৬ মাস বাঁচবেন, চিকিৎসকেরা বলেছিলেন আদনান সামিকে
পাকিস্তান ছাড়িয়ে ভারতেও তিনি গান দিয়ে তুমুল জনপ্রিয়তা পান। দর্শকের মুখে মুখে ছিল তাঁর গান। জনপ্রিয়তা যখন তুঙ্গে, সে সময় হঠাৎ করেই দীর্ঘদিন সংগীত থেকে দূরে সরে যান। ২০০৫ সালের সে সময় শোনা গিয়েছিল, তিনি জীবন–মরণের সন্ধিক্ষণে। পরে দীর্ঘ ১১ মাস পর নতুন এক গায়ককে দর্শক দেখতে পান। ২৮০ ওজন ছিল যে গায়কের, তিনি যেন একদমই অচেনা হয়ে সামনে আসেন। অচেনা হওয়ারই কথা, যাঁর ওজন কমিয়ে হয়েছিল মাত্র ৮৫ কেজি। তাঁর দীর্ঘ ক্যারিয়ারের যাত্রা নিয়ে ইন্ডিয়া টাইমস, টাইমস অব ইন্ডিয়া ও আইএমডিবি অবলম্বনে লিখেছেন মনজুরুল আলম
কে এই গায়ক
১৯৭১ সালের ১৫ আগস্ট তাঁর জন্ম, লন্ডনে। বাবা পাকিস্তানি হলেও মা ছিলেন ভারতীয়। শৈশব থেকে সংগীতচর্চা পছন্দ ছিল তাঁর। শিশু বয়সেই পরিবারে দেখতেন পিয়ানো। সেই পিয়ানোর সঙ্গে সখ্য বাড়তে থাকে। মাত্র পাঁচ বছর বয়সেই হাতে তুলে নেন পিয়ানো বাজানোর দারুণ কৌশল। সবাইকে সেই বয়সেই পিয়ানো শুনিয়ে তাক লাগিয়ে দিতেন। তার আগে বলে নেওয়া দরকার, এই গায়কের বেড়ে ওঠা লন্ডনে হলেও পারিবারিক সূত্রে ইন্ডিয়ান ক্ল্যাসিক্যাল মিউজিক তাঁকে খুবই টানত। পরবর্তী স্কুলে ছুটির ফাঁকে ভারতে এসে গানও শিখতেন। মাত্র ৯ বছর বয়সেই গানে কণ্ঠ দেন। পরের বছরই লন্ডনের একটি কনসার্টে আশা ভোঁসলের সঙ্গে দেখা হয়। তখন কিশোর আদনান সামিকে সংগীত আসতে বলেন ভারতের এই কিংবদন্তি গায়িকা। যা তাঁকে গান নিয়ে আরও বেশি আগ্রহী করে তোলে।
যেভাবে শুরু
কিশোর বয়স থেকেই পিয়ানিস্ট, সংগীতায়োজক ও গায়ক হিসেবে পথচলা শুরু করেন আদনান সামি। ইন্ডিয়ান ক্ল্যাসিকের পাশাপাশি ওয়েস্টার্ন, সেমি ওয়েস্টার্ন ক্ল্যাসিক, জাজ, রক ও পপ মিউজিকের দিকে পুরো মনোনিবেশ করেন। দেশ-বিদেশের টেলিভিশন অনুষ্ঠানেও তাঁর ডাক পড়তে থাকে। কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার জন্য সে সময়ে টেলিভিশন অনুষ্ঠানের মোহ কাটিয়ে শেখার জন্য তিনি ভারতে চলে আসেন। সে সময়ই ইথিওপিয়ায় দুর্ভিক্ষ চলছিল। তাঁর ওপর একটি গান লেখেন এ গায়ক। গানটি তুমুল জনপ্রিয় হয়। গানের জন্য ইউনিসেফ থেকে থেকে বিশেষ পুরস্কার পান।
এবার ওড়ার সময়
একের পর এক সম্মাননা আর পুরস্কার তাঁকে এগিয়ে নিয়েছে ক্যারিয়ারে। তত দিনে তাঁর প্রথম অ্যালবাম ‘রান ফর হিজ লাইফ’ রিলিজ হয়ে গেছে। তাঁর ইংরেজি এ অ্যালবামটি মিডল ইস্টে ১ নম্বর তালিকায় জায়গা করে নেয়। আরও গুছিয়ে গান নিয়ে সামনে আসেন। ওস্তাদ জাকির হোসেনের কম্পোজে অ্যালবাম করেন। তখনো ভারতে তাঁর গানগুলো সাড়া ফেলেনি। তবে পাকিস্তানে তিনি জনপ্রিয় ছিলেন। পাকিস্তানের ফিল্মের সংগীতায়োজক হিসেবে নামও লিখিয়েছেন। শুধু তা–ই নয়, এই প্রথম ও শেষবার তাঁকে দেখা যায় নায়ক হিসেবে। সিনেমার নাম ‘সারগম’। এই সিনেমায় আশা ভোঁসলের সঙ্গে গানও করেন। বক্স অফিসে সিনেমাটি সাফল্য পায়। নব্বই দশকে তরুণ গায়ক ও নায়ক হিসেবে ভক্তদের মধ্যে সাড়া ফেলেন। ‘সারগম’ সিনেমার নায়িকা জেবা বখতিয়ারকে পরে বিয়ে করেন। কিন্তু তিন বছর টেকেনি সে সংসার। পরে ব্যক্তিগত জীবন তাঁর খুব বেশি ভালো কাটেনি।
আশা ভোঁসলের সহায়তায়...
২০০০ সালের দিকে ভারতের জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী আশা ভোঁসলের সহায়তায় সামি বেশ কিছু রোমান্টিক গান করেন। সেগুলোর সংগীতায়োজন করেছেন আদনান নিজেই। ‘কাভি তো নাজর মিলাও’সহ বেশ কিছু গান দর্শক পছন্দ করেন। যা তুমুল সাফল্য এনে দেয় এ গায়ককে। মিউজিক ভিডিও এবং অ্যালবামের গানগুলো ইন্ডিয়ায় টপ চার্টে ছিল বছরজুড়ে। তিনি নজর কাড়েন ইয়াশ চোপড়া ও সুভাষ ঘাইয়ের মতো প্রযোজক ও পরিচালকদের। ধারাবাহিকভাবে তিনি এগিয়ে চলেন। পরে সামি ভারতের ‘আজনবি’ সিনেমায় গান করে আরও বেশি আলোচনায় আসেন। খ্যাতির তুঙ্গে থাকার সময় ২০০২ সালে এ আর রাহমানের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ পেয়ে যান। ‘সাথিয়া’ সিনেমা দিয়ে এই যাত্রা শুরু হয়। তাঁদের ‘মেরা মেহবুব, আয়ে উড়ি উড়ি’ গানগুলো দর্শকদের মুখে মুখে ছিল। এই সুবাদে গুরুত্বপূর্ণ নিগার, বলান একাডেমি পুরস্কারগুলো হাতে চলে আসে মাত্র ৩২ বছর বয়সেই। ‘ভয়েস অব এশিয়া’র বিচারকও সে সময়েই হোন। আর কী চাই ক্যারিয়ারে!
ভারতে রেকর্ড ভাঙে
স্ক্রিন ম্যাগাজিন সূত্রে জানা যায়, ২০০২ সালে ভারতে সামির ‘তেরা চেহারা’ অ্যালবাম বিক্রিতে নতুন রেকর্ডের নজির গড়ে। পরের বছরেও একই জায়গা ধরে রাখে অ্যালবামটি। বাংলাদেশেও সেই ঢেউ লাগে। গানটি তুমুল জনপ্রিয়তা দেশে। এখনো ভারতে সফল অ্যালবামের তালিকায় প্রথম দিকেই রয়েছে আদনান সামির নাম। সালমান খানের ‘লাকি’, আমিরের ‘লগন’, ‘ধামাল’, ‘হাম দিল দে চুকে সনম’সহ একাধিক সিনেমার গান নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। বলা প্রয়োজন, কাউয়ালি গানেও তিনি দক্ষতার পরিচয় দিয়েছিলেন। তামিল, তেলেগুসহ সব জায়গায় তাঁর সংগীতের পদচারণে মুখর হয়ে ওঠে। সময় যখন নিজের হাতে, ঠিক তখনই থেমে যেতে হয় এই গায়ককে।
হঠাৎ গান থেকে দূরে
২০০৫ সালের দিকে যখন একের পর এক ব্যস্ততা বাড়ছে, তখন দুঃসংবাদ হয়ে আসে তাঁর শারীরিক অসুস্থতা। চিকিৎসক জানিয়ে দেন, লিম্ফোডিমা রোগে ভুগছেন। সরাসরি এটা বলেও তাঁকে সতর্ক করা হয়, ‘আপনি আর হয়তো ছয় মাস বাঁচবেন।’ তাঁর ওজন ছিল তুলনামূলক বেশি। এই বাড়তি ওজন না কমালে হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। বেঁচে থাকার কথা চিন্তা করে সামি তখন সিদ্ধান্ত নেন, ওজন কমাতে হবে নয়তো মরতে হবে।
ইন্ডিয়া টাইমস সূত্রে জানা যায়, ২০০৬ সালের ৭ জুন থেকে চিকিৎসক ও পুষ্টিবিদের শরণাপন্ন হয়ে লো কার্ব হাইপ্রোটিন (অল্প শর্করা বেশি আমিষ) ডায়েট শুরু করেন আদনান সামি। সেই সঙ্গে নিয়মিত ব্যায়ামও করতে থাকেন তিনি। গান থেকে একদমই দূরে সরে যান। মাত্র ১১ মাসে আদনান সামির ওজন ২৩০ কেজি থেকে ৮৫-তে নামিয়ে আনেন। তিনি জানান, গড়ে তাঁর ওজন প্রতি মাসে ১০ কেজি করে কমাতে হয়েছে।