৩৯ বছর বয়সে রহস্য-মৃত্যু হওয়া এই তারকাকে কতটা চেনেন
৩৯ বছরের জীবনে আটটি মাত্র ছবি, তবু হিন্দি সিনেমার সর্বকালের সেরা নির্মাতার তালিকা করতে গেলে তাঁর নাম শুরুর দিকেই রাখতে হবে। আজ নির্মাতা, অভিনেতা ও প্রযোজক গুরু দত্তর জন্মশতবার্ষিকী। গুরু দত্তর ১০০ বছর উপলক্ষে তাঁকে নিয়ে লিখেছেন লতিফুল হক
ভারতের কর্ণাটকে দারিদ্র্য ও পারিবারিক অস্থিরতায় কেটেছে তাঁর ছোটবেলা। কৈশোরের বড় সময় থেকেছেন কলকাতার ভবানীপুরে। ভালো বাংলা বলতেন। এই বাংলা-যোগ জীবনভরই ছিল। তাঁর শিল্পচিন্তায়ও গভীরভাবে প্রভাব ফেলে কলকাতার সাহিত্য-সংস্কৃতি। বিয়েও করেন এক বাঙালি শিল্পীকে, গীতা রায়। বলিউডে কোরিওগ্রাফার হিসেবে ক্যারিয়ার শুরুর সময়ই নাম থেকে বাদ দেন পারিবারিক পদবি ‘পাড়ুকোন’। সংসার চালাতে এ সময় পাশাপাশি টেলিফোন অপারেটরের কাজও করেছেন। স্বাধীনতা-পূর্ব সময়ের অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তা তাঁর স্বপ্নপূরণের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। ১৯৪৭ থেকে ১৯৪৮ সালের মধ্যে, গুরু দত্তর বয়স যখন ২২ কী ২৩ বছর, ‘কশমকশ’ নামে একটা ছোটগল্প লেখেন তিনি; শিল্পীর হতাশা ও সমাজবিমুখতা ছিল গল্পের মূল সুর। পরে এ গল্প থেকেই তৈরি করেন কালজয়ী সিনেমা ‘পিয়াসা’।
উত্থান ও প্রেম
১৯৪৪ সালে পুনের প্রভাত স্টুডিওতে সহকারী কোরিওগ্রাফার হিসেবে কাজ শুরু করেন গুরু দত্ত। সেখানেই দেব আনন্দের সঙ্গে পরিচয়। তিনিও তখন পায়ের তলার মাটি শক্ত করার সংগ্রামে ব্যস্ত। দেবের সুবাদেই ১৯৫১ সালে প্রথমবার বাজি সিনেমা পরিচালনার সুযোগ পান। এ সময়ই কণ্ঠশিল্পী গীতা রায়ের প্রেমে পড়েন। ১৯৫৩ সালে তাঁরা বিয়ে করেন। গুরু দত্ত গড়ে তোলেন নিজের প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান। ‘আর-পার’ ও ‘মিস্টার অ্যান্ড মিসেস ৫৫’ নামে দুটি সিনেমা করেন। প্রযোজনা, পরিচালনার পাশাপাশি এ দুই সিনেমার প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেন গুরু দত্ত। সিনেমা দুটি বাণিজ্যিকভাবে সাফল্য পেলেও শিল্প হিসেবে গুরু দত্তকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি। শিল্পসত্তার গভীরে পৌঁছাতে চেয়েছেন তিনি। সেই চাওয়া থেকেই শুরু করেন ‘পিয়াসা’। তখন কি জানতেন, এক শিল্পীর সমাজে টিকে থাকার সংগ্রামকে কেন্দ্র করে নির্মিত ছবিটি তাঁকে অমর করে রাখবে। এটিই টাইম সাময়িকীর বিংশ শতকের ১০০ সেরা ছবির তালিকায় জায়গা করে নেওয়া একমাত্র হিন্দি ছবি।
বোন ললিতা লাজমির ভাষায়, ‘পিয়াসা’ ছিল গুরু দত্তর ‘স্বপ্নের প্রকল্প’। ছবিটিকে নিখুঁতভাবে তৈরি করতে চেয়েছেন তিনি। সেটে প্রতিনিয়ত চিত্রনাট্য ও সংলাপ পরিবর্তন করতেন, ক্যামেরা অ্যাঙ্গেল নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতেন। জানেন কি, ‘পিয়াসা’র ক্লাইম্যাক্স দৃশ্যের ১০৪টি টেক নিয়েছিলেন গুরু দত্ত!
