স্ত্রীই আমার জীবনের আদর্শ: আয়ুষ্মান খুরানা

আয়ুষ্মান খুরানা
আয়ুষ্মান খুরানা

নায়ক মানে হয় মারমার কাটকাট অ্যাকশন অথবা প্রেমে গদগদ। যে তার সুন্দরী প্রেমিকার জন্য সব করতে পারে। নায়ক মানে ‘সিক্স প্যাক’ শরীর আর নাচ–গানে দারুণ পারদর্শী। নায়ক মানে এক ঘুষিতে কুপোকাত গুন্ডারা। নায়ক বলতে যদি আপনার কল্পনায় এ রকমই কিছু ভেসে ওঠে, তাহলে আয়ুষ্মান খুরানা আপনার নায়ক নন। তিনি এমনই এক নায়ক, যিনি সাধারণ মানুষের মতো হয়েও অসাধারণ।

আয়ুষ্মান খুরানার বলিউডে আগমনই যেন নায়কের তথাকথিত নির্মাণ ভেঙে নতুন করে গড়ার জন্য। তিনি এমন এক নায়ক, যিনি প্রথম ছবিতেই স্পার্ম ডোনেট করেন। এর ফলে ৫৩ জন নারী পান সন্তান ধারণের অপার্থিব অনুভূতি। কিংবা বড় পর্দার এমন এক প্রেমিক, যে ‘লার্জার দ্যান লাইফ’ তো দূরে থাক, বরং নপুংসক! একরকম নীরবে-নিভৃতে বলিউডকে তিনি একের পর এক উপহার দিয়েছেন ‘দম লাগাকে হাইশা’, ‘শুভ মঙ্গল সাবধান’, ‘বাধাই হো’, ‘আন্ধাধুন’, ‘মেরি পেয়ারি বিন্দু’ এবং সর্বশেষ ‘আর্টিকেল ফিফটিন’–এর মতো ভিন্ন স্বাদের সব ছবি। প্রতিটি ছবিই প্রথা ভাঙার ছবি।

মার্কিন কবি রবার্ট ফ্রস্ট যেমনটা বলেছিলেন, আজ থেকে শত বছরেরও আগে, ১৯১৬ সালে, ‘দ্য রোড নট টেকেন’ কবিতায়। ‘দুটো পথ যেন আলাদা হয়ে গিয়েছিল আর আমি, আমি নিয়েছিলাম জনবিরল পথটা। আর সেটাই বদলে দিয়েছিল সবকিছু।’ এই কথাগুলো আয়ুষ্মান খুরানার জন্য খুব বেশি সত্যি। তথাকথিত নায়কেরা যা করেছেন, তিনি একেবারেই সেই পথে হাঁটেননি। পথিক হয়ে নিজেই নিজের পথ সৃষ্টি করে চলেছেন মাইলের পর মাইল। আর সেই পথচলায় তিনি যে সফল, তা আর শব্দ খরচ করে বলে দেওয়ার দরকার পড়ে না!

সম্প্রতি ফিল্মফেয়ারকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে নিজের ক্যারিয়ার, ব্যক্তিগত জীবন—সবকিছু নিয়ে কথা বললেন।

বোকাসোকা এবং আটপৌরে সব চরিত্র থেকে বুদ্ধিমান, ক্ষমতাবান পুলিশের চরিত্রে অভিনয়ের অভিজ্ঞতা কেমন?
পুলিশের পোশাক পরার সঙ্গে সঙ্গে শরীরে একটা আত্মবিশ্বাস এসে ভর করে। একটা দায়িত্ববোধের জন্ম নেয়। সেটা চরিত্রের সঙ্গে ন্যায়বিচার করতে খুবই সাহায্য করেছে। আমি আগের সব চরিত্রে পরিস্থিতির শিকার ছিলাম। এখানে আমাকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে পাঠানো হয়েছে।

