গব্বর থেকে জিম: বদলে যাচ্ছে বলিউডের খলনায়ক

বলিউড সিনেমায় খলনায়কেরা একসময় ছিলেন গল্পের আরেক প্রাণভোমরা। তাঁদের ছিল নিজস্ব কদর, কেবল নায়কের প্রতিপক্ষ হিসেবে নয়, বরং সমাজের অন্ধকার দিকগুলোর প্রতিচ্ছবি হিসেবে। কিন্তু সময় বদলে গেছে, বদলে গেছে সমাজ, দর্শকের মনস্তত্ত্ব, আর সেই সঙ্গে খলনায়কের রূপও। এখনকার সিনেমায় খলনায়ক যেন আর আগের মতো সাদাকালো রঙে আঁকা থাকেন না। তাঁর মধ্যে জটিলতা, দ্বিধা, এমনকি সহানুভূতিও কাজ করে। বলিউডের খলনায়ক চরিত্রের এই বিবর্তনই নিয়ে আজ কথা হবে।

বদলে যাচ্ছে বলিউডের খলনায়ক। কোলাজ

স্বর্ণযুগের খলনায়ক
পঞ্চাশ থেকে সত্তরের দশক—বলিউডের ইতিহাসে খলনায়কের এক উজ্জ্বল সময়। সেই সময়ের সিনেমায় খলনায়কেরা ছিলেন প্রায়ই জমিদার, গুন্ডা, চোরাকারবারি বা সমাজের ক্ষমতালিপ্সু শোষকের প্রতীক। তাঁরা একমাত্রিক হলেও প্রভাব বিস্তারকারী। তাঁদের উপস্থিতি দর্শকের মনে একরকম উত্তেজনা ও আতঙ্ক একসঙ্গে তৈরি করত। প্রাণ, অজিত, কেএন সিং ও আমজাদ খানের মতো অভিনেতারা এই সময়ের খলনায়ক চরিত্রে অভিনয় করে হয়ে উঠেছিলেন কিংবদন্তি।

‘শোলে’ ছবিতে আমজাদ খান। আইএমডিবি

‘শোলে’ ছবির গব্বর সিং চরিত্রে আমজাদ খান, ‘জাঞ্জির’-এর তেজা চরিত্রে অজিত কিংবা ‘রাম অউর শ্যাম’-এ প্রাণের নিষ্ঠুরতা—এসব চরিত্র আজও দর্শকের মনে গেঁথে আছে। তাঁরা ছিলেন দৃশ্যমান মন্দ, যাঁদের সঙ্গে লড়াই করে নায়ক নিজেকে প্রমাণ করতেন। খলনায়ক না থাকলে গল্প এগোত না, উত্তেজনা তৈরি হতো না আর দর্শকের কৌতূহলও থাকত অসম্পূর্ণ।
সহানুভূতিশীল খলনায়ক ও অ্যান্টিহিরোর উত্থান

সমাজের পরিবর্তন সিনেমার গল্পেও এসে পড়ে। আশি ও নব্বইয়ের দশকে এসে খলনায়কেরা একমাত্রিকতা হারান। তাঁরা হয়ে ওঠেন আরও বেশি বাস্তব ও মনস্তাত্ত্বিক। এই সময়ের খলনায়কেরা শুধু খারাপ নয় বরং তাঁদের কর্মের পেছনে থাকে সামাজিক অবিচার, ব্যক্তিগত প্রতিহিংসা কিংবা মানসিক আঘাতের ইতিহাস। ‘মি. ইন্ডিয়া’ সিনেমার মোগাম্বো চরিত্রে অমরেশ পুরি যতটা নির্মম, ততটাই স্মার্ট ও পরিকল্পনাবাজ। সঞ্জয় দত্তের ‘খলনায়ক’-এর বাল্লু চরিত্রে যেমন ছিল ভয়, তেমনি ছিল একধরনের সহানুভূতিও! এই সময়েই অ্যান্টিহিরোর ধারণা জনপ্রিয় হয়ে ওঠে—নায়ক নিজেই হয়ে উঠেন খলনায়ক বা অন্তত অনৈতিক পথে হাঁটেন ন্যায়ের নামে। বলিউডে অ্যান্টিহিরোর উত্থানের ফলে দর্শকের ভালো-মন্দের বোঝাপড়ার মাঝখানে একধরনের প্রাচীর তৈরি হয়।