অদ্ভুত এক শূন্যতা
এত সব পরিচিতি ও সাফল্যের পরও কিন্তু ক্রমেই বিষাদে ডুবে যাচ্ছিলেন গুরু দত্ত। কমতে থাকে ঘুম। মদের সঙ্গে ঘুমের ওষুধ মেশানো শুরু করেন। ১৯৫৬ সালে পিয়াসার কাজ যখন প্রায় শেষ, তখনই একবার আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। হাসপাতালে ভর্তি হলেও মানসিক চিকিৎসার কোনো উদ্যোগ নেয়নি পরিবার। মানসিক স্বাস্থ্য তখন ‘লজ্জা’র বিষয় ছিল। ১৯৫৭ সালে মুক্তির পর সমালোচক ও বাণিজ্যিক—দুই দিকেই সাফল্য পায় ‘পিয়াসা’। কিন্তু এসব গুরু দত্তর ভেতরকার শূন্যতা কাটাতে পারেনি। ছবির প্রধান চিত্রগ্রাহক ভি কে মুর্তি একবার গুরু দত্তকে বলতে শুনেছিলেন, ‘সব পেয়েও যেন কিছুই পাইনি।’
গুরু দত্তর ভেতরে দ্বৈতসত্তা কাজ করত কি? তাঁর চলচ্চিত্রে নারীরা যেখানে দৃঢ় ও স্বাধীনচেতা, বাস্তবে তিনি স্ত্রী গীতাকে চাইতেন নিজের কাছে আগলে রাখতে। এমনকি চাইতেন কেবল তাঁর প্রযোজিত ছবিতেই গান গাইবেন গীতা।
ক্যামেরায় বিষাদের সুর
গুরু দত্তর সিনেমা মানেই ক্লোজ-আপের ছড়াছড়ি। তাঁর সিনেমা মানেই যেন পর্দায় বিষাদের সুর। পরিচালক সুধীর মিশ্রর কথায়, ‘গুরু দত্তর সিনেমার চরিত্রের কথা বলতে গেলে মনে পড়ে যায় গালিবের কবিতার কথা—“এ তো একটা হৃদয়, ইট-পাথর নয়, ব্যথায় ভরবে না কেন?” এমন শিল্পীরাই অন্যের দুঃখ অনুভব করতে পারেন। সেটা একধরনের অভিশাপও বটে।’
চলচ্চিত্র সংরক্ষণবিদ শিবেন্দ্র সিং দুঙ্গারপুর মনে করেন, গুরু দত্তর শিল্পীজীবনের মূল লক্ষ্যই ছিল ‘পিয়াসা’ তৈরি। ছবিটি যেন তাঁর জীবনেরই গল্প। গুরু দত্ত ছিলেন ভিনসেন্ট ভ্যান গঘের ভক্ত। দুঙ্গারপুরের ধারণা, যেভাবে ভ্যান গঘ মৃত্যুর পর বিখ্যাত হন, নিজের অজান্তে গুরু দত্তও হয়তো তেমনই চেয়েছিলেন।
পরাজয়ের বেদনা
‘পিয়াসা’র পর গুরু দত্ত তৈরি করেন তাঁর সবচেয়ে ব্যয়বহুল, ব্যক্তিগত ও আধা আত্মজৈবনিক ছবি ‘কাগজ কে ফুল’—এক হতাশ চলচ্চিত্র পরিচালকের গল্প, নিঃসঙ্গতায় শেষ হয় যার জীবন। আজ এটি ক্ল্যাসিক হিসেবে বিবেচিত হলেও তখনকার দিনে তা ছিল বক্স অফিসে চরম ব্যর্থ। স্বপ্নের এই সিনেমার ভরাডুবি মানতে পারেননি গুরু দত্ত। এটা ছিল তাঁর জন্য এমন বড় এক ধাক্কা, যা কখনো সামলে উঠতে পারেননি। ‘জীবনে তো শুধু দুটি জিনিস—সাফল্য আর ব্যর্থতা,’ বলেছিলেন সহ-অভিনেত্রী ওয়াহিদা রেহমানকে। ‘কাগজ কে ফুল’-এর বক্স অফিস ব্যর্থতার পর তিনি আর কখনো পরিচালনায় ফেরেননি।
এবং ওয়াহিদা রেহমান
গুরু দত্তকে নিয়ে লিখতে গেলে ওয়াহিদা রেহমান প্রসঙ্গ আসবেই। তাঁদের পর্দার রসায়ন ছড়িয়ে পড়েছিল ব্যক্তিজীবনেও। বলা হয়, গীতা দত্তর সঙ্গে সংসার ভেঙেছিল ওয়াহিদা রেহমানের সঙ্গে গুরু দত্তর সম্পর্কের কারণে। অনেকে মনে করেন, ওয়াহিদা রেহমানের কারণেই ‘আত্মহত্যা’ করেন গুরু দত্ত।
