‘ধুরন্ধর’ নিয়ে ধুন্ধুমার, কেন এত বিতর্ক এই সিনেমা নিয়ে

‘ধুরন্ধর’ সিনেমার বিভিন্ন দৃশ্য। কোলাজ

৫ ডিসেম্বর মুক্তির পর থেকেই বক্স অফিসে ঝড় তুলেছে আদিত্য ধরের সিনেমা ‘ধুরন্ধর’। দিন যত গেছে, আয় বেড়েছে রাজনৈতিক ড্রামা ও স্পাই-থ্রিলার সিনেমাটির। আয়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে বিতর্কও। কেউ সিনেমার সঙ্গে খুঁজে পেয়েছেন বাস্তব চরিত্রের মিল। কোনো সমালোচকের আবার সিনেমাটি পছন্দ হয়নি। যাঁদের পছন্দ হয়নি, তাঁরা অন্তর্জালে প্রবল বিতর্কের সম্মুখীন হয়েছেন, এমনকি রিভিউ পর্যন্ত প্রত্যাহার করে নিতে হয়েছে! কিন্তু কী আছে এই সময়ের ব্যাপক আলোচিত সিনেমাটিতে?

মুক্তির মাত্র এক সপ্তাহের মাথায় আদিত্য ধর পরিচালিত এই অ্যাকশন-ড্রামা পেরিয়ে গেছে ২০০ কোটির মাইলফলক। আর এবার পরিচালক তাঁর প্রথম ছবি ‘উরি’র রেকর্ডের দিকেই তাকিয়ে আছেন, যার আয় ছিল ২৪৪ কোটি রুপি। বক্স অফিস–বিশ্লেষক সংস্থা স্যাকনিকের হিসাব অনুযায়ী, সাত দিনে ভারতেই ছবিটি সংগ্রহ করেছে ২০৭ কোটি রুপি।

গল্প কী নিয়ে
১৯৯৯ সালে কান্দাহারে একটি বিমান ছিনতাইয়ের ঘটনা দিয়ে সিনেমা শুরু হয়। কেবল এটিই হয় সিনেমায় আছে ভারতের পার্লামেন্ট ভবন ও মুম্বাই হামলাও। সব মিলিয়ে দেখানো হয়, পাকিস্তানের মদদে বিভিন্ন সন্ত্রাসী গোষ্ঠী ভারতে হামলা চালাচ্ছে। ভারতীয় সংস্থা র ঠিক করে, প্রচলিত ব্যবস্থায় এসব হামলা ঠেকানো যাবে না। সংস্থাটি নিজেদের চৌকস এজেন্ট হামজাকে (রণবীর সিং) পাকিস্তানের করাচির লিয়ারে শহরে পাঠায় সিস্টেমের ভেতরে ঢুকে সন্ত্রাসবাদ নির্মূল করতে। কিন্তু কাজটা সহজ নয়, একের পর এক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয় সে।

‘ধুরন্ধর’ সিনেমায় রণবীর সিং। এক্স থেকে

মোটাদাগে, এই হলো সিনেমার গল্প। সিনেমাটি টান টান রোমাঞ্চ, অ্যাকশন আর দুর্দান্ত অভিনয়ের জন্য প্রশংসিত হয়েছে। অনেক সমালোচকও মনে করেন, মূল ধারার বাণিজ্যিক সিনেমার আড়ালে ‘ধুরন্ধর’-এ যেভাবে ভূরাজনীতির বিভিন্ন বিষয় সবিস্তারে তুলে ধরা হয়েছে, সেটা তারিফ করার মতো।

সিনেমাটিতে রণবীর সিং ছাড়াও আছেন অক্ষয় খান্না, সঞ্জয় দত্ত, অর্জুন রাজপাল, সারা অর্জুন, আর মাধবন প্রমুখ।

