মহিলা সমিতি থেকে গ্লোব থিয়েটার

লন্ডনের গ্লোব থিয়েটারে ‘দ্য টেম্পেস্ট’ নাটকের মঞ্চায়ন
লন্ডনের গ্লোব থিয়েটারে ‘দ্য টেম্পেস্ট’ নাটকের মঞ্চায়ন

এ বছর ২৯ জুলাই ঢাকা থিয়েটারের ৪০ বছর পূর্তি হলো। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই এই থিয়েটারের প্রাণপুরুষ ছিলেন প্রয়াত নাট্যকার সেলিম আল দীন। ১৮ আগস্ট তাঁর জন্মদিন। এ উপলক্ষে নানা অভিজ্ঞতার একটি বর্ণিল রেখাচিত্র তুলে ধরেছেন ঢাকা থিয়েটারের কর্ণধার নাসির উদ্দীন ইউসুফ ঢাকা থিয়েটারের প্রথম নাটক মঞ্চায়ন ঢাকা জেলা ক্রীড়া সমিতি মিলনায়তনে, ১৯৭৩ সালের ৯ নভেম্বর। নাটক সংবাদ কার্টুন এবং সম্রাট ও প্রতিদ্বন্দ্বীগণ। এরপর ব্রিটিশ কাউন্সিল হয়ে মহিলা সমিতি। তারপর তো সেলিম আল দীনের হাত ধরে বাংলাদেশের গ্রামে গ্রামে গ্রাম থিয়েটারের শুভযাত্রা।দর্শনীর বিনিময়ে নিয়মিত দেশজ মৌলিক নাট্যচর্চার লক্ষ্যে ১৯৭৩-এর ২৯ জুলাই একদল মুক্তিযোদ্ধা ঢাকা থিয়েটার গঠন করেন। সেলিম আল দীন, ম. হামিদ এবং আমাকে আহ্বায়ক করে ঢাকা থিয়েটারের যাত্রা শুরু। পরে অবশ্য এই ৪০ বছরেও কোনো নতুন কমিটি হয়নি এবং পুরোনো কমিটির অস্তিত্ব নেই। থিয়েটার করাটা মূল লক্ষ্য যেখানে, কমিটি দিয়ে কী হবে? কোনো কমিটি ছাড়া ৪০ বছর অতিক্রম করল ঢাকা থিয়েটার।

জন্ম-বিভ্রান্তি আর অন্বেষণকাল (১৯৭৩-১৯৮০): মুক্তিযুদ্ধের পর আশা-নিরাশায় টাল খাওয়া এক অনিশ্চিত সময়ে ঢাকা থিয়েটারের জন্ম। পরজীবী নাট্যচর্চা প্রত্যাখ্যান করে দলটি মৌলিক নাটক রচনা ও মঞ্চায়নের প্রত্যয় ঘোষণা করল বটে, তবে তাদের নাটকে পশ্চিমের আঙ্গিক আর রীতি অনুসৃত হলো। ১৯৭৫-৭৬-এ মুনতাসির, ’৭৭-এ প্রথম নিয়মিত পথনাটক চর কাঁকড়ার ডকুমেন্টারি, ’৭৮-এ শকুন্তলায় আমরা দেখব ভাঙাগড়ার খেলা। আঙ্গিক ও বিষয়ের নতুনত্ব সবার দৃষ্টি কাড়ে বটে, কিন্তু মুক্ত-স্বাধীন জাতির নিজস্ব থিয়েটার তো এগুলো নয়।

শিকড় সন্ধানের কাল (১৯৮০-৮১): একালে যে তিনটি নাট্যধারা বাংলাদেশের মঞ্চে বিকশিত হতে থাকল, সেগুলো হচ্ছে— ১. ঔপনিবেশিক বাংলা থিয়েটার, ২.পশ্চিমা আধুনিক থিয়েটার, ৩. ঐতিহ্যবাহী নাট্যরীতির অনুপ্রেরণায় আধুনিক বাংলা থিয়েটার।

