সারা জীবনের সঞ্চয় খুইয়ে হতাশায় বাবার মৃত্যু, দুই সন্তানের দুর্দান্ত প্রত্যাবর্তন
বলিউডের বি-গ্রেড অ্যাকশন সিনেমার নির্মাতা কামরান খান একসময় মূলধারার ছবিতে নাম লেখানোর সিদ্ধান্ত নেন। সঞ্জীব কুমারকে নিয়ে একটি বড় বাজেটের ছবি শুরু করেন এবং তাতে নিজের জীবনের সব সঞ্চয় ঢেলে দেন। কিন্তু মাঝপথে সঞ্জীব কুমার প্রজেক্ট ছেড়ে চলে গেলে সবকিছু ভেঙে পড়ে। দেনায় ডুবে যান কামরান। এই হতাশা থেকে শুরু হয় মদ্যপান। শেষ পর্যন্ত এ পরিস্থিতিই কেড়ে নেয় তাঁর জীবন। তবে আরও কয়েক দশক পরে তাঁর দুই সন্তানের রাজকীয় উত্থান হয় বলিউডে।
১৯৬০ ও ৭০-এর দশকে দারা সিংকে নিয়ে ‘বেকসুর’, ‘ওয়াতন সে দুর’, ‘ইলজাম’, ‘পঞ্চরতন’-এর মতো অ্যাকশনধর্মী বি-গ্রেড ছবি বানাতেন অভিনেতা ও স্টান্টম্যান কামরান খান। তবে দ্বিতীয় সন্তানের জন্মের পর আয় বাড়াতে তিনি মূলধারায় আসার সিদ্ধান্ত নেন। এটাই হয়ে দাঁড়ায় জীবনের সবচেয়ে ভুল সিদ্ধান্ত। বাড়ি বন্ধক রেখে, যা কিছু ছিল তা দিয়ে নতুন এক ছবি শুরু করেন আর প্রধান চরিত্রে নেন সঞ্জীব কুমারকে। কিন্তু শুটিংয়ের মাঝপথে সঞ্জীব ছবি থেকে সরে যান। এর সঙ্গে সঙ্গে ধসে পড়ে কামরান খানের স্বপ্ন। লাখ লাখ টাকার দেনা, সংসার ভাঙনের পথে, মদে ডুবে যাওয়া, দীর্ঘ এক দশক কাজহীন জীবন—সব মিলিয়ে বিয়োগান্ত মৃত্যু হয় তাঁর।
কামরান খানের দুই সন্তান ফারাহ খান ও সাজিদ খান তখন কিশোর। বাবার মৃত্যুর পর নিজেদের জীবিকা নিজেরা চালাতে বাধ্য হন। বাড়িতে দাফনের খরচ জোগানোর মতো টাকাও ছিল না। তখন বন্ধুবর লেখক সেলিম খান কিছু টাকা দেন। তাঁরই সন্তান আজকের সালমান খান।
কঠিন শৈশব
সম্প্রতি অজন্তা ইলোরা চলচ্চিত্র উৎসবে অংশ নিয়ে কামরান খানের মেয়ে নির্মাতা ও কোরিওগ্রাফার ফারাহ খান স্মরণ করেন কঠিন শৈশবের কথা, ‘ছোটবেলায় যখন বাসায় ঝগড়া চলত, মা-বাবা আলাদা হচ্ছিলেন, তখন একমাত্র আনন্দ পেতাম সিনেমা হলে গিয়ে তিন ঘণ্টা সিনেমা দেখে। মনমোহন দেশাই বা নাসির হোসেনের “পটবয়লার” ছবিই ভালো লাগত।’
ফারাহ আরও বলেন, ‘আমার বাবার নাম কেউ জানে না। কারণ, তিনি দারা সিংকে নিয়ে বি-গ্রেড সিনেমা বানাতেন। নামগুলো ছিল “রবিন হুড কামস টু বম্বে”, “টারজান কামস টু বম্বে”—দারা সিং বম্বের রাস্তায় টারজানের মতো পোশাকে ঘুরে বেড়াতেন। এরপর যা হওয়ার তাই হলো—সব টাকা এক ছবিতে ঢেলে দিলেন, বাড়ি পর্যন্ত বন্ধক, আর ছবিটা ডুবল। সব শেষ। পরবর্তী ১৩-১৪ বছর কাজই করেননি। ঘর থেকেও বের হতেন না।’
সাংবাদিক করণ থাপারের সঙ্গে এক পুরোনো আলাপে ফারাহ বলেন, ‘বাবা মারা যান পকেটে মাত্র ৩০ রুপি নিয়ে। একসময় আমি খুব ন্যাওটা ছিলাম, যা চাইতাম তা পেতাম। হঠাৎ সব পাল্টে গেল। শুধু বাড়িটা থেকে গেল, বাকি সব—গাড়ি, মায়ের গয়না, গ্রামোফোন—চলে গেল। একসময় বাড়িতে রইল দুটো সোফা আর একটা ফ্যান। এমনও হয়েছে, ড্রয়িংরুম ভাড়া দিয়ে কিটি পার্টি করা হতো, কিছু টাকা পেতাম।’
‘সিনেমাই আমাদের জীবন’
কামরান খানের আরেক সন্তান নির্মাতা সাজিদ খান ইউটিউব চ্যানেল ‘টাইমআউট উইথ অঙ্কিত’-এ দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘আমার জন্মের সময় বাবার প্রথম সিনেমা ফ্লপ হয়। তখন ভেবেছিলেন, এখন দুই সন্তান, বড় কিছু করা দরকার। তখনই তিনি সঞ্জীব কুমারকে নিয়ে বড় ছবি বানানোর উদ্যোগ নেন। কিন্তু ছবিটা তৈরি হয়নি। মাঝপথে সঞ্জীব কুমার পালিয়ে যান। সব টাকা হারিয়ে বাবা মদে ডুবে যান, মা-বাবার বিবাহবিচ্ছেদ হয়। আমি নানা-নানির বাড়িতে থাকতে শুরু করি।’
বাবা মারা যাওয়ার পরের অভিজ্ঞতা বলার সময় সাজিদ বলেন, ‘মঙ্গলবার বাবা মারা যান। আমি বয়স তখন মাত্র ১৪। কিন্তু চিন্তা করছিলাম শুক্রবার রাজেশ খান্নার “নয়া কদম” ছবির টিকিট কেটেছি, যাব কি না! বন্ধুকে বললে সে টিকিট ছিঁড়ে ফেলে। আজও মনে হয়, ভুল ছিল কি? কিন্তু বাবা এমনই ছিলেন—সিনেমাই আমাদের জীবন।’
দাফনের টাকাও ছিল না
‘১৯৮৪ সালে আমরা ছিলাম কিশোর-কিশোরী—ফারাহ ১৭, আমি ১৪। আমাদের মাথার ওপর ছিল তিন লাখ রুপির ঋণ। কীভাবে টাকা রোজগার করব, কিছু জানতাম না। পরে সিদ্ধান্ত নিই—একটু একটু করে শোধ করব। ফারাহ তখন নাচ শেখানো শুরু করে, আমি পার্টিতে নকল আওয়াজ করে পারফর্