‘মি. ইন্ডিয়া’ সিনেমার মোগাম্বো চরিত্রে অমরেশ পুরি যতটা নির্মম, ততটাই স্মার্ট ও পরিকল্পনাবাজ। আইএমডিবি

ইন্ডিয়া টুডের সঙ্গে আলাপকালে চিত্রনাট্যকার ও গীতিকার জাভেদ আখতার বলেন, খলনায়কদের মাধ্যমে আগেকার দিনের সামাজিক ও অর্থনৈতিক বাস্তবতা চিত্রায়িত হয়েছে। তখন বেশির ভাগ চরিত্র ছিল নিপীড়নকারী জমিদার কিংবা এলাকার মোড়ল। ‘মাদার ইন্ডিয়া’ সিনেমার সুখীলালার কথা এ ক্ষেত্রে বলা যায়। অবশ্য একটা পর্যায়ে এসে সামন্ত যুগের অবসান ঘটতে থাকে।

সমাজ বদলায়, খলনায়কও
সমাজ যখন জমিদারি প্রথা ছাড়িয়ে করপোরেট যুগে প্রবেশ করে, তখন খলনায়কের আদলেও পরিবর্তন আসে। চিত্রনাট্যকার জাভেদ আখতার এক সাক্ষাৎকারে বলেন, আগে খলনায়কেরা নিপীড়নকারী জমিদার বা প্রভাবশালী মোড়ল ছিলেন। এখনকার সমাজে সে রকম চরিত্র বাস্তবতা হারিয়েছে, ফলে পর্দায়ও তাঁরা হারিয়ে গেছেন।
এই সমাজ পরিবর্তনের ফলে নব্বইয়ের দশকে জনপ্রিয় খলনায়কদের অনেকেই হারিয়ে যেতে থাকেন বলিউডের মূলধারা থেকে। যেমন মুকেশ ঋষি, আশুতোষ রানা বা শহরিয়ার কাজমির মতো অভিনেতারা নতুন ধরনের ছবির জন্য আর উপযুক্ত মনে করা হতো না। তাঁদের জায়গায় উঠে আসে নতুন মুখ, নতুন ধাঁচ।

গুলশান গ্রোভার। অভিনেতার ফেসবুক থেকে

চিরায়ত খলনায়কের অন্তর্ধান
একুশ শতকে প্রবেশের পর বলিউডে প্রেম, পরিবার আর কমেডিনির্ভর ছবির জয়জয়কার শুরু হয়। ‘দাবাং’, ‘কাভি খুশি কাভি গম’, ‘কহো না প্যায়ার হ্যায়’—এসব ছবিতে খলনায়কের ভূমিকা হয় নগণ্য অথবা একেবারে অনুপস্থিত। এই সময়টাতে খলনায়ক যেন হয়ে ওঠেন শুধুই গল্পের এক প্রতিবন্ধক আর নায়কের জয়ের জন্য প্রয়োজনীয় একটি ধাপমাত্র। গুলশান গ্রোভার, যিনি নিজেই বহু খলচরিত্রে অভিনয় করে খ্যাতি অর্জন করেছেন; খলনায়কদের এই যে পরিবর্তন, হিন্দুস্তান টাইমসকে তিনি এর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেন, ‘বাস্তবতাকে প্রতিফলিত করে রিল। একজন পরিচালক তাঁর চারপাশে যা দেখছেন, তা-ই তুলে ধরতে চান। আগের চরিত্রগুলো শুরু থেকেই সাদাকালো ছিল। তারা মন্দ হয়ে উঠতে পারলেই উতরে যেত। আর এখন খলনায়কেরা আমজনতার মতো করে কথা বলতে চান। তাই চাইলেও এখন আর চিরায়ত খলনায়ককে পর্দায় তুলে ধরা কঠিন।’