শেষোক্ত ধারায় বিরতিহীন কর্মোদ্দীপনা ও চর্চার মধ্য দিয়েই মানিকগঞ্জের তালুকনগরে প্রথম গ্রাম থিয়েটারের জন্ম হলো। ঢাকা থিয়েটারের আহ্বানে বগুড়া থিয়েটার, ফেনীর সংলাপ থিয়েটার, কুষ্টিয়ার বোধন থিয়েটার এক বৃহৎ কর্মযজ্ঞে ঝাঁপিয়ে পড়ল। নিজস্ব শিল্পরীতি, নাট্যরীতি, অভিনয়রীতি এবং আঙ্গিকসমূহ—যা থেকে ঔপনিবেশিক শাসনের কারণে আমরা বিচ্ছিন্ন হয়েছিলাম, তার সন্ধান ও গবেষণা চলল। ‘হাতের মুঠোয় হাজার বছর আমরা চলেছি সামনে’—এ স্লোগান নিয়ে শত শত গ্রাম থিয়েটার সংগঠিত হতে থাকে গ্রামে গ্রামে।

বর্ণনাত্মক নাট্যরীতি—ধ্রুপদি বাস্তবতার কাল: সেলিম আল দীনের সৃষ্টিশীল হাতে রচিত হলো ধ্রুপদি বাস্তবতা বা মহাকাব্যিক বাস্তবতার নাটক কীত্তনখোলা, কেরামতমঙ্গল ও হাতহদাই। যুগপৎ অভিনেতা-দর্শক এই প্রথম অনুভব করল, নাটকের মানুষ বা চরিত্র নিঃসঙ্গ নয়। তার চারপাশে রয়েছে বিচিত্র প্রাণীকুল, বৃক্ষরাজি, নদী, সমুদ্র, আকাশ ও নক্ষত্রমণ্ডল। এক মহাজীবনের সাক্ষাৎ পেল বাংলা নাটক। দর্শক-অভিনেতা দেখল, মানুষই শুধু নাটকের চরিত্র নয়, জগতের সবকিছুই নাটকের চরিত্র। শুধু সংলাপ নয়, বর্ণনা-কবিতা-সংগীতও নাটকে ব্যবহূত হলো ঘটনার প্রয়োজনে।

কথানাট্যের কাল: আমরা অচিরেই পেয়ে যাই নতুন নাট্যাঙ্গিক, ‘কথানাট্য’। এ ধারায় সেলিম আল দীনের তিনটি রচনা চাকা, যৈবতী কন্যার মন ও হরগজ। ‘কথানাট্য’ অভিধা সম্পর্কে সেলিম আল দীনের বক্তব্য, ‘আমি কথার শাসনে নাটক রচনা করেছি, তাই এর নাম দিয়েছি কথানাট্য।’ সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক যথার্থই বলেছিলেন, ‘সংলাপনির্ভর নাটক তাঁর কাছে যথেষ্ট মনে হয় না, আবার কেবল দেহছন্দ-নাচ-অভিনয় সকল কিছু তাকে এঁটে উঠতে পারে না, উপন্যাসের ধারাবর্ণনাও তাঁর নিকট বলে মনে হয় না, সৃষ্টি-স্থিতি-লয় এবং ব্যক্তি-সমাজ-সংগ্রাম তাঁকে অবিরাম দুলিয়ে দিতে থাকে ভূত-ভবিষ্যতে, এমত মুহূর্তে আমাদের এই নাট্যকার এক নতুন সাহিত্য মাধ্যম আবিষ্কার  করে ফেলেন—কথানাট্য—যা              নাটক, কবিতা, নাচ, গীত, উপন্যাস উপকথা ও কথকতার সমাহার।’

নব্যপাঁচালি-রীতির কাল: পাঁচালি আঙ্গিককে আধুনিক মনস্কতায় পুনর্নির্মাণ করে রচিত নাটক বনপাংশুল ও প্রাচ্য। একালে যার নামকরণ করা হয়েছে ‘নব্যপাঁচালি’। এ আঙ্গিক    বাঙালির, এ আঙ্গিক হাজার বছরের মানুষের আচরিত জীবনপ্রবাহের অনুকূল, যাতে এক আকাশে বেঁধে ফেলা যায় সর্বকালের সব সূর্যতারাকে। পরবর্তী সময়ে কথানাট্য ও পালার অভিজ্ঞতায় ঢাকা থিয়েটার মঞ্চে আনে আধুনিক বাংলা থিয়েটারের প্রথম নারী অভিনয়শিল্পী শ্রীমতী বিনোদিনী দাসীর জীবনকে উপজীব্য করে বিনোদিনী। এই কালপর্বে ঢাকা থিয়েটার মঞ্চায়ন করে মৃত্যুসংবাদ, ন নৈরামনি, নিমজ্জন, ধাবমান, নষ্টনীড়, জিয়ন্তকাল ও সর্বশেষ পঞ্চনারী আখ্যান।

