তারার আলোর ঝলকানি

মেরিল–প্রথম আলো পুরস্কার ২০১৫ অনুষ্ঠানের মঞ্চে একসঙ্গে তামান্না রহমানের নৃত্যম নৃত্যশীলন, মুনমুন আহমেদের রেওয়াজ পারফর্মিং স্কুল ও শর্মিলা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নৃত্য নন্দনের পরিবেশনা
মেরিল–প্রথম আলো পুরস্কার ২০১৫ অনুষ্ঠানের মঞ্চে একসঙ্গে তামান্না রহমানের নৃত্যম নৃত্যশীলন, মুনমুন আহমেদের রেওয়াজ পারফর্মিং স্কুল ও শর্মিলা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নৃত্য নন্দনের পরিবেশনা

হ্যাঁ, অজস্র তারার রোশনাইয়ে হাসছিল মঞ্চ, ঝলমল করছিল গোটা মিলনায়তনও। তবে ‘মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কার-২০১৫’-এর অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রের ‘হল অব ফেম’-এর এই মঞ্চটিতে সেদিন কি হাসিখুশিমাখা ‘ভূমিকম্প’ হয়েছিল? বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের সেরা তারকারা একের পর এক যেভাবে এই মঞ্চে উঠে এলেন, তাতে ভূমিকম্প না হলেও ‘মঞ্চকম্প’ হতেই পারত। তা ছাড়া মিলনায়তনের একই মঞ্চের ভেতর নাচ-গান আর হাস্যরসের বর্ণিলতায় যখন ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, কুষ্টিয়া, রংপুর, বরিশাল ও সিরাজগঞ্জের সংস্কৃতি—মানে বাংলাদেশকেই দেখা গেল, মনে হলো, গোটা দেশই তো এক মঞ্চে হাজির! আনন্দদায়ক কত কিছুই না ঘটতে পারে এখানে। মেরিল-প্রথম আলোর ১৮তম আসরে ঘটেওছিল নানা রঙের কাণ্ড।

উপস্থাপক খুঁজে খুঁজে হয়রান
গত ২৯ এপ্রিল বিকেল ৫টায় রুম্মান রশীদ খান ও মৌমিতা জান্নাতের উপস্থাপনায় শুরু হলো ‘লাল গালিচা’। পরে সন্ধ্যায় ‘হল অব ফেম’-এর মঞ্চে প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আনিসুল হক যখন প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান ও স্কয়ার টয়লেট্রিজ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক অঞ্জন চৌধুরীকে ডেকে নিলেন, অনুষ্ঠানের বিচিত্র আয়োজন ততক্ষণে পাখা মেলতে শুরু করেছে মাত্র। মতিউর রহমান ও অঞ্জন চৌধুরীর বক্তব্যের পর মূল অনুষ্ঠান দেখার জন্য ব্যাকুল সবাই। দেশসেরা নৃত্যশিল্পী শর্মিলা বন্দ্যোপাধ্যায়, তামান্না রহমান ও মুনমুন আহমেদের দল নৃত্যম নৃত্যশীলন, নৃত্যনন্দন ও রেওয়াজ পারফর্মিং স্কুলের শিল্পীদের নাচের মধ্য দিয়ে শুরুও হলো ঝকমারি আয়োজন, কিন্তু উপস্থাপক কোথায়?

