শর্মিলা, জিনাত নন, প্রথম বিকিনিতে ঝড় তুলেছিলেন এই অভিনেত্রী

সিনেমার দৃশ্যে নলিনী জয়ন্ত। কোলাজ

বলিউডে শর্মিলা ঠাকুর যখন প্রথম বিকিনি পরে ম্যাগাজিন কভারে পোজ দিয়েছিলেন, তা ছিল ভারতীয় সিনেমায় এক যুগান্তকারী মুহূর্ত। ১৯৬০-৭০-এর দশকে এমন সাহসী পদক্ষেপ ছিল একেবারেই বিরল। কিন্তু অনেকে জানেন না—শর্মিলা বা জিনাত আমান, হেলেন কিংবা পারভিন ববি নন, ভারতের প্রথম অভিনেত্রী যিনি পর্দায় বিকিনি পরেছিলেন, তিনি নলিনী জয়ন্ত।

নলিনী জয়ন্ত। এক্স থেকে

বলিউডের প্রথম বিকিনি দৃশ্য
১৯৫০ সাল—সমাজ তখনো রক্ষণশীল, নারীর পোশাকে স্বাধীনতার ধারণা ছিল দূরের কথা। সেই সময়েই পর্দায় বিকিনি পরে সাড়া ফেলেছিলেন অভিনেত্রী নলিনী জয়ন্ত। সেই বছর ফিল্মফেয়ার এক সমীক্ষায় তাঁকে ঘোষণা করেছিল ‘সবচেয়ে সুন্দরী অভিনেত্রী’ হিসেবে।
কিং দিলীপ কুমার একবার বলেছিলেন, ‘আমি যতজন অভিনেত্রীর সঙ্গে কাজ করেছি, নলিনী জয়ন্ত তাঁদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ।’

ছয় বছর বয়সেই রেডিও থেকে অভিনয়
মুম্বাইয়ে জন্ম নেন নলিনী জয়ন্ত। মাত্র ছয় বছর বয়সে অভিনয় শুরু করেন অল ইন্ডিয়া রেডিওতে। ছোটবেলা থেকেই সাংস্কৃতিক পরিবেশে বড় হওয়া মেয়েটি মাত্র ১৪ বছর বয়সে অভিনয়ের সুযোগ পান। ঘটনাচক্রে সেই সুযোগ আসে অভিনেত্রী নূতনের জন্মদিনের অনুষ্ঠানে—সেখানে প্রযোজকের চোখে পড়ে তাঁর চেহারা। প্রথম সিনেমা ‘রাধিকা’ মুক্তি পায় ১৯৪১ সালে। এরপর মেহবুব খানের ‘বেহন’ ছবিতে অভিনয় করে নজর কাড়েন সবার। চল্লিশের দশকে বিয়ে করেন পরিচালক বিরেন্দ্র দেশাইকে। পরে অভিনেতা প্রভু দয়ালের সঙ্গে দ্বিতীয় দাম্পত্যে জড়ান; তাঁর সঙ্গে অভিনয়ও করেন একাধিক ছবিতে।

‘সমাধি’ ও ‘সংগ্রাম’-এর সাফল্যে শীর্ষ তারকা
১৯৫০ সালে অশোক কুমারের বিপরীতে ‘সমাধি’ ও ‘সংগ্রাম’ ছবিতে অভিনয় করে নলিনী জয়ন্ত হয়ে উঠেছিলেন বলিউডের অন্যতম শীর্ষ নায়িকা। তাঁর আত্মবিশ্বাসী উপস্থিতি, চোখে পড়া সৌন্দর্য ও পর্দায় সাহসী চরিত্রচিত্রণ তাঁকে আলাদা জায়গায় নিয়ে যায়। পরের এক দশকে একসঙ্গে একাধিক হিট সিনেমা—‘জলপরী’, ‘কাফিলা’, ‘নওবাহার’, ‘লকিরেন’, ‘মিস্টার এক্স’, ‘শেরু’ এবং ‘তুফান মেঁ পেয়ার কহাঁ’। দেব আনন্দের সঙ্গে রাজ খোসলার ‘কালা পানি’ (১৯৫৮)-তে অসাধারণ অভিনয়ের জন্য পান ফিল্মফেয়ার পুরস্কার।

নলিনী জয়ন্ত। এক্স থেকে

ব্যক্তিগত জীবনে ঝড়
কৈশোরেই বিয়ে করেন তাঁর প্রথম পরিচালক বিরেন্দ্র দেশাইকে—যিনি বয়সে অনেক বড় এবং বিবাহিত ছিলেন। এই সম্পর্কের কারণে নলিনীকে পরিবার থেকে ত্যাজ্য হতে হয়। বিয়ের পর তাঁরা আলাদা হয়ে যান, আর নলিনী ফেরেন সিনেমায়। এরপর অশোক কুমারের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের গুঞ্জন শোনা যায়, যা একসময় এতটাই গভীর হয় যে তাঁরা নেপালে পালিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনাও করেছিলেন বলে হিন্দুস্তান টাইমসের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ ছিল।

আরও পড়ুন

নিঃসঙ্গতার শুরু ও চূড়ান্ত বিচ্ছিন্নতা
১৯৬৫ সালে ‘বোম্বে রেস কোর্স’ ছবির পর সিনেমা থেকে অবসর নেন নলিনী জয়ন্ত।
প্রায় ১৮ বছর পর, ১৯৮৩ সালে অমিতাভ বচ্চনের ‘নাস্তিক’ ছবিতে মায়ের চরিত্রে ফিরে আসেন, কিন্তু পরে আফসোস করে বলেছিলেন, ‘এই সিদ্ধান্ত আমার ভুল ছিল। আমাকে যে চরিত্রের কথা বলা হয়েছিল, ছবিতে সেটি সম্পূর্ণ বদলে যায়।’
স্বামী প্রভু দয়ালের মৃত্যুর পর তিনি সমাজ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। একসময়ের চেনা মুখটি হারিয়ে যান আলো-ঝলমলের জগৎ থেকে।

নলিনী জয়ন্ত। এক্স থেকে

নীরব মৃত্যু
২০১০ সালে, চেম্বুরের ছোট্ট এক বাংলোয় নিঃসঙ্গ অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন নলিনী জয়ন্ত। তিন দিন পর প্রতিবেশীরা দুর্গন্ধ টের পেয়ে পুলিশে খবর দেয়। তাঁর এক দূর সম্পর্কের আত্মীয় এসে মরদেহ নিয়ে যান। প্রতিবেশীরা জানান, ‘বাড়িটা তখন অন্ধকার, তালাবদ্ধ। চাকরেরা চলে গেছে, আর নলিনীজির প্রিয় কুকুরগুলো রাস্তায় ঘুরছে।’ সেই কুকুরগুলোকেই আশ্রয় দিয়েছিলেন পাশের বাসিন্দারা—নলিনীর মৃত্যুর নিঃশব্দ সাক্ষী তারা।
তথ্যসূত্র: ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, ইন্ডিয়াডটকম