‘রাইফেল ক্লাব’, যেখানে সবাই শিকারি

‘রাইফেল ক্লাব’–এর পোস্টার। আইএমডিবি

গত কয়েক বছরে মালয়ালম সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি পরিচিতি পেয়েছে দুর্দান্ত সব থ্রিলার বানিয়ে। নানা ধরনের সামাজিক বার্তা দিয়ে সিরিয়াস ছবি বানাতেও সিদ্ধহস্ত তারা। পুরোপুরি বিনোদননির্ভর, হলে দর্শকেরা সিটি দেবেন; এমন সিনেমা খুব একটা দেখা যায় না মালয়ালম ইন্ডাস্ট্রিতে। তাই ‘রাইফেল ক্লাব’ মালয়ালম সিনেমায় নতুন ধরনের সংযোজন বললেও ভুল হবে না। মাত্র ১২০ মিনিটের ছবিটি মুক্তির পর থেকেই দর্শক, সমালোচকদের প্রশংসা পাচ্ছে। ওটিটিতে মুক্তির পর অনেক বাংলাদেশি দর্শকও মজেছেন ‘রাইফেল ক্লাব’-এ। কী  আছে এ ছবিতে?

গল্প কী নিয়ে
অস্ত্র ব্যবসায়ী দয়ানন্দ (অনুরাগ কশ্যপ) ছোট ছেলে বিচ্চুর জন্মদিনে পার্টি দেয়। পার্টিতে এক মেয়ের সঙ্গে আপত্তিকর আচরণ করতে গেলে তার প্রেমিক বাধা দেয়। ধস্তাধস্তিতে বিচ্চু ২০ তলা থেকে পড়ে গিয়ে মারা যায়। ওই প্রেমিক জুটি পালিয়ে আশ্রয় নিতে চায় সিনেমার নায়ক শাহজাহান খানের কাছে। শাহজাহান তখন নিজের বাড়িতে নেই। নতুন ছবিতে তাকে শিকারির ভূমিকায় দেখা যাবে। হাতে–কলমে শিকারের শিক্ষা নিতে সে তখন ওয়েনাদের রাইফেল ক্লাবে। ব্রিটিশ আমলের এই ক্লাবের ছেলে-বুড়ে সবাই শিকারি, অস্ত্র চালনায় সিদ্ধহস্ত।

‘রাইফেল ক্লাব’–এর দৃশ্য। আইএমডিবি
একনজরে
সিনেমা: ‘রাইফেল ক্লাব’
পরিচালক: আশিক আবু
ধরন: অ্যাকশন, ড্রামা
অভিনয়: বিজয়রাঘবন, বাণী বিশ্বনাথ, বিনীত কুমার, সুরেশ কৃষ্ণ, দর্শনা রাজেন্দ্রন, অনুরাগ কশ্যপ ও দিলেশ পোথান
স্ট্রিমিং: নেটফ্লিক্স
দৈর্ঘ্য: ১২০ মিনিট

দিনদুপুরে সে বাড়িতে হাজির হলে আপনার পিলে চমকে উঠতে পারে। কারণ, তখন হয়তো বাড়ির আঙিনায় কেউ টার্গেট প্র্যাকটিস করছে! একের পর এক আসছে গুলির আওয়াজ। দয়ানন্দের অস্ত্রের কারবার। ওই প্রেমিক জুটি ভালো করেই জানে, ছেলের মৃত্যুর বদলা সে নেবই। তাই ওই জুটি মরিয়া হয়ে রাইফেল ক্লাবে হাজির হয়ে শাহজাহানের কাছে আশ্রয় চায়। এদিকে গন্ধ শুঁকে শুঁকে রাইফেল ক্লাবে ঠিকই হাজির হয় দয়ানন্দের বড় ছেলে বীরা। পরে আসে দয়ানন্দও। তারা কী পারবে ওই প্রেমিক জুটিকে ধরতে, নাকি রাইফেল ক্লাব থেকে তাদের জীবন নিয়ে ফেরাই কঠিন হবে?

দুর্দান্ত অ্যাকশন, হাস্যরস আর সংলাপ
আপনি শারীরিক বা মানসিকভাবে ক্লান্ত? খুব সিরিয়াস কিছু দেখতে মন সায় দিচ্ছে না, আবার প্রচলিত বাণিজ্যিক সিনেমাও টানছে না। চান এমন কিছু, যেখানে বিনোদনের সব উপাদান যেমন মজুত থাকবে, তেমনি আবার শিল্পমানও থাকবে; তবে আশিক আবুর ‘রাইফেল ক্লাব’ আপনারই জন্য। মাত্র ঘণ্টা দুয়েকের ছবিটি বলা যায় আপনাকে স্টাইলিশ এক অ্যাকশন সিনেমার অভিজ্ঞতা দেবে। সিনেমার পটভূমি ১৯৯১ সাল।

‘রাইফেল ক্লাব’–এর দৃশ্য। আইএমডিবি

সেই সময়ের জঙ্গল, শিকারের পরিপ্রেক্ষিতে মুচমুচে এক অ্যাকশন সিনেমা বানিয়েছেন আশিক আবু। সিনেমার সবচেয়ে ইতিবাচক দিক, গল্প বলা। যদিও গল্প বলতে তেমন কিছু নেই, শেষে কী হতে যাচ্ছে, তা–ও আপনার জানা; তবু নির্মাতার বুদ্ধিমত্তার জন্যই পর্দায় চোখ আটকে থাকে। দুর্দান্ত কিছু দৃশ্য, অসাধারণ অভিনয় আর ক্ষুরধার সংলাপ ছবির বড় সম্পদ। ছবিটি নির্মাণের সঙ্গে চিত্রগ্রহণের দায়িত্বও সামলেছেন আশিক; তাই শিকার আর শিকারির গল্পে পশ্চিম ঘাটের জঙ্গলকে আলাদা চরিত্র হিসেবে হাজির করার কৃতিত্বও তারই পাওনা।

বিজয়রাঘবন, বাণী বিশ্বনাথ, বিনীত কুমার, সুরেশ কৃষ্ণ, দর্শনা রাজেন্দ্রনসহ তুখোড় সব মালয়ালম অভিনেতাকে হাজির করেছেন নির্মাতা। কারও খুব বেশি দৃশ্য নেই, তেমন সংলাপও নেই; তবু যে যখন হাজির হয়েছেন, নিজের জাত চিনিয়েছেন।

‘রাইফেল ক্লাব’–এর পোস্টার। আইএমডিবি

ছবির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুই চরিত্রে দেখা গেছে মালয়ালম আর বলিউডের আলোচিত দুই নির্মাতা অনুরাগ কশ্যপ আর দিলেশ পোথানকে। দুজনেই দয়ানন্দ আর আভরণ চরিত্রে মনে রাখার মতো অভিনয় করেছেন। অনুরাগ কশ্যপকে নির্মাতা ডেভিড ধাওয়ান বেশি বেশি অভিনয় করার কথা বলেছিলেন। হিন্দি সিনেমার এই নির্মাতার ভাষ্যে, অনুরাগ অভিনয় করলে ছবি হিট হয়, সবারই কোপালা খুলে, লাভ হয়। কিন্তু তিনি বানালে আখেরে সবাই লস। ডেভিড কথাটা মজা করে বললেও, এ ছবির ক্ষেত্রে ঠিকই ফলে গেছে। গত ১৯ ডিসেম্বর প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পেয়েছিল মাত্র ১০ কোটি রুপি বাজেটের ছবিটি। ওটিটিতে আসার আগে ৩০ কোটি রুপির ব্যবসা করেছে! অনুরাগ জানিয়েছিলেন, এ ছবিতে তিনি সুযোগ পেয়েছেন ঘটনাচক্রে। নির্মাতা আশিক আবু ইনস্টাগ্রামে এ ছবির নাম ঘোষণা করেন। তখন মন্তব্যের ঘরে, অনুরাগ লিখেছিলেন তিনি অভিনয় করতে চান। শুনতে কিছুটা অদ্ভুত হলেও, এভাবেই ‘রাইফেল ক্লাব’-এ সুযোগ পেয়েছিলেন তিনি।

এ ছবিতে দারুণ কিছু দৃশ্য আছে, কয়েকটি ডার্ক হিউমারের ব্যবহারও দুর্দান্ত। দয়ানন্দের বড় ছেলে বীরা যখন রাইফেল ক্লাবে ঢুকতে যাবে, তখন বাড়ির এক মেয়ের সামনে পড়ে। বীরা জানতে চায়, বাড়িতে পুরুষ কে আছে? মেয়েটি তখন হাতে থাকা রিভলবার দেখিয়ে বুঝিয়ে দেয়, এ বাড়িতে লিঙ্গ নয়, মর্যাদা নির্ধারণ করে কে কেমন বন্দুক চালাতে পারে সেটাই। সিনেমার গুরুত্বপূর্ণ অ্যাকশন দৃশ্যে, আভরণ জানায়, সে বাবা হতে চলেছে। যেভাবে দৃশ্যটি তুলে ধরেছেন নির্মাতা, সেটাও ছিল দেখার মতো।
‘রাইফেল ক্লাব’-এ দারুণ কিছু সংলাপও আছে। ‘সব লোক শুধু খাবারই চায়, কিন্তু কম লোকই আছে যারা শিকার করতে চায়’, ‘বন্দুকের কোনো মালিক হয় না, কেবল উত্তরসূরি হয়’, ‘এটা ওয়েস্ট সিনেমায় নয়, ওয়েস্টার্ন ঘাট’ ছবির এমন সংলাপ শেষ হওয়ার পরও মনে থাকে।

‘রাইফেল ক্লাব’–এর দৃশ্য। আইএমডিবি

কেবলই টাইম পাস?
নিছক বিনোদনের জন্য ছবিটি আপনি দেখতে পারেন, চাইলে ছবির মধ্যে থাকা নির্মাতার বার্তাও নিতে পারেন। ১৯৯১ সালের পটভূমির সিনেমা, ঠিক সে সময়ই যুক্তরাষ্ট্র উপসাগরীয় দেশগুলোতে নিজের আধিপত্য বিস্তার করছে। ছবির একটি দৃশ্যে দয়ানন্দ যখন যুক্তরাষ্ট্রের পতাকা অঙ্কিত হাফপ্যান্ট পরে হাজির হয়, সেটা কি যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্যে বিস্তারের ইঙ্গিত?

আরও পড়ুন

শেষ কথা
আশিক আবু মালয়ালম তো বটেই, পুরো ভারতেরই অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নির্মাতা। তাঁর মতো বৈচিত্র্যময় বিষয় নিয়েও কম পরিচালকই কাজ করেছেন। তাঁর ‘২২ ফিমেল কোট্টায়াম’, ‘মায়ানদী’, ‘ভাইরাস’ দেখা দর্শকমাত্রই তা জানেন। এবার অ্যাকশন ড্রামা নিয়ে হাজির হয়েছেন তিনি, ভালোভাবেই যে উতরে গেছেন, সেটা বলাই বাহুল্য।