তাহসান: কখনো উপস্থাপক কখনো জেমস বন্ড
তাহসান: কখনো উপস্থাপক কখনো জেমস বন্ড

নতুন এক সিনেমা
উপস্থাপকের দেখা না পেয়ে সবাই দেখতে থাকলেন নতুন এক সিনেমা—অবুঝ মনের সবুজ ভালোবাসা। ছবির গল্পে দেখা দিলেন এক জোড়া প্রেমিক-প্রেমিকা রাজ আর রেশমি—আরেফিন শুভ ও নুসরাত ফারিয়া; এবং একজন প্রতাপশালী চৌধুরী সাহেব—শহীদুল আলম সাচ্চু। বাজার চলতি বাংলা সিনেমা বটে! সিনেমায় যেমন নৃত্যগীত থাকে, এই সিনেমাও ছিল তেমনি নাচ-গানে ভরপুর। আর এই নাচ-গানের মধ্য দিয়েই মঞ্চ মাতালেন বিনোদন জগতের একঝাঁক তারকা—কখনো নোবেল-পূর্ণিমা, কখনো ফেরদৌস-মিম, কখনো-বা সজল-মেহজাবিনসহ তানজিন তিশা ও সাবিলা নূর। প্রবীণ শিল্পী লায়লা হাসান ও ডলি ইকবাল নাচলেন অভিনয় সহযোগে। গান গাইলেন সালমা ও পুলক। এ ছাড়া আরফান আহমেদের পরিবেশনাও ছিল অনবদ্য।
অনুষ্ঠান দেখতে দেখতেই মঞ্চের বড় পর্দায় প্রেমিকা ফারিয়াকে নিয়ে শুভকে পালাতে দেখছি আমরা। কখনো তাঁরা ছুটছেন চট্টগ্রাম, সিলেট, কুষ্টিয়ায়, কখনো আবার তাঁদের দেখা যাচ্ছে রংপুরে। আর এই পুরো সময় এ জুটির পিছু ধাওয়া করছেন চৌধুরী সাহেব। অতঃপর প্রেমিক-প্রেমিকাকে খোঁজার জন্য ডাক পড়ল গোয়েন্দার। তিনি আর কেউ নন—জিরো জিরো সেভেনখ্যাত জেমস বন্ড। মঞ্চে হাজির জেমসবন্ডরূপী তাহসান। দেখা গেল গোয়েন্দাগিরির ফাঁকে ফাঁকে এখানে তিনি ‘সমালোচক পুরস্কার’ ও ‘তারকা জরিপ পুরস্কার’ পাওয়া তারকাদেরও ডেকে নিচ্ছেন মঞ্চে। তবে কি তিনিই এ অনুষ্ঠানের উপস্থাপক, নাকি আরেফিন শুভ ও নুসরাত ফারিয়ার হাতে উপস্থাপনার দায়িত্ব?
এবারের মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কারের অনুষ্ঠানে ছিল ভিন্ন এক চমক। পূর্ণদৈর্ঘ্য বাংলা ছায়াছবির কাহিনির ভেতর দিয়ে তাহসান, আরেফিন শুভ ও নুসরাত ফারিয়া উপস্থাপনা করলেন গোটা আয়োজন।

