অভাগীর কথা পড়ে তব মনে...

কহে বীরাঙ্গনা নাটকে জ্যোতি সিনহা
কহে বীরাঙ্গনা নাটকে জ্যোতি সিনহা

মঞ্চনাটকের প্রতিটি প্রদর্শনীই নতুন এবং জীবন্ত—এটি তো নতুন করে বলার মতো কোনো কথা নয়। তবু শুভাশিস সিনহা নির্দেশিত মণিপুরি থিয়েটারের কহে বীরাঙ্গনা নাটকের ৫০তম প্রদর্শনী দেখতে গিয়ে মনে উঁকি দিল বহুচর্চিত এ কথা। কারণ, ১৩ জুন সন্ধ্যায় বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীর স্টুডিও থিয়েটারে এ নাটকের প্রদর্শনীতে নতুনভাবে বলার মতো কিছু ঘটনা তো ঘটেছেই। নাটকের মূল পাত্রী জ্যোতি সিনহা অভিনয়ে কি আরেকটু বেশি মুনশিয়ানা দেখাননি? অথবা প্রযোজনায় ভিন্ন ভিন্ন চারটি পর্বে যে অভিন্ন মালা গাঁথা হলো, অভিনয়, কোরিওগ্রাফ, সংগীত—সব মিলে এক ঘণ্টায় তৈরি হলো যে নান্দনিক মুহূর্তগুলো, সেটিও কি আগের যেকোনো প্রদর্শনীর চেয়ে বেশি সুসজ্জিত নয়?
প্রশ্নের মধ্যেই উত্তর দেওয়া আছে। উত্তরটি হলো, ‘হ্যাঁ’। ওই যে ‘নতুন কথা’র কথা বললাম, সেগুলো উহ্য আছে এর মধ্যে। মাইকেল মধুসূধন দত্তের ‘বীরাঙ্গনা কাব্য’ প্রযোজনাটির মুখ্য অবলম্বন—মহাভারতের চার বীরাঙ্গনা শকুন্তলা, দ্রৌপদী, দুঃশলা ও জনার বৃত্তান্ত আছে এতে। তো, কাব্যের কাব্যাংশ অবিকৃত রেখে চার নারীর দুঃখভারাতুর আখ্যান দৃশ্যায়িত হয়েছে নাটকের চার পর্বে। পুরাণের চার রমণী নিজেদের স্বামী—যথাক্রমে রাজা দুষ্মন্ত, অর্জুন, জয়দ্রথ ও নীলধ্বজের কাছে লিখলেন ভিন্ন ভিন্ন চিঠি। আর এই পত্রের ভেতর দিয়ে আমরা দেখলাম ‘কেবলই দৃশ্যের জন্ম হয়’ মঞ্চে। আর সেই দৃশ্যের মধ্যে আঙ্গিক, বাচিক, সাত্ত্বিক ও আহার্য—অভিনয়ের এই চার পর্যায়ের পরম্পরায় ভেসে ওঠে, হেসে ওঠে এবং সব শেষে কেঁদে ওঠে কবিতার চরণগুলো। যত সহজে কথাটি বলা গেল, আদতে কাজটি কিন্তু যথেষ্ট কঠিন। এই কঠিন কাজ কঠিনতর হয়ে ওঠে যখন একক অভিনয়ের মাধ্যমে চারটি চরিত্র, চরিত্রগুলোর ভিন্ন ভিন্ন আবেগ রূপায়ণ করেন মাত্র একজন অভিনয়শিল্পী। আলোচ্য প্রযোজনার একক অভিনয়শিল্পী জ্যোতি সিনহা ওই কঠিন কাজটি করেছেন বেশ সফলভাবেই।
কাব্যের পরিস্থিতি অনুযায়ী শকুন্তলা, দ্রৌপদী ও দুঃশলার চরিত্রায়ণে বর্ণনাত্মক অভিনয়ের সঙ্গে চরিত্রাভিনয়ের মিশেলে মুহূর্তে মুহূর্তে কণ্ঠ, ভাব ও মুদ্রার পরিবর্তন ঘটিয়েছেন জ্যোতি। যেমন, শকুন্তলা হয়ে দুষ্মন্তকে যখন ‘পত্রিকা’ লিখছেন, ভাব ও মুদ্রাকে সম্বল করে তৈরি করেছেন তপোবন। এভাবে কাব্যের প্রতিটি শব্দ ও শব্দের ভেতর-বাইরের অনুভূতি আমাদের কাছে দৃশ্যমান হয়েছে ফরসাভাবে। তবে এ তিন পর্বে চরিত্রাভিনয়ের চেয়ে যেন বা বর্ণনাত্মক অভিনয়ের রেশ ছিল বেশি। আর প্রতিটি পর্বের শেষে বীরাঙ্গনার যে হাহাকার ছিল, তাও কি শেষ পর্বে জনার যে গগনবিদারী হাহাকার, তার তুলনায় খানিকটা কম নয়?
কহে বীরাঙ্গনার শেষ পর্বে আমরা যখন জনা চরিত্রটির অবয়বে দেখতে পাই বর্ণনাত্মক অভিনয় অপেক্ষা চরিত্রাভিনয় রীতির আধিক্য, আমাদের মনে হয়, আহা পুত্রহারা মায়ের হাহাকার ও আকুতি রূপায়ণে, বীরাঙ্গনাদের ভাষ্যগুলো দর্শক-হৃদয়ে খোদাই করতে এর চেয়ে মোক্ষম অস্ত্র আর কী হতে পারত! কে জানে এ চরিত্রের মধ্য দিয়েই হয়তো বীরাঙ্গনার সর্বোচ্চ আর্তি দর্শকের কাছে পৌঁছে দিতে চেয়েছেন নির্দেশক।
মঞ্চ, সংগীত, অভিনয়—কহে বীরাঙ্গনায় নির্দেশক শুভাসিশ সিনহার পক্ষপাত ছিল ‘নিরাভরন থিয়েটারে’। কেবল অভিনয়ের ওপর ভর করে এবং তেমন কোনো প্রপস ছাড়াই নাটকে স্মরণীয় বেশ কয়েকটি মুহূর্ত সৃষ্টি করেছেন তিনি। সামান্য কাপড়ের মাধ্যমে দুঃশলার পাখির অসামান্য আবহ কিংবা একই পদ্ধতিতে জনার পানিতে লীন হয়ে যাওয়া—দৃশ্যগুলো গেঁধে আছে চোখে। সব শেষে মনে পড়ছে, এই নাট্যকাব্যের একটি চরণ—‘অভাগী দাসির কথা পড়ে তব মনে’।