বর্তমান খলনায়কের মনস্তত্ত্ব
আজকের খলনায়ক আর গোঁফ পাকিয়ে ভয় দেখান না। বরং তাঁরা স্নায়ুযুদ্ধ ও নৈতিক দ্বিধার মধ্য দিয়ে গল্পে জটিলতা তৈরি করেন। করপোরেট দুনিয়ার লোভ, রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র, ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা, সন্ত্রাসবাদ বা মানসিক আঘাত—এই ধরনের থিম এখনকার খলনায়কদের চালিকাশক্তি। রণবীর সিংয়ের ‘আলাউদ্দিন খিলজি’ চরিত্রটি ছিল দৃষ্টিনন্দন, ভয়ংকর ও একই সঙ্গে বিমূর্ত। নওয়াজুদ্দিন সিদ্দিকীর ফয়সাল খান চরিত্র ‘গ্যাংস অব ওয়াসিপুর’-এ দেখিয়েছে, কীভাবে এক সামাজিক বাস্তবতার ফাঁদে পড়ে মানুষ হয়ে ওঠে নিষ্ঠুর।

‘পাঠান’–এ জন। আইএমডিবি

নায়ক-খলনায়কের বিভাজন ঘোলাটে
একসময় নায়ক ও খলনায়কের মাঝখানে ছিল সুস্পষ্ট বিভাজন। এখন সেই রেখাটি ঘোলাটে হয়ে গেছে। শাহরুখ খানের ‘বাজিগর’ ও ‘ডর’, হৃতিক রোশনের ‘ধুম ২’, সাইফ আলী খানের ‘ওমকারা’—এসব সিনেমায় নায়কই খলনায়ক বা উল্টোটা। অন্যদিকে, ঋষি কাপুরের মতো চিরায়ত ‘ভদ্রলোক’ নায়কও ‘অগ্নিপথ’ বা ‘ডি-ডে’ সিনেমায় খলনায়ক চরিত্রে দারুণভাবে নিজেকে মেলে ধরেছেন। এতে বোঝা যায়, বলিউড এখন আর নায়কের পক্ষে বা বিপক্ষে অবস্থান নেয় না, বরং গল্পের খাতিরেই চরিত্রের ধূসর দিক তুলে ধরতে চায়।

খলনায়ক হয়ে ওঠেন প্রগতির প্রতীক!
বর্তমান বলিউডে খলনায়কেরা কেবল গল্পে সংঘাত তৈরির জন্য থাকেন না, বরং তাঁরা হয়ে উঠেন সমাজ, অর্থনীতি, রাজনীতি কিংবা ব্যক্তিগত জীবনের প্রতিচ্ছবি। যেমন ‘পাঠান’-এর জন আব্রাহামের ‘জিম’, যিনি একসময় জাতীয় বীর ছিলেন কিন্তু সিস্টেমের অবিচারে হয়ে ওঠেন সন্ত্রাসী। ‘জওয়ান’-এর বিজয় সেতুপতির ‘কালী’ চরিত্রে ছিল নির্মমতা, কিন্তু একই সঙ্গে রাজনৈতিক ব্যঙ্গও।

‘অ্যানিমেল’–এ মানসী ও ববি দেওল। ইনস্টাগ্রাম থেকে

ববি দেওল ‘অ্যানিমেল’-এ এক অল্প কথার খলনায়ক চরিত্রে এমন দাগ রেখে গেছেন, যা তাঁর ক্যারিয়ারের এক নতুন দিগন্ত তৈরি করেছে। আবার ইমরান হাশমি ‘টাইগার ৩’-এ আতিশ রেহমান চরিত্রে দেখিয়েছেন কীভাবে এক আধুনিক খলনায়ক একই সঙ্গে স্মার্ট, ক্যারিশমাটিক ও ভয়ংকর হতে পারেন।

আরও পড়ুন

বলিউডের খলনায়কেরা আজ আর একমাত্রিক নন। তাঁরা সমাজের জটিল বাস্তবতার অংশ। তাঁদের চরিত্রে এখন নৈতিক দ্বিধা, মানসিক জটিলতা আর মানবিক সংবেদনশীলতা কাজ করে। তাঁরা ভয় দেখান না, বরং ভাবান। আর এই ভাবনাই হয়তো ভবিষ্যতের বলিউডে খলনায়ক চরিত্রকে আরও গভীর, পরিপূর্ণ ও প্রাসঙ্গিক করে তুলবে।