দুই দিওয়ানা: ফেরদৌস ও িমম
দুই দিওয়ানা: ফেরদৌস ও িমম

‘সবাই যা করে’ সেই সেলফি
বিভিন্ন বিভাগে পুরস্কার দেওয়া হচ্ছে। সবাইকে মঞ্চে ডেকে নিচ্ছেন তাহসান। সমালোচক বিভাগে মঞ্চে সে সময় দেওয়া হলো ‘সেরা চলচ্চিত্র অভিনয়শিল্পী (নারী) পুরস্কার’। ছুঁয়ে দিলে মন ছবিতে অভিনয়ের জন্য পুরস্কার পেয়েছেন জাকিয়া বারী মম। অভিনয়শিল্পী আল মনসুর ও সারা যাকেরের কাছ থেকে পুরস্কার নিলেন মম। এবার তো তাঁদের মঞ্চ ত্যাগ করার কথা। কিন্তু না। হঠাৎই পকেট থেকে মোবাইল বের করলেন আল মনসুর। এরপরই ক্লিক...ক্লিক... সেলফি—এক ফ্রেমে বন্দী হলেন তাঁরা। আল মনসুরের গলায় শোনা গেল একটি বাক্য, ‘এখন ঘরে-বাইরে সবাই যা করে আমিও তা-ই করলাম।’
‘কেউ কতা রাহে নাই রে মনু’
মঞ্চ মাতাচ্ছেন সাজু খাদেম। তিনি তো একাই এক শ। একেকটি কথা বলেন আর দিলখুশ হয়ে মুখ বিকশিত হয় আমাদের। কিন্তু মেরিল-প্রথম আলোর অনুষ্ঠানে কেবল এক শ-তে মন ভরবে কেন সবার! তাই হয়তো জাহিদ হাসান, মীর সাব্বির আর মোশাররফ করিমকে মঞ্চে ডেকে নিলেন সাজু। মঞ্চে তাঁরা সবাই করলেন নানা কিছু। কেমন ছিল সেই পর্ব?
একটু ধারণা দিই: সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বিখ্যাত কবিতা ‘কেউ কথা রাখেনি’ পড়লেন মীর সাব্বির। তাঁর পড়ার ভেতরেই ছিল আসল মজা—‘কেউ কথা রাখেনি, তেত্রিশ বছর কাটল কেউ কথা রাখেনি’—এই চরণটিকে সাব্বির যে মুহূর্তে পড়লেন: ‘কেউ কতা রাহে নাই রে মনু’; না হেসে কি পারা যায় তখন? গোটা কবিতাটিই সাব্বির পড়লেন খাঁটি বরিশালের ভাষায়। অন্যদিকে জাহিদ হাসান, মোশাররফ করিমও কী কম! কেহ কারে নাহি ছাড়ে সমানে সমান।

কেউ যেন কারও চেয়ে কম নন। মোশাররফ করিম, জাহিদ হাসান, সাজু খাদেম ও মীর সাব্বিরের রসিকতা সবাইকে মুগ্ধ করে
কেউ যেন কারও চেয়ে কম নন। মোশাররফ করিম, জাহিদ হাসান, সাজু খাদেম ও মীর সাব্বিরের রসিকতা সবাইকে মুগ্ধ করে

‘আমি পচে গেছি’
গোটা অনুষ্ঠানে সবাইকে পুরস্কার নিতে ডেকেছেন তিনি। কিন্তু একসময় পুরস্কার নেওয়ার জন্য ডাকা হলো তাঁকেই। দর্শকের ভোটে তারকা জরিপ বিভাগে ‘সেরা সংগীতশিল্পী (পুরুষ) পুরস্কার’ পেলেন তাহসান। ‘তুমি ছুঁয়ে দিলে মন/আমি বাঁচব আজীবন’ গানের জন্য এই পুরস্কার এবার তাঁর গলায়।
মঞ্চে দাঁড়িয়ে সংগীতশিল্পী শাকিলা তাঁর নাম যখন ঘোষণা করছেন, কিন্তু এখানে তো আগে থেকেই উপস্থিত তাহসান। তাঁর হাতে পুরস্কার তুলে দিতে চাইলেন শাকিলা। তাহসান তখনো বলছেন, ‘আমি তাহসান নই, জেমস বন্ড’। তাই মঞ্চ থেকে নেমে আবার উঠলেন। এরপর পুরস্কার হাতে নিয়ে জানালেন প্রতিক্রিয়া: ‘দু বছর আগে ফেসবুকে লিখেছিলাম, চলচ্চিত্রে গান করতে চাই। তখন অনেকেই বলেছিলেন, এখানে গান করো না, পচে যাবে।—আমি পচে গেছি।’
‘পচে গেছি’ কথাটি বলছেন তাহসান, আর পুরস্কারটি তুলে ধরেছেন উচ্চে, দর্শকের দিকে।
এবং ‘মঞ্চকম্প’
গান, নাচ, কথা আর হাস্যরসে টইটম্বুর ছিল ‘মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কার ২০১৫’-এর আয়োজন। সে আয়োজনে তারার আলোর ঝলকানিতে ‘ভূমিকম্প’ না হলেও মঞ্চ কেঁপেছিল বটে।