আয়ুষ্মান খুরানা
আয়ুষ্মান খুরানা


হিন্দি ছবিতে যে ধরনের পুলিশ দেখা যায়, আপনার চরিত্র তাদের থেকে ভিন্ন ছিল।
‘আর্টিকেল ফিফটিন’ এমন একটা ছবি, যেটা সমস্ত বৈষম্যের বিরুদ্ধে কথা বলে। সেই ছবির প্রধান যোদ্ধা হিসেবে আমি আমার ভূমিকা পালন করেছি। ‘মুলক’ ছবিতে যেখানে হিন্দু-মুসলমান সংঘাতের মতো স্পর্শকাতর একটি বিষয় উঠে এসেছে, এখানে হিন্দুধর্মের বর্ণপ্রথার সমালোচনা করা হয়েছে। আমি একেবারেই সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে এই চরিত্র করেছি। মানুষকে তার নিজের ভালোর জন্য, সমাজ ও দেশের ভালোর জন্য ছবিটা দেখতে হবে।

অনুভব সিনহার (‘মুলক’ ও ‘আর্টিকেল ফিফটিন’ ছবির পরিচালক) সঙ্গে কাজের অভিজ্ঞতা কেমন?
আমি খুবই আনন্দিত যে একজন পরিচালক হিসেবে তিনি সমাজের প্রতি তাঁর দায়বদ্ধতা থেকে কাজ করে যাচ্ছেন। সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ার হিসেবে চলচ্চিত্রকে বেছে নিয়েছেন। তিনি আমাদের সমাজের ধর্মীয় জটিলতাগুলো ভালো বোঝেন। তাই সামাজিক সমস্যা নিয়ে এত বড় বাজেটের ছবি বানিয়েও সফল তিনি।

‘দম লাগাকে হাইশা’র পোস্টারে আয়ুষ্মান খুরানা
‘দম লাগাকে হাইশা’র পোস্টারে আয়ুষ্মান খুরানা


যখন এ রকম সামাজিক সমস্যা ও বাস্তবতা নিয়ে ছবি করেন, তখন এই ছবি বক্স অফিসে মুখ থুবড়ে পড়বে, এমন আশঙ্কা কাজ করে?
আমি এমন সব চরিত্র করে বক্স অফিসে সফল হয়েছি, যেগুলো আগে কেউ কখনো করেনি। বড় পর্দার একজন নায়ক যে ‘এ রকম’ হতে পারে, এটা আগে কারও ভাবনায় আসেনি। কিন্তু প্রতিবারই আমার শঙ্কা ছিল, যদিও প্রতিবারই আমি উতরে গেছি। তবে সত্যি এটাই যে ‘আর্টিকেল ফিফটিন’–এর ক্ষেত্রে আমি বক্স অফিসের কথা ভাবিনি। আমি শুধু ভেবেছি, এই গল্পটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং এটি মানুষের কাছে পৌঁছানো উচিত।

আন্ধাধুনের ক্ষেত্রে কী ভেবেছিলেন?
শঙ্কা ছিল। তবে এতটা ভালো করবে এটা ভাবিনি। এই ছবি প্রায় ৫০০ কোটি রুপির ব্যবসা করবে, এটা শুধু আমি কেন, সবার জন্যই অকল্পনীয়। অকল্পনীয় এবং মধুর সত্যি। এই ছবি আমাদের পুরো দলের জন্য একটা বড় বিজয়।

‘আন্ধাধুন’ ছবিতে আয়ুষ্মান ও টাবু
‘আন্ধাধুন’ ছবিতে আয়ুষ্মান ও টাবু


‘আন্ধাধুন’–এর জন্য ফিল্মফেয়ারের ‘কালো নারী (সম্মাননা পদক)’ হাতে এসে ধরা দেবে, ভেবেছিলেন?
আমার কেন যেন এ রকম একটা অনুভব হচ্ছিল। এটা আমার ভেতর থেকে কেউ একজন বলছিল, যে আমি পাব। তাই আমি বাবাকে সঙ্গে নিয়ে এসেছিলাম। যখন সমালোচকদের রায়ে সেরা অভিনেতার ফিল্মফেয়ার নিয়ে আর বাবাকে নিয়ে ফিরছিলাম, তখন দেখি বাবা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। স্বপ্ন সত্যি হওয়ার কান্না। সেই কান্না আমার আমার জীবনের সবচেয়ে বড় পাওয়া। এর আগে প্রথম ছবি ‘ভিকি ডোনার’–এর জন্য দুটো ফিল্মফেয়ার পেয়েছিলাম। সেরা নবাগত অভিনেতার ক্যাটাগরিতে ও ‘পানি দা’ গানের জন্য সেরা প্লেব্যাক শিল্পী বিভাগে।