কত আয় করল
মুক্তির মাত্র এক সপ্তাহের মাথায় আদিত্য ধর পরিচালিত এই অ্যাকশন-ড্রামা পেরিয়ে গেছে ২০০ কোটির মাইলফলক। আর এবার পরিচালক তাঁর প্রথম ছবি ‘উরি’র রেকর্ডের দিকেই তাকিয়ে আছেন, যার আয় ছিল ২৪৪ কোটি রুপি। বক্স অফিস–বিশ্লেষক সংস্থা স্যাকনিকের হিসাব অনুযায়ী, সাত দিনে ভারতেই ছবিটি সংগ্রহ করেছে ২০৭ কোটি রুপি।

অনেক পাকিস্তানি বিশ্লেষক ও দর্শক মনে করছেন, সিনেমায় চরিত্রগুলো অতিরঞ্জিত করে দেখানো হয়েছে। বলিউড সিনেমায় বরাবরই ভারতীয় আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের নায়কোচিতভাবে দেখানো হয়, এই সিনেমাতেও হয়তো সেটাই করা হয়েছে। পাকিস্তানি সংবাদমাধ্যমগুলো বলছে, করাচির গ্যাংস্টারের মধ্যে দ্বন্দ্ব ছিল একেবারেই স্থানীয় ঘটনা, যার মূল কারণ ছিল দারিদ্র্য, রাজনৈতিক উদাসীনতা ও সামাজিক-অর্থনৈতিক বৈষম্য।

এটি ইতিমধ্যে সঞ্জয় দত্তের ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ আয়কারী ছবি—প্রথম স্থানে রয়েছে ‘কেজিএফ চ্যাপ্টার ২’ (৪৩৫ কোটি রুপি)। শাহরুখ খানের ‘রা.ওয়ান’(১১৬ কোটি রুপি) বা ‘ওম শান্তি ওম’ (৭৮ কোটি রুপি)-তে নেতিবাচক চরিত্রে অভিনয় করেও অর্জুন রামপাল কখনো ২০০ কোটির কাছে পৌঁছাতে পারেননি। তবে অক্ষয় খান্নার চলতি বছর মুক্তি পাওয়া আরেকটি সিনেমা ‘ছাবা’ আয় করে ৬০০ কোটি রুপির বেশি।
রণবীর সিংয়ের ক্ষেত্রে ‘ধুরন্ধর’ এখন তাঁর তৃতীয় সর্বোচ্চ আয় করা ছবি।

‘ধুরন্ধর’–এর দৃশ্য। এক্স থেকে

সত্যিই কি বাস্তব চরিত্র অবলম্বনে
মুক্তির পর থেকেই আলোচনায় সিনেমায় রেহমান ডাকাত চরিত্রে অভিনয় করা অক্ষয় খান্না। সত্যিই কি ‘ধুরন্ধর’-এ কুখ্যাত পাকিস্তানি মাফিয়া রেহমান ডাকাতের চরিত্রে অভিনয় করছেন অক্ষয়? অনেকে তেমন দাবি করলেও ছবির নির্মাতাদের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয়নি। রেহমান ডাকাতের আসল নাম ছিল সর্দার আবদুল রেহমান বালুচ। খুব কম বয়সেই অপরাধজগতে হাতেখড়ি হয় রেহমানের। ধীরে ধীরে আন্ডারওয়ার্ল্ডের ‘বাদশা’ হয়ে উঠেছিলেন তিনি।