দক্ষিণ ভারতীয় একাধিক ছবিতে কাজ করে ফেলেছিলেন ওয়াহিদা। আর সেখানেই তাঁর অভিনয়ে মুগ্ধ হন গুরু দত্ত। তিনিই ওয়াহিদাকে বোম্বে (এখন মুম্বাই) নিয়ে আসেন এবং দেব আনন্দের বিপরীতে ‘সিআইডি’ ছবিতে ‘কামিনী’র চরিত্রে সুযোগ করে দেন। গুরু দত্ত মুগ্ধ ছিলেন ওয়াহিদার সৌন্দর্য ও ব্যক্তিত্বে, আর ওয়াহিদা সম্মোহিত হয়েছিলেন গুরু দত্তর শিল্পসত্তা ও নিষ্ঠায়। তবে এর আগেই গুরু দত্ত বিবাহিত ছিলেন। স্ত্রী গীতা ছিলেন খ্যাতনামা গায়িকা। তাঁদের তিন সন্তান—তরুণ, অরুণ ও নীনা। গীতা সংসার আর সন্তানদের সময় দিতেন। গুরু দত্ত দিনরাত মেতে থাকতেন সিনেমায়। সেই দূরত্ব সময়ের সঙ্গে বাড়তে থাকে, দাম্পত্যে তৈরি হয় ফাটল। এই সময়েই গুরু দত্তর জীবনে আসেন ওয়াহিদা রেহমান। ‘সিআইডি’র পর গুরু দত্ত ওয়াহিদাকে প্রধান চরিত্রে সুযোগ দেন ‘পিয়াসা’ ছবিতে। এভাবে ‘১২ ও’ক্লক’, ‘কাগজ কে ফুল আর ‘চৌধভি কা চাঁদ’—একের পর এক ছবিতে পাওয়া যায় তাঁদের। এই জুটির শেষ ছবি ছিল সাহেব বিবি অউর গুলাম।
বিয়োগান্ত বিদায়
প্রযোজক হিসেবে আবার ঘুরে দাঁড়ান ‘চৌধভি কা চাঁদ’ করে। এরপর করেন ‘সাহেব বিবি অউর গুলাম’—পরিচালনায় থাকেন তাঁর বিশ্বস্ত সহচর আবরার আলভি। কিন্তু এ সময়েই তাঁর ব্যক্তিজীবন তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে, দাম্পত্য ভেঙে গেছে, মনের ভেতরে তীব্র অস্থিরতা। লেখক বিমল মিত্রর কাছে গুরু দত্তর তখনকার স্বীকারোক্তি, ‘মনে হয় আমি পাগল হয়ে যাব।’ আবারও আত্মহত্যার চেষ্টা করেন, তিন দিন ছিলেন অজ্ঞান। এরপর ডাক্তারদের পরামর্শে মানসিক চিকিৎসার জন্য মনোরোগবিশেষজ্ঞের খোঁজ করা হলেও আর কোনো পদক্ষেপ নেয়নি পরিবার। ললিতা বলেন, ‘আমার মনে হয় ভাই যেন নীরবে সাহায্যের জন্য চিৎকার করছিলেন—অন্ধকার এমন এক গহ্বরে আটকে ছিলেন, যেটা কেউ দেখতেও পারেনি, তিনিও হয়তো খুঁজে পাননি বেরিয়ে আসার পথ।’
হাসপাতাল থেকে ফিরে আসার পর ‘সাহেব বিবি অউর গুলাম’-এর শুটিংয়ে যান। যেন কিছুই ঘটেনি। বিমল মিত্রর প্রশ্নের উত্তরে গুরু দত্ত বলেছিলেন, ‘সেই দিন তো দ্বিধাই ছিল না ঘুমের ওষুধ খেতে। আজ ভাবলে ভয়ে কাঁপি।’
জাতীয় পুরস্কার পায় ‘সাহেব বিবি অউর গুলাম’, বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসবেও যায়। তবু তাঁর ব্যক্তিগত সংগ্রাম শেষ হয়নি। স্ত্রী থেকে বিচ্ছিন্ন, নিঃসঙ্গতায় ডুবে থাকা দত্ত আশ্রয় নেন মদ ও ঘুমের ওষুধের। ১৯৬৪ সালের ১০ অক্টোবর, মাত্র ৩৯ বছর বয়সে তাঁর নিথর দেহ পাওয়া যায় নিজের ঘরে। অনেকে মনে করেন, তাঁর মৃত্যু ছিল আত্মহত্যা। তবে পরিবারের ভাষ্যে, সেটা ছিল নিছক দুর্ঘটনা; ঘুমের ওষুধ আর মদের অতিমাত্রার প্রতিক্রিয়া। মৃত্যুর আগের রাতেও তিনি ‘বাহারেঁ ফির ভি আয়েঙ্গি’ ছবির চূড়ান্ত দৃশ্য নিয়ে চিত্রনাট্যকার আবরার আলভির সঙ্গে রাতভর আলোচনা করেন। ওয়াহিদা রেহমান পরে লিখেছিলেন, ‘জানি, তিনি চেয়েছিলেন মৃত্যুকে—অপেক্ষা করছিলেন তার জন্য…শেষ পর্যন্ত তা-ই হলো।’
ঠিক যেন ‘পিয়াসা’র চরিত্রের মতো, সবই পেলেন, তবে মৃত্যুর পর। ২২ বছর বয়সে গল্পটা লেখার সময় কি নিজের ভবিষ্যৎ দেখতে পেয়েছিলেন গুরু দত্ত!
তথ্যসূত্র: বিবিসি, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, ইয়াসির উসমানের গুরু দত্ত: অ্যান আনফিনিশ স্টোরি