২০১২ সালে লন্ডনের অলিম্পিকের অংশ হিসেবে বিশ্বখ্যাত নাট্যকার উইলিয়াম শেকসিপয়ার রচিত ৩৭টি নাটক ৩৭টি ভাষায় শেকসিপয়ার প্রতিষ্ঠিত গ্লোব থিয়েটারের মঞ্চায়িত হয়েছে। বাংলা ভাষায় একমাত্র নাটকটি মঞ্চায়নের   গৌরব অর্জন করেছে ঢাকা থিয়েটার। শেকসিপআর রচিত    দ্য টেম্পেস্ট নাটকটি বাংলার সার্বভৌম নব্যপাঁচালি আঙ্গিকে রূপান্তরিত করে সেটি মঞ্চে উপস্থাপন করে বিশ্বব্যাপী    প্রশংসা অর্জন করেছে।    আমাদের যে স্বপ্ন ছিল ‘বিশ্ব রঙ্গমঞ্চে ঝংকৃত হোক বাংলা নাটকের শাশ্বত রূপ’, তা-ই বাস্তবে এসে ধরা দিয়েছে।

সেলিম-উত্তর বাংলা নাটক এবং ঢাকা থিয়েটারের ৪০ বছর: আধুনিক বাংলা নাটকের রূপকার সেলিম আল দীনের প্রয়াণ ঘটে অকালে, মাত্র ৫৮ বছর বয়সে ২০০৮ সালে। আমি ঠিক নিশ্চিত নই সেলিমবিহীন বাংলা মঞ্চ ও নাট্য কী রূপ পরিগ্রহ করবে। তবু আস্থা আছে অনুজদের প্রতি, দর্শককুলের প্রতি।

২৯ জুলাই ২০১৩ ঢাকা থিয়েটারের ৪০ বছর পূর্ণ হলো। এদিন ১৪টি নাটকের নির্বাচিত অংশের অভিনয় দেখলেন মিলনায়তন উপচে পড়া দর্শক। দলের নতুন-পুরোনো কলাকুশলীদের সম্মিলিত পরিবেশনায় দর্শকদের মুহুর্মুহু করতালি এবং আনন্দধ্বনি এ কথা জানান দিল যে ৪০ বছর আগে আমরা যে অভিযাত্রায় নেমেছিলাম, তা বৃথা যায়নি। কেননা, আজ সারা বাংলাদেশে এমনকি ভারতের পশ্চিমবঙ্গেও আমাদের ধারায় নাট্যচর্চার নান্দনিক অভিপ্রায় লক্ষ করি। নব্যপাঁচালির মধ্যেই যে রয়েছে বাঙালির জাতীয় নাট্যাঙ্গিকের সুস্পষ্ট যে রূপ—এটি আজ আর অধরা নেই।

মঞ্চের উজ্জ্বল আলোয় যখন অভিনয় চলছে, এর মধ্যে দর্শকের আনন্দধ্বনি যখন মিলনায়তন ভেদ করে শিল্পকলার মাঠে-রাস্তায় আকাশে-বাতাসে ছড়িয়ে পড়ছিল, তখন মঞ্চের বাইরে আলোকিত পরিসরে বসে আমি একা সেলিমের কথা—যে বন্ধুদের হারিয়েছি এ দীর্ঘযাত্রায়, তাঁদের কথা মনে করছি। চোখের কোণে তখন অশ্রু জমেছিল বৈকি। কিন্তু প্রায় একই সঙ্গে আবার এ কথাও মনে হয়েছিল, ‘বাহ্ বেঁচে থাকা নেহাত মন্দ না’।