আপনি বাবার বেশি কাছের?
দুজনেরই। আমার বাবা একজন জ্যোতিষী। সে আমার সমস্ত পারফরমেন্সের সেরা সমালোচক। সে আমাকে ছোটবেলা থেকেই দর্শকদের পার্লস ধরা শিখিয়েছে। ছোটবেলায় যখন আমাকে নাচতে বলা হতো, তখন বাবা বলত, যদি কিছু মানুষ চায়, তো দরকার নেই। যদি অনেকে চায়, তাহলে নাচো। সেই থেকে মানুষ কী চায়, সেটিকেই আমি সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছি।

শেষ সিনেমার সাফল্যের সঙ্গে মানিয়ে চলার জন্য কি চাপ অনুভব করেন?
যদি চাপ থাকেও, আমি সেটাকে খুবই ইতিবাচকভাবে দেখি। আমার থেকে মানুষের চাওয়া বাড়ছে। আমি শুধু এটুকু বলতে পারি, আমার ছবিতে ভিন্নতা, বার্তা এবং বিনোদন—এই তিনটাই উপস্থিত থাকবে।

স্ত্রী তাহিরা কাশ্যপের সঙ্গে আয়ুষ্মান
স্ত্রী তাহিরা কাশ্যপের সঙ্গে আয়ুষ্মান


ভিকি কৌশল, কার্তিক আরিয়ানরা আসছেন। প্রতিযোগিতা কি বাড়ছে?
হ্যাঁ, প্রতিদিন প্রতিযোগিতা বাড়ছে। আর এটা খুবই ইতিবাচক। নতুন নতুন প্রতিভা আর দুর্দান্ত সব ছবি আসছে। সেই সঙ্গে নিজেকে প্রতিনিয়ত এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে আর নিজের সেরা খেলাটা দেখাতে হবে। আমি এমন সব চরিত্র করি, যেগুলো অন্য সবাই ‘না’ করে। ‘আন্ধাধুন’ অনেক ঘুরে পরে আমার কাছে এসেছিল। ভাগ্যিস, অন্যরা ‘না’ বলেছিল।

আপনার স্ত্রী তাহিরা ক্যানসারকে জয় করে ফিরলেন। আপনি তাঁর থেকে কী শিখেছেন?
আমি তাঁর কাছ থেকে শিখেছি কখনো হার না মানতে। আমদের চিন্তাচেতনায় অনেক মিল। শারীরিক, ব্যক্তিগত ও পেশাগত জীবনের সব ক্ষেত্রে আমরা শান্তভাবে শক্ত করে এককজন আরেকজনের হাত ধরে থাকি।

আয়ুষ্মান খুরানা
আয়ুষ্মান খুরানা


তিনি কি আপনার আদর্শ?
অবশ্যই। স্ত্রীই আমার জীবনের আদর্শ। ও আমাকে সবচেয়ে বেশি অনুপ্রাণিত করে। সে যেভাবে পরিস্থিতির মোকাবিলা করে, তা দেখার মতো। অনেক সময় ভেঙে পড়াই সহজ, স্বাভাবিক। কিন্তু ও কখনোই হাল ছাড়ে না। তাকে যখন একটার পর একটা কেমোথেরাপি দেওয়া হচ্ছিল, তখনো আমি তাকে প্রাণখুলে হাসতে দেখেছি। অস্ত্রোপচারেরগুলো কঠিন ছিল। কিন্তু আমি কাছ থেকে দেখেছি, তাহিরা খুবই সাহসিকতার সঙ্গে সেগুলোর মোকাবিলা করেছে।

তিনি তাঁর প্রথম ছবি ‘টফি’ পরিচালনা করতে যাচ্ছেন, আপনি খুশি?
অবশ্যই। কবে কাজ শুরু হবে, আমি শুধু দিন গুনছি।