‘ধুরন্ধর’ সিনেমায় আর মাধবন। এক্স থেকে

মুক্তির পর অনেকেই দাবি করছেন রণবীর সিং অভিনীত ‘হামজা’ চরিত্রটি তৈরি হয়েছে ভারতীয় সেনা কর্মকর্তা মোহিত শর্মার আদলে। মুক্তির আগেই খবর ছড়ায়, পরিচালক আদিত্য ধরের এই ছবির গল্প নাকি প্রয়াত মেজর মোহিত শর্মার জীবনের সঙ্গে অনেকটাই মিল, অথচ তাঁকে যথাযথ কৃতিত্ব দেওয়া হয়নি, এ অভিযোগ তুলেছিলেন মেজর শর্মার মা। ২০০৪ সালে এক গোপন অভিযানে হিজবুল মুজাহিদীনের দলে ‘ইফতিখার ভাট’ নামে ছদ্মবেশে ঢুকে দুই জঙ্গিকে নির্মূল করেন—এই বীরত্বের জন্য তিনি পান সেনা মেডেল। মেজর শর্মার পরিবার নাকি দিল্লি হাইকোর্টে ছবির উপস্থাপন নিয়ে ব্যাখ্যা চেয়েছে। পরে ভারতের সার্টিফিকেশন বোর্ড ও পরিচালক জানান, ছবিটি তাঁর ওপর ভিত্তি করে তৈরি নয়।

পাকিস্তানেও বিতর্ক
অনেক পাকিস্তানি বিশ্লেষক ও দর্শক মনে করছেন, সিনেমায় চরিত্রগুলো অতিরঞ্জিত করে দেখানো হয়েছে। বলিউড সিনেমায় বরাবরই ভারতীয় আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের নায়কোচিতভাবে দেখানো হয়, এই সিনেমাতেও হয়তো সেটাই করা হয়েছে। পাকিস্তানি সংবাদমাধ্যমগুলো বলছে, করাচির গ্যাংস্টারের মধ্যে দ্বন্দ্ব ছিল একেবারেই স্থানীয় ঘটনা, যার মূল কারণ ছিল দারিদ্র্য, রাজনৈতিক উদাসীনতা ও সামাজিক-অর্থনৈতিক বৈষম্য।

‘ধুরন্ধর’ সিনেমায় অক্ষয় খান্না। এক্স থেকে

রেহমান ডাকাত লটারির অপরাধজগৎ নিয়ন্ত্রণ করতেন; আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল না। স্থানীয় পুলিশ কর্মকর্তা চৌধুরী আসলাম নিজের জীবন ঝুঁকিতে ফেলে এসব গ্যাং ভাঙার জন্য কাজ করেছিলেন। তিনি শহরে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনেছিলেন, পাশাপাশি সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়েছেন।
তিনি এ ঘটনাগুলোর কেন্দ্রীয় চরিত্র ছিলেন, কোনো বিদেশি নায়কের সহায়ক নয়, যা হয়তো এ সিনেমায় দেখানো হয়েছে।

সিনেমায় রেহমান ডাকাতকে এক বৃহৎ ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে দেখানো হয়েছে, যা আসলে বাস্তবতাবিবর্জিত। এ জন্য পাকিস্তানের সংবাদমাধ্যমগুলো দেশটির নির্মাতাদেরও দায়ী করেছেন। কারণ, তাঁরা কেবল পর্দায় রোমান্টিক ড্রামাই বানান, সত্যিকারের অপরাধের ঘটনাগুলো নিয়ে সিনেমা-সিরিজ বানান না।

সমালোচকদের ঘিরে বিতর্ক
‘ধুরন্ধর’-এ অতি জাতীয়তাবাদ, পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব দেখানো হয়েছে—এমন অনেক কারণে এটা পছন্দ করেননি কোনো কোনো সমালোচক। কিন্তু সিনেমাটিকে যাঁরা নেতিবাচক রেটিং দিয়েছেন, তাঁদের বিদ্রূপ ও কটাক্ষ করা হয়েছে অন্তর্জালে। কেবল তা–ই নয়, তাঁদের ব্যক্তিগত আক্রমণ করা হয়েছে। সেটা এতটাই যে প্রখ্যাত সমালোচক অনুপমা চোপড়া দ্য হলিউড রিপোর্টার ইন্ডিয়া থেকে তাঁর ‘ধুরন্ধর’-এর ভিডিও রিভিউ সরিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন।

