বোধের প্রাপ্তি ও লড়াইয়ের গল্প

লালচর ছবিতে মিলন ও মোহনা মিম
লালচর ছবিতে মিলন ও মোহনা মিম

নদীপাড়ের মানুষের সংগ্রাম নিয়ে এ দেশে একাধিক সমাদৃত চলচিত্র নির্মিত হয়েছে। নাদের চৌধুরী পরিচালিত লালচর তেমন একটি চলচিত্র। যার কাহিনির উৎস কথাসাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলন রচিত নদী উপাখ্যান উপন্যাস। চলচ্চিত্রটি প্রারম্ভে সংযোজিত গীতধ্বনি প্রকাশ করে কাহিনির অন্তসারে রোপিত ভাবের উদ্দেশ্য। গল্পটির দৃশ্য শুরু লং শটে। বিস্তির্ণ নদীর বুক চিরে একজন মাঝিকে নৌকা নিয়ে আসতে দেখা যায়। মিড শটে মাঝিরূপে আনিসুর রহমান মিলনকে পর্দায় পাওয়া যায়। তার পয়েন্ট অব ভিউ থেকে পরিচালক নদীর বুকে জেগে থাকা চর দেখান। যা ছিল মিলনের স্বপ্নে দেখা। সিনেমা কৌশলে ফ্লাশ ব্যাক শট। সকালের আলোর রেশ ও পাখির কলতানে মিলনের ঘুম ভাঙে। মিলন মাছ ধরতে ছুটে যান মাঝনদীতে। নদীপাড়ের যুবক মিলনের বোধের প্রাপ্তি এবং লড়াইয়ের গল্প লালচর। যুবক মিলনের স্বপ্ন সত্য হয়। একদিন তিনি নতুন চরের সন্ধান পান। চরে দাঁড়িয়ে আনন্দ-চিৎকারে জেলেদের একত্র করেন। কিন্তু যুবক মিলন আবিষ্কৃত চিত্র প্রতিমায় পরিচালক যে চরটি দেখিয়েছেন, তা এক দিনে জেগে ওঠা চর নয়। এমন দৈর্ঘ্য-প্রস্থে একটি চর জেগে উঠতে কত বছর সময় পার হবে ভূবিজ্ঞানীরাই ভালো জানবেন। অথচ নিত্যদিন নদীর বুকে আসা-যাওয়া করা মিলন হঠাৎই একদিন জেগে ওঠা চরটি দেখে ফেলেন।
দর্শক স্বজ্ঞানেই পরিচালকের দেখানো চরটিকে মেনে নিয়ে গল্প রসে মুগ্ধ হন। মোহনার সপ্রতিভ আবেগ, অভিনয় দেহভঙ্গি আর মনোরম দৃশ্যপটে লালচর চলচ্চিত্রটি একটি সাংস্কৃতিক উপভোগ্য বিষয়ে রূপ পায়। এর সঙ্গে যুক্ত হয় জেগে ওঠা চরের মালিকানা ও আধিপত্য বিস্তারে তালুকদারের (শহীদুজ্জামান সেলিম) ষড়যন্ত্র। সম্ভাব্য সংঘর্ষ মুহূর্তে ফেরারি খুনি নাদের যিনি মিলনের বাবা, তালুকদারের কাছে তার আশ্রয় প্রার্থনা গল্প নতুন রহস্যের দানা বাঁধে। শিল্পের প্রথম কথা হলো রহস্য। দর্শক ভাবনায় উঁকি দেয় ছেলের বিরুদ্ধে বাবার লড়াইয়ের ঐতিহাসিক উপাখ্যান সোহরাব-রুস্তমের কাহিনি মনে করিয়ে দেবে। কিন্তু গল্পের অন্তঃসমাধানে সামগ্রিক গণস্বার্থেই নাদের ছেলেসহ তালুকদারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান, গুলিবিদ্ধ হন। তালুকদারের লাঠিয়াল দ্বারা আক্রান্ত মিলনের রক্তে নদীর জল লাল রঙে রঞ্জিত হয়। লালচর (প্রতীক অর্থে) চলচ্চিত্রের সমাপ্তি ঘটে।
কাহিনি চিত্র প্রধানত সংলাপের ওপর নির্ভর করে। লালচর চলচ্চিত্রের সংলাপ গল্পের অনুষঙ্গে প্রাসঙ্গিক বটে। তবে আরও লোকশব্দ সংবলিত হলে প্রেক্ষাপটের ভৌগোলিক অবস্থান সুস্পষ্ট হতো। ‘অন্তরে ছিলাম পোড়া’ নায়ক-নায়িকার দ্বৈত কণ্ঠের গীতটি দর্শকদের অনুভব করিয়ে দেয়, গান শুধু সংগীত শব্দ নয়, মানব মনের অনুভূতির রূপ, বিনোদনের এক পর্ব, জীবনের পরিভাষা।
চলচ্চিত্রে সংযোজিত আবহ সংগীত ধ্বনি গেল্প একাত্ম হতে অনেক হোঁচট খেয়েছে। কাহিনির পরিবেশ, উপলক্ষ যতটা নান্দনিক হওয়ার সুযোগ ছিল, সে ক্ষেত্রে চিত্র গ্রহণের অনুমিত দৃশ্যগুলো দর্শককে বিমূর্ত স্তরে পৌঁছে দিতে পারত। চিত্র সম্পাদনার কারিগরি ভাষা প্রয়োগের তেমন সুযোগ না থাকলেও ঘরের উঠোনে বাবা ও ছেলের শেষ দৃশ্যের অভিনয় এবং মিলনের চর যাত্রায় মোহনার উৎকণ্ঠাভরা প্রতিক্রিয়া নান্দনিক প্রয়োজন মেটাতে পেরেছে।
নাদেরের খুন করা ও ফেরার থাকার যৌক্তিক কারণের অস্পষ্টতায় চরিত্রটি বৈশিষ্ট্যপূর্ণ হওয়ার সুযোগ হারিয়েছে। চর দখলে নাদের চরিত্রে খুন হওয়া মনে হয় যেন প্রয়োজন পূরণ-সংক্রান্ত সমাধান।