবা কমর উদ্দিন চৌধুরী ও মা নীলা চৌধুরী। দুই ভাইয়ের মধ্যে সালমান বড়। ছোট ভাই শাহরান চৌধুরী ইভান। বৃশ্চিক রাশির জাতক সালমানের বিনোদন জগতে যাত্রা শুরু হয় বিজ্ঞাপনচিত্রের মডেল হিসেবে। তিনি ইস্পাহানি গোল্ডস্টার টি, জাগুয়ার কেডস, মিল্ক ভিটা, কোকাকোলা, ফানটা এবং জাগুয়ার কেডসের বিজ্ঞাপনচিত্রে কাজ করেন। ১৯৮৫ সালের দিকে হানিফ সংকেতের ‘কথার কথা’ নামের ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছিলেন সালমান। তখন অবশ্য তিনি ইমন নামেই পরিচিত ছিলেন।
গায়ক হিসেবেও সালমানের পরিচিতি ছিল। ছোটবেলা থেকেই শিল্প-সংস্কৃতির প্রতি দারুণ আগ্রহ ছিল তাঁর। বন্ধুমহলে সবাই তাঁকে কণ্ঠশিল্পী হিসেবে চিনতেন। ১৯৮৬ সালে ছায়ানট থেকে পল্লিগীতিতে উত্তীর্ণও হয়েছিলেন তিনি। ১৯৯৩ সালে চলচ্চিত্রে অভিনয়ে আসার আগেই মায়ের বান্ধবীর মেয়ে সামিরার সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন সালমান।

নব্বইয়ের দশকে বাংলা চলচ্চিত্র এক চরম দুঃসময় পার করছিল। ঠিক তখনই এ দেশের চলচ্চিত্রে যেন ধূমকেতু হয়েই আসেন সালমান শাহ। ১৯৯৩ সালের মার্চ মাস। জনপ্রিয় হিন্দি ছবি ‘কেয়ামত সে কেয়ামত তক’ ছবির কপিরাইট কিনে নেয় আনন্দমেলা সিনেমা লিমিটেড। বলিউডের জনপ্রিয় ছবিটির আদলে ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ ছবি নির্মাণের প্রস্তুতি নেন নির্মাতা সোহানুর রহমান সোহান। তখনকার জনপ্রিয় মডেল ও আনন্দ বিচিত্রা ফটোসুন্দরী মৌসুমীর সঙ্গে অভিনয়ের জন্য চুক্তিবদ্ধ হন সালমান। প্রথম ছবি দিয়ে তিনি জয় করে নেন অগণিত ভক্ত-দর্শকের হূদয়। রাতারাতি তিনি হয়ে ওঠেন ঢাকাই ছবির নির্ভরযোগ্য তারকা। সালমানের জনপ্রিয়তার পারদ এতটাই আকাশচুম্বী ছিল যে পরবর্তী সময়ে আর কোনো নায়কই সেই উচ্চতা অতিক্রম করতে পারেননি।

সালমান শাহ
সালমান শাহ


সালমানই একমাত্র নায়ক, যিনি সর্বমহলে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করতে এবং তরুণদের স্টাইল আইকন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে পেরেছিলেন। শিক্ষিত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির দর্শকদের হলে গিয়ে ছবি দেখার অনভ্যাস দূর করেছিলেন সালমান শাহ। সালমানকে তাঁরা প্রিয় নায়ক হিসেবে বরণ করে নিয়েছিলেন। ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ ছবিটি মুক্তির পর বাংলাদেশের চলচ্চিত্রও যেন নতুন করে প্রাণ ফিরে পায়। এরপর শুধুই এগিয়ে চলা। সালমানের ক্যারিয়ারে একের পর এক যোগ হতে থাকে সাফল্যের পালক। প্রথম ছবি থেকে শুরু করে শেষ ছবিটি পর্যন্ত সমান তালে নিজের জনপ্রিয়তা ধরে রেখেছিলেন সালমান শাহ। প্রথম ছবিতে মৌসুমীর সঙ্গে জুটি বাঁধলেও পরে শাবনূরের সঙ্গেও একটি সফল জুটি গড়ে ওঠে সালমানের। সালমান-শাবনূর জুটির একেকটি ছবি বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে সোনালি অতীত হয়ে আছে। এ ছাড়া সালমানের সঙ্গে জুটি বেঁধে অভিনয় করেছেন শাবনাজ, শাহনাজ, লিমা, শিল্পী, শ্যামা, সোনিয়া, বৃষ্টি, সাবরিনা ও কাঞ্চি।
মাত্র চার বছরের চলচ্চিত্র ক্যারিয়ার সালমানের। সময়টা অল্প হলেও একাই রাজত্ব করে গেছেন তিনি। এই চার বছরে উপহার দিয়েছেন ব্যবসাসফল ২৭টি ছবি। সালমান শাহ অভিনীত ছবিগুলো হচ্ছে ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ (১৯৯৩), ‘তুমি আমার’, ‘অন্তরে অন্তরে’, ‘সুজন সখী’, ‘বিক্ষোভ’, ‘স্নেহ’, ‘প্রেম যুদ্ধ’ (১৯৯৪), ‘কন্যাদান’, ‘দেনমোহর’, ‘স্বপ্নের ঠিকানা’, ‘আঞ্জুমান’, ‘মহামিলন’, ‘আশা ভালোবাসা’ (১৯৯৫), ‘বিচার হবে’, ‘এই ঘর এই সংসার’, ‘প্রিয়জন’, ‘তোমাকে চাই’, ‘স্বপ্নের পৃথিবী’, ‘সত্যের মৃত্যু নেই’, ‘জীবন সংসার’, ‘মায়ের অধিকার’, ‘চাওয়া থেকে পাওয়া’ (১৯৯৬), ‘প্রেমপিয়াসী’, ‘স্বপ্নের নায়ক’, ‘শুধু তুমি’, ‘আনন্দ অশ্রু’ ও ‘বুকের ভেতর আগুন’ (১৯৯৭)।

সালমান শুধু অভিনেতাই ছিলেন না, চলচ্চিত্রে নতুন ধারার প্রবর্তকও ছিলেন। একক কৃতিত্বে সামাজিক-অ্যাকশনধর্মী ও নিটোল প্রেমের ছবির নতুন একটি ধারার সঙ্গে সবাইকে পরিচিত করেছিলেন তিনি। চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মতে, বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে তাঁর অভিষেক ছিল রাজসিক। তাঁর কারণেই দেশীয় চলচ্চিত্র নতুন করে ঘুরে দাঁড়ায়। দর্শকরা আবারও হলমুখী হন। যেসব প্রযোজক ছবিতে লগ্নি করা বন্ধ করে দিয়েছিলেন তাঁরা আবারও ব্যবসায় ফিরে আসেন। নব্বইয়ের দশকে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে এক নতুন মাত্রা যোগ করেছিলেন সালমান শাহ।

অভিনয়ের মাধ্যমে সালমান শাহ যেমন সবাইকে মোহাবিষ্ট করে রাখতেন, ঠিক তেমনি অমায়িক ব্যবহারের জন্য পেয়েছিলেন অনেকেরই প্রশংসা। চলচ্চিত্রে সালমানের জনপ্রিয়তা যখন আকাশচুম্বী ঠিক তখনই মৃত্যুকে বরণ করে নিতে হয় তাঁকে। ১৯৯৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর আচমকা তাঁর মৃত্যুর সংবাদে স্তম্ভিত হয়ে পড়েছিল সবাই।