বক্স অফিসে বারবার ব্যর্থ, কী বললেন নির্মাতা
সুজিত সরকারের ছবির চরিত্র মানেই এক টুকরো জীবন। মূলধারার বলিউডে এক ভিন্ন ঘরানা তৈরি করেছেন তিনি। তিনবার ভারতের জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত সুজিত ভারতীয় সিনেমার অন্যতম সৃজনশীল পরিচালক। ভারতের গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক মহলেও তিনি দারুণ সমাদৃত। তাঁর কাজের বিশেষত্ব হলো তাঁর গল্প বলার ভঙ্গি, যেখানে বিগ বাজেটের অলীক গল্প নয়, বরং ছোট ছোট মুহূর্তই ছবির কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে।
তাঁর সিনেমায় যেমন থাকে জীবনের ক্ষুদ্র অথচ গভীর মুহূর্ত, তেমনি দেখা যায় সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতার তীক্ষ্ণ প্রতিফলন। ‘ভিকি ডোনার’ (২০১২), ‘পিকু’ (২০১৫) ‘কিংবা অক্টোবর’ (২০১৮)-এ তিনি সাধারণ মানুষ আর তাদের অদ্ভুত বৈশিষ্ট্যকে এমনভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন, যা একই সঙ্গে দর্শককে হাসায়; আবার আবেগ তাড়িত করে। আবার ‘ইয়াহা’ (২০০৫), ‘মাদ্রাজ ক্যাফে’ (২০১৩) ও ‘সর্দার উধাম’ (২০২১)-এ তাঁর রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গি ভারতীয় সিনেমায় নতুন মাত্রা যোগ করেছে। সম্প্রতি ভারতীয় ‘দ্য নিউ ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস’কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সুজিত তাঁর সিনেমা নির্মাণের অভিজ্ঞতা, ব্যর্থতা, সমালোচনা ও প্রেরণা নিয়ে কথা বলেছেন।
‘অভিজ্ঞতা থেকেই গল্প আসে’
সুজিত সরকার বলেন, তাঁর কাছে সব গল্পই আসে অভিজ্ঞতাকে রূপান্তরিত করার গভীর জায়গা থেকে। তিনি বলেন, ‘কিছু মুহূর্ত থেকে যায় আর মনের মধ্যে নানা ছবি তৈরি হতে থাকে। শেষ পর্যন্ত সেগুলো কোনো না কোনোভাবে বেরিয়ে আসে। কেউ লেখে, কেউ বলে, কেউ নাটক করে। আমি সিনেমা বানাই।’ তাঁর সিনেমাগুলো এভাবেই জন্ম নেয়। যেমন জালিয়ানওয়ালাবাগ সফর তাঁকে শীতল করে দিয়েছিল—সেই প্রভাব বহু বছর ধরে রয়ে গিয়েছিল, যা পরে একটি ছবির আকার নেয়। ভারতের পাঞ্জাবের অমৃতসরের জালিয়ানওয়ালাবাগ ১৯১৯ সালে ঘটে যায় এক নির্মম হত্যাকাণ্ড।
ব্রিটিশ শাসনের সময় বেসামরিক মানুষদের বিক্ষোভ দমন করতে গিয়ে ব্রিটিশ সেনারা নির্বিচার গুলি চালায়। এতে শত শত নিরপরাধ লোক নিহত হন এবং বহু মানুষ আহত হন। এই ঘটনা ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে এক গভীর শোকাবহ অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত। এই ঘটনা নিয়ে তৈরি হয়েছে অনেক সিনেমা ও সিরিজ। সুজিত জালিয়ানওয়ালাবাগের এই ইতিহাসে গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। সেই অভিজ্ঞতা পরে তার চলচ্চিত্র সর্দার উধাম (২০২১)-এর রূপ নেয়। এ সিনেমা তিনি পরিচালনা ও প্রযোজনা করেছেন এবং সিনেমাটি পাঁচটি ভিন্ন ভিন্ন বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করে।
আবার ‘অক্টোবর’ মূলত তাঁর মায়ের গল্প। মৃত্যুর আগে সুজিতের মা দীর্ঘদিন দিল্লির এক হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। সুজিত গিয়ে বসে থাকতেন। সেই ঘটনার ছাপ এতটাই গভীর যে অনেক বছর পরও নির্মাতাকে ছেড়ে যায়নি। সেটাই পর্দায় তুলে এনেছেন তিনি।
তবে তিনি নিজেও জানেন না কখন এবং কীভাবে মাথায় কোনো আইডিয়া জন্ম নেয়। তিনি বলেন, ‘আমি কোনো দিন ভাবিনি যে আমি চলচ্চিত্র পরিচালক হব। গল্পগুলো যেন আমার কাছে চলে আসে আর আমি সেগুলো বানিয়ে ফেলি। আমি “কি”, “কেন” বা “কীভাবে” এসব নিয়ে খুব একটা ভাবি না।’
‘আই ওয়ান্ট টু টক’-এর ভয়াবহ ব্যর্থতা
সুজিত সরকারের সর্বশেষ ছবি ‘আই ওয়ান্ট টু টক’ (২০২৪) এক অদ্ভুত চরিত্রের গল্প বলে—এক চনমনে মানুষ, যিনি ক্যানসারে আক্রান্ত। তবে একাধিক অস্ত্রোপচারের মধ্য দিয়েও তাঁর স্নেহমিশ্রিত বিরক্তি ভরা আচরণ বজায় রাখেন। তবে এই ছবিটি আগেরগুলোর মতো সাফল্য পায়নি। দর্শকের মিশ্র প্রতিক্রিয়ার ফলে ছবিটি বক্স অফিসে চরম ব্যর্থ হয়। কেবল এ সিনেমাই নয় আগে তাঁর ‘অক্টোবর’ও ফ্লপ হয়েছিল।
এ প্রসঙ্গে সুজিত বলেন, ‘যখন কোনো ছবি বক্স অফিসে ভীষণ খারাপ করে, তখন সেটা আপনাকে প্রভাবিত করে। আমি হতবাক হয়েছিলাম ছবিটি ভালো না চলায়।’
তাঁর মতে, ‘আই ওয়ান্ট টু টক’ হলো ‘ব্যঙ্গাত্মক’ ও ‘হাস্যরসাত্মক’ ছবি, যেখানে একজন মানুষ বাঁচতে চায়। কিন্তু দর্শকের প্রতিক্রিয়া দেখে তিনি বুঝলেন, দর্শকেরা হয়তো ক্যানসার-জয়ী চরিত্রের গল্প দেখতে প্রস্তুত ছিল না। ‘সম্ভবত তারা সেই মানসিক অবস্থায় ছিলে না,’ বলেন তিনি। যদিও ছবিটি সমালোচকদের কাছ থেকে কিছু প্রশংসা পেয়েছিল, বিশেষ করে অভিষেক বচ্চনের অভিনয়ের জন্য।
সমালোচনা নিয়ে ভাবনা
বক্স অফিসে ব্যর্থ হলেও সুজিত সরকারের বেশির ভাগ সিনেমাই সমালোচকদের কাছে প্রশংসিত। সমালোচনার সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক কেমন? তিনি জবাব দেন, ‘আমি কিছু সমালোচনা দেখি এবং সেখান থেকে শিখি। তবে প্রতিটি রিভিউ বা সমালোচনাকে আমি গুরুত্ব দিই না। সমালোচকের বাইরে, আমি দর্শকের কথাও শুনতে ভালোবাসি।’
মেলবোর্নে জুরি হিসেবে অভিজ্ঞতা
সম্প্রতি মেলবোর্ন ইন্ডিয়ান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে শর্ট ফিল্ম প্রতিযোগিতার জুরি সদস্য ছিলেন সুজিত। তরুণ চলচ্চিত্র নির্মাতাদের ছবি দেখা তিনি ‘চমৎকার’ অভিজ্ঞতা বলে বর্ণনা করেন। সুজিত বলেন, ‘ভারত ও অস্ট্রেলিয়ার নির্মাতাদের ছবিগুলোতে কোথাও না কোথাও একই ধরনের সামাজিক ইস্যু উঠে আসছিল, যদিও চরিত্র আর পরিবেশ ছিল আলাদা।’ এটি ছিল তাঁর দ্বিতীয়বার মেলবোর্ন ইন্ডিয়ান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের জুরি হওয়া। তাঁর মতে, ‘মেলবোর্ন ইন্ডিয়ান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে আসা মানে যেন পিকনিকে যাওয়া। এখানে সিনেমার এক উৎসবমুখর আবহ, আলোচনা, প্রদর্শনী—সব মিলে অভিজ্ঞতাকে দারুণ করে তোলে।’
সুজিত আরও জানান, তিনি ‘মাই মেলবোর্ন’ সংকলন ছবির দ্বিতীয় পর্বে একটি শর্ট ফিল্ম নির্মাণ করবেন। রাজকুমার হিরানি, অঞ্জলি মেনন ও ওনীরও এই সংকলনে থাকছেন। ছবির মূল বিষয়—ভারত ও অস্ট্রেলিয়ার সাংস্কৃতিক সম্পর্ক।
গুরু দত্ত ও ঋত্বিক ঘটকের ছায়া
এবার মেলবোর্ন ইন্ডিয়ান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে গুরু দত্তের জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে ‘পিয়াসা’ (১৯৫৭) ও ‘কাগজ কে ফুল’ (১৯৫৯) প্রদর্শিত হয়। সুজিত স্বীকার করেন, প্রথমবার গুরু দত্তের ছবি দেখে তিনি গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। তাঁর মতে, গুরু দত্তের সিনেমা অনেকটাই ঋত্বিক ঘটকের ছবির মতো।
‘দুজনের জীবনদৃষ্টিতে একধরনের মিল আছে। দুজনেই মদ্যপানের সমস্যায় ভুগেছিলেন, ব্যক্তিগত আঘাতও ছিল প্রবল, আর সেটা তাঁদের ছবিতে প্রতিফলিত হয়েছে। যখন আপনি বৌদ্ধিক স্তরে পৌঁছান, তখন সমাজকে দেখার ভঙ্গি আপনাকে কষ্ট দিতে শুরু করে। একভাবে তাঁরা নিজেদের সম্পূর্ণভাবে সিনেমার জন্য উৎসর্গ করেছিলেন। তাঁদের থেকে শেখার এখনো অনেক কিছু বাকি।’ বলেন সুজিত।
এই নির্মাতা প্রতিবারই যখন ‘পিয়াসা’ দেখেন, নতুন কিছু খুঁজে পান। এরপর একটা আক্ষেপও চেপে বসে। ‘প্রতিবারই মনে হয়, আমরা কেন আর এ ধরনের ছবি তৈরি করছি না? কেন আমরা গুরু দত্তের কাছ থেকে শিক্ষা নিচ্ছি না; তাঁর উত্তরাধিকারকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি না?’ বলেন তিনি।
পরের কাজ
সুজিত এক ব্যস্ত তাঁর নতুন সিনেমা ‘এক জাদুকর’ নিয়ে। এতে প্রধান চরিত্রে আছেন ভিকি কৌশল। কিছুদিন আগে ছবিটির প্রথম পোস্টার প্রকাশের পরই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শুরু হয়েছিল আলোচনা কারণ পোস্টারে দেখা গেছে একেবারে নতুন ভিকিকে—সবুজ ঝলমলে পোশাক, রহস্যময় দৃষ্টি আর ভরপুর জাদুকরি আবহ।
এবার যে তিনি জাদুকরের ভূমিকায়, তার ইঙ্গিত মিলছে এই প্রথম লুকেই। সাম্প্রতিক সময়ের গম্ভীর চরিত্রগুলো থেকে বেরিয়ে একেবারে ভিন্ন এক ভূমিকায় দেখা যেতে চলেছে তাঁকে।