‘ধুরন্ধর’ সিনেমায় রণবীর সিং। এক্স থেকে

অনুপমা চোপড়ার রিভিউয়ের সমালোচকদের মধ্যে ছিলেন অভিনেতা পরেশ রাওয়াল। অনুপমা চোপড়া নিজের রিভিউতে লিখেছিলেন, ‘পরিচালক বাস্তব ঘটনাগুলো যেমন কান্দাহার হাইজ্যাক, ২০০১ সালের পার্লামেন্ট হামলা ও ২৬/১১-এর মুম্বাই হামলার আসল রেকর্ডিং-ব্যবহার করেছেন গল্পে উত্তেজনা বাড়ানোর জন্য। তবে বাস্তব আর কল্পনার মিশ্রণ উভয়ই ঝুঁকিপূর্ণ এবং কিছুটা অগোছালো প্রমাণিত হয়েছে।’

সমালোচনার মুখে রিভিউ প্রত্যাহার করা হলেও অনুপমা এ বিষয়ে মন্তব্য করেননি। এভাবেই ট্রলের মুখে পড়েছেন সুচারিতা ত্যাগী, রাহুল দেশাইয়ের মতো পরিচিত সমালোচকও।

হৃতিক বিতর্ক
‘ধুরন্ধর’ নিয়ে বলতে গিয়ে নতুন করে বিতর্কের মুখে পড়েছেন অভিনেতা হৃতিক রোশন। ইনস্টাগ্রাম স্টোরিতে হৃতিক লিখেছেন, ‘আমি সিনেমা ভালোবাসি। আমি তাদের ভালোবাসি যারা গল্পের মধ্যে নিজেকে সঁপে দেয়, যা আপনাকে ঝাঁকুনি দেয়। “ধুরন্ধর” এমনই একটি উদাহরণ। গল্প বলার ধরন অসাধারণ। এটি সত্যিকারের সিনেমা।’

তবে হৃতিক বিতর্কে পড়েছেন পোস্টের অন্য অংশ নিয়ে। যেখানে তিনি লিখেছেন, ‘আমি হয়তো এর রাজনৈতিক দিকের সঙ্গে একমত নই, চলচ্চিত্রকার হিসেবে আমাদের এটা নিয়ে বিতর্ক করতে পারি।’ এর পরেই ব্যাপক ট্রলের মুখে পড়েছেন। অনেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এমনও লিখেছেন, ‘রাজনৈতিক বিষয়ের সঙ্গে একমত নন, তবে কি আপনি পাকিস্তানপন্থী?’ অনেকে আবার যশরাজের স্পাই ইউনিভার্সের সিনেমায় হৃতিকের অভিনয় প্রসঙ্গ তুলে ধরেছেন, যেখানে পাকিস্তানি এজেন্টের সঙ্গে ভারতীয় এজেন্টের প্রেম দেখানো হয়। প্রবল বিতর্কের মধ্যে গতকাল আরেকটি পোস্ট করে ক্ষতকে প্রলেপ দেওয়ার চেষ্টা করেছেন হৃতিক; কিন্তু ততক্ষণে যা হওয়ার হয়ে গেছে।

‘ধুরন্ধর’ সিনেমায় সঞ্জয়, রণবীর ও অক্ষয়ের লুক। কোলাজ

বিতর্ক চলতেই থাকবে
এখন এমন এক সময়, যখন আপনার কিছু ভালো লাগলে বা না লাগলে প্রকাশ করা মুশকিল। কারণ, একদল তখনই ঝাঁপিয়ে পড়বে ট্রল করতে। গত কয়েক বছরে মুক্তি পাওয়া অনেক সিনেমার ক্ষেত্রে সেটা দেখা গেছে, ‘ধুরন্ধর’ সেটা আবারও প্রমাণ হলো। প্রথম কিস্তি মুক্তি পেয়েছে, ‘ধুরন্ধর ২’ আসবে আগামী বছর। সে পর্যন্ত সিনেমাটি বক্স অফিসে ধুন্ধুমার যেমন ঘটাবে তেমনই ‘ধুরন্ধর’ নিয়ে বিতর্ক চলতেই থাকবে।

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, হিন্দুস্তান টাইমস ও পিংকভিলা অবলম্বনে