রুবায়েতের আন্ডার কনস্ট্রাকশন

আন্ডার কনস্ট্রাকশন ছবিতে রাহুল বোস ও শাহানা গোস্বামী
আন্ডার কনস্ট্রাকশন ছবিতে রাহুল বোস ও শাহানা গোস্বামী

রুবায়েত হোসেনের নতুন ছবির নাম আন্ডার কনস্ট্রাকশন। এই ছবিতে বেশ কিছু কনস্ট্রাকশনের শট আছে, ছবির বিভিন্ন অংশে তা প্রতিস্থাপিত। পথের পাঁচালীতে বেশ কয়েকটি পথের শট আছে, ছবির বিভিন্ন অংশে তা প্রতিস্থাপিত। পথের পাঁচালী যেমন রাস্তা-ঘাটের গল্প নয়, আন্ডার কনস্ট্রাকশনও অট্টালিকা নির্মাণের গল্প নয়।
আন্ডার কনস্ট্রাকশন রুবায়েত হোসেনের দ্বিতীয় ছবি। মেহেরজান-এর পর দীর্ঘ বিরতি দিয়ে তিনি এই ছবিটি বানিয়েছেন। নবীন-প্রবীণ সব সৃজনশীল মানুষই একধরনের কনস্ট্রাকশনের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যায়। আন্ডার কনস্ট্রাকশন-এর ভেতর দিয়েই সৃজনশীলতা বিকশিত হয়। কারও জন্য এই প্রক্রিয়া দীর্ঘ, আবার কারও জন্য সংক্ষিপ্ত। যাঁদের প্রক্রিয়ার সমাপ্তি ঘটে, তাঁরা সিদ্ধান্তে আসতে পারেন, পেছনে লাল সূর্যোদয় আর তাঁর সামনে মুষ্টিবদ্ধ হাতের চিত্র সহজেই আঁকতে পারেন। পথ খুঁজে পান, সেই পথ দিয়ে বারবার হাঁটেন। আর যাঁদের প্রক্রিয়া দীর্ঘ, তাঁরা বহু পথে হাঁটেন। সংশয় তাঁদের সহযাত্রী।
রুবায়েত নবীন একজন চলচ্চিত্র নির্মাতা। তাই তাঁর সৃজনের পথে আন্ডার কনস্ট্রাকশন-এর প্রক্রিয়া প্রকট থাকবে, সেটাই স্বাভাবিক। হয়ে গেছে ভাববেন না, হতে হবে ভাববেন। মেহেরজান ও আন্ডার কনস্ট্রাকশন-এর বিষয়গত ও আঙ্গিক গঠনে রয়েছে ভিন্নতা। মেহেরজান অনেকটা সরলরৈখিক আর আন্ডার কনস্ট্রাকশন বিশ্লেষণাত্মক, দ্বান্দ্বিক। এই দ্বন্দ্ব কখনো সামাজিক, কখনো বিশ্বাসগত আবার কখনো ব্যক্তির মনোজাগতিক।
চেনা কিছু চরিত্র, চেনা কিছু ঘটনা, অনেকটাই চেনা সংকট নিয়েই নির্মিত হয়েছে ছবিটি। সেদিক থেকে নতুন কিছু নয়। নতুনত্ব অন্য জায়গায়, তা হলো ট্রিটমেন্টে। বিভিন্ন চরিত্র, বিভিন্ন ঘটনা, বিভিন্ন মানসিক গঠন বিশ্লেষণ করেছেন রুবায়েত। কিছু ক্ষেত্রে দ্বন্দ্ব তৈরি হয়। সবই উন্মুক্ত রেখেছেন। কোনো সমাধান দেওয়ার চেষ্টা করেননি। তা সচেতনভাবেই হোক অথবা রুবায়েতের সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো যৌক্তিক অবস্থানে পৌঁছাতে না পারার কারণেই হোক। সংকট যখন জটিল, তখন একবাক্য বা দৃশ্যে সমাধান দেওয়ার চেষ্টা না করাটাই বুদ্ধিমানের কাজ। দর্শকই সিদ্ধান্ত নিন—রক্তকরবীর ইন্টারপ্রিটেশন নিয়ে রয়া, ইমতিয়াজ আর রাসেলের বিরোধে কোন পক্ষ নেবেন? রয়ার সন্তান নেওয়া না নেওয়ায় মা ও স্বামীর সঙ্গে বিরোধে কোনটাকে যৌক্তিক মনে করবেন? রক্তকরবীর নন্দিনী কি শুধুই তরুণী, অপরূপা? ৩২ বছর বয়সী কোনো নারীকে নন্দিনী ভাবা যায় না? এ সময়ে এসে, যেখানে রয়া ১২ বছর ধরে নন্দিনী করছে, তারপরও মায়ের একই ভাবনা, যেসব মেয়ে অভিনয় করে, তাদের সবাই বেশ্যা মনে করে। মা একজন স্বনির্ভর, নিজের আয়ে নিজে চলেন, কিন্তু মানসিক গঠন ও বিশ্বাসের জায়গায় অবিকাশমান। রয়া স্বামীর টাকায় চলে, কিন্তু মানসিক গঠন ও বিশ্বাসের জায়গায় বিকাশমান। রয়া ময়নাকে লিফটম্যান স্বামীর ঘর থেকে ফিরে আসতে বলে, ময়না আসে না। ময়না কি তার স্বামীকে অনেক ভালোবাসে? অনাগত সন্তানের বাবা তার স্বামী। স্বামী তার অবলম্বন, সংসার। কিন্তু রয়ার দেওয়া উপহার মূল্যবান স্বর্ণালংকার নিজের কাছে রাখতে চায় না, রয়ার কাছেই রাখতে বলে কারণ তার স্বামী এই অলংকার নিয়ে নেবে। স্বামী তার অবলম্বন, কিন্তু বিশ্বস্ত নয়।
শান্ত ও ধীরস্থির লয়ে আন্ডার কনস্ট্রাকশন নির্মিত হয়েছে। উল্লেখ করার মতো বেশ কিছু মুহূর্ত আছে। মার্টিনা র্যাডওয়ানের ফটোগ্রাফিতে বাহুল্য নেই, আছে পরিমিতি। পরিমিতি আছে অর্ণবের সংগীতে এবং সুজন মাহমুদের শব্দ পরিকল্পনা ও সম্পাদনায়। রয়া চরিত্রে অভিনয় করেছেন শাহানা গোস্বামী, ভারতীয় অভিনেত্রী, রয়া চরিত্রে তাঁকে নির্বাচন করাকে সমর্থন দেওয়া যায়, কিন্তু আরেক ভারতীয় অভিনেতা রাহুল বোস, যিনি ইমতিয়াজ চরিত্রে অভিনয় করেছেন, তাঁর উপস্থিতি কোনো মাত্রা দেয় না। মায়ের চরিত্রে মিতা রহমানকে অন্য রকম মনে হয়েছে। অন্যরা? একবাক্যে সবাই ভালো।
আন্ডার কনস্ট্রাকশন-এর মধ্য দিয়ে রুবায়েত এগিয়ে যাচ্ছেন। নিয়মিত চলচ্চিত্র নির্মাণ করবেন, এই প্রত্যাশা রইল।