বিজেপির নেতা, ‘লাপাতা লেডিস’ দিয়ে নতুন জীবন
২০২৪ সালে নেটফ্লিক্সে মুক্তি পাওয়া ‘লাপাতা লেডিস’ সিনেমা দেখে যাঁরা রবি কিষণকে চিনেছেন, তাঁরা তাঁর হাসিমুখ, সপ্রতিভ উপস্থিতি আর অদ্ভুত মানবিক এক পুলিশ অফিসার শ্যাম মনোহরের কথা ভুলতে পারেননি। আবার যাঁরা তাঁকে আগে থেকেই চেনেন, তাঁরা জানেন, এই অভিনেতা শুধু পর্দার মানুষ নন, তিনি একজন রাজনীতিবিদ, সংসদ সদস্য, ভোজপুরি সিনেমার সুপারস্টার, আবার কখনো কখনো বিতর্কে জড়িয়ে পড়া এক সংগ্রামী মানুষও। আজ বৃহস্পতিবার (১৭ জুলাই) তাঁর জন্মদিনে উঠে আসে এই বহুমাত্রিক চরিত্রের জীবনের গল্প।
রবি কিষণের জন্ম ১৯৬৯ সালে, মুম্বাইয়ের সান্তাক্রুজে। কিন্তু পারিবারিক টানাপোড়েনের কারণে তাঁর পরিবার কিছুদিন পর উত্তর প্রদেশের জৌনপুরে চলে যায়। সেখানেই বড় হয়ে ওঠা, স্কুলজীবন আর ধীরে ধীরে অভিনয়ের প্রতি অদম্য আকর্ষণ। সেই আকর্ষণ এতটাই প্রবল ছিল যে মাত্র ১৭ বছর বয়সে রবি পকেটে মাত্র ৫০০ টাকা নিয়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে আবার মুম্বাই চলে আসেন।
মুম্বাই তখন স্বপ্ন আর স্বার্থের সংকট। মাথার ওপর ছিল না ছাদ, পাশে ছিল না পরিচিত কেউ। বন্ধুর বাড়িতে উঠেছিলেন ঠিকই কিন্তু প্রতিদিন একাধিক অডিশনে গিয়ে ফিরতে হয়েছে খালি হাতে। শুধু খালি হাতে নয়, সঙ্গে ছিল অপমানও। অনেকেই বলতেন, তাঁর মুখাবয়ব নাকি মিঠুন চক্রবর্তীর মতো। তাই কেউ তাঁকে কাজ দিতে চাইতেন না। বলতেন, ‘মিঠুনের সস্তা কপি’।
রবি দমে যাননি। লড়াই করেছেন চুপচাপ। সেই লড়াইয়ে প্রথম সফলতা আসে ১৯৯২ সালে, হিন্দি ছবি ‘পীতাম্বর’-এর মাধ্যমে। ছবিতে তাঁর পারিশ্রমিক ছিল মাত্র পাঁচ হাজার টাকা। সেই টাকাতেই কিনেছিলেন নিজের জীবনের প্রথম মোটরসাইকেল। এরপর তাঁকে দেখা গেছে একে একে ‘তেরে নাম’, ‘আন’, ‘হেরা ফেরি’, ‘ফির হেরা ফেরি’, ‘কিক ২’, ‘বাতলা হাউস’, ‘মিশন রানীগঞ্জ’সহ নানা ছবিতে।
তবে শুধু হিন্দি সিনেমা নয়, রবি কিষণ হয়ে ওঠেন ভোজপুরি সিনেমার প্রথম সারির তারকা। তাঁর উপস্থিতি মানেই জনপ্রিয়তা, টিকিট বিক্রি। তাঁর চাহিদা ছিল আঞ্চলিক সিনেমাজগতেও।
সেই জনপ্রিয়তার ছায়া পড়ে ছোট পর্দাতেও। অংশ নেন ‘বিগ বস’ ও ‘বিগ ব্রাদার’-এর মতো রিয়েলিটি শোতে। মানুষ তখন রবি কিষণকে শুধু নায়ক হিসেবে নয়, একজন পরিচিত ব্যক্তিত্ব হিসেবে দেখতে শুরু করেন। ঠিক এই জায়গা থেকেই ধীরে ধীরে তৈরি হয় তাঁর রাজনীতির ভিত। ২০১৪ সালে কংগ্রেসের হয়ে ভোটে দাঁড়ান এবং হেরে যান। পরে দল বদলে বিজেপিতে যোগ দিয়ে ২০১৯ সালে জেতেন লোকসভা নির্বাচনে, ভারতের গোরক্ষপুর কেন্দ্র থেকে।
তবে গত বছর রবি কিষণকে আলোচনায় এনেছে দুটি কাজ—‘লাপাতা লেডিস’ ও নেটফ্লিক্সের সিরিজ ‘মামলা লিগ্যাল হ্যায়’। নিজেই বলেন, ‘এই দুই কাজ আমাকে নতুন করে জন্ম দিয়েছে। ৩৫ বছরের ক্যারিয়ারে এত প্রশংসা আগে পাইনি। মনে হচ্ছিল, আমি তো ছিলামই, কিন্তু কেউ দেখেনি।’
‘লাপাতা লেডিস’-এর পুলিশ অফিসারের চরিত্রে কাস্টিংয়ের জন্য প্রথমে বিবেচনা করা হয়েছিল আমির খানকে, কিরণ রাওয়ের সাবেক স্বামী। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কাস্টিং অডিশনে বাজিমাত করেন রবি। তাঁর সংলাপ, চোখের ভাষা আর স্বতঃস্ফূর্ত অভিনয়ে দর্শক যেন নতুন এক রবিকে আবিষ্কার করেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঘুরতে থাকে তাঁর ক্লিপিংস। সমালোচকেরা প্রশংসা করেন। দর্শকের মুখে মুখে তাঁর অভিনয়ের কথা ছড়িয়ে পড়ে।
জীবনের এই সাফল্যগুলো আসেনি সহজে। সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে রবি কিষণ বলেন, ‘আমি বহুবার কাস্টিং ব্যর্থতার মুখোমুখি হয়েছি। অল্প বয়সে, যখন কিছুই ছিল না, তখন শুধু চেহারার কারণে অনেকেই অন্য রকমভাবে এগিয়ে এসেছেন।’ তবে তিনি সতর্ক করেছেন নবাগতদের, বলেন, ‘সহজ পথে তারকা হওয়া যায় না। ধৈর্য ধরতে হবে, নিজের সময়ের জন্য অপেক্ষা করতে হবে।’
এই পরিণত ভাবনা, সংযত কণ্ঠস্বরের পেছনে লুকিয়ে রয়েছে এক দীর্ঘ যাত্রাপথ। বিতর্কও ছিল সেই পথে। যেমন গত বছর এক তরুণী দাবি করেন, তিনি রবি কিষণের মেয়ে। সঙ্গে ছিল তাঁর মায়ের বক্তব্য, তাঁদের ১৯৯৬ সালে বিয়ে হয়েছিল, তারপরই জন্ম শিনোভা সোনির। ডিএনএ পরীক্ষার আবেদন পর্যন্ত ওঠে আদালতে। তবে মুম্বাইয়ের আদালত সেই আবেদন খারিজ করে দিয়ে বলেন, যেহেতু কোনো পারিবারিক সম্পর্ক প্রমাণিত হয়নি, তাই এমন আবেদন গ্রহণযোগ্য নয়।
‘লাপাতা লেডিস’-এর পর রবির ব্যস্ততা বেড়েছে। সামনে দেখা যাবে ‘সন অব সরদার ২’-এ; ছবিতে তাঁর রাজা চরিত্রটি নিয়ে দর্শকের কৌতূহল আছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। ছবিটির ট্রেলারে প্রয়াত মুখুল দেবকে স্মরণ করে রবি কিষণ বলেন, ‘এই ছবিটা দয়া করে তাঁর জন্য দেখবেন।’ ২৫ জুলাই মুক্তি পাচ্ছে ছবিটি। এরপর এটি স্ট্রিমিং হবে নেটফ্লিক্সে।
অন্যদিকে, নেটফ্লিক্সের কোর্টরুম কমেডি ‘মামলা লিগ্যাল হ্যায়’-এর দ্বিতীয় মৌসুমের শুটিং চলছে। সেখানে আবারও দেখা যাবে তাঁকে পরিচিত ভিডি ত্যাগী চরিত্রে। এই মৌসুমে যুক্ত হচ্ছেন কুশা কাপিলা ও ভোজপুরি তারকা দিনেশ লাল যাদব ওরফে নিরাহুয়া। সিরিজটি মুক্তি পেতে পারে এ বছরের শেষে।
একদিকে বড় পর্দায় পুনঃপ্রতিষ্ঠার যাত্রা, অন্যদিকে ওটিটিতে নিজের জায়গা পাকাপোক্ত করে তোলা—রবি কিষণ শক্তপোক্তভাবে নতুন জীবন ফিরে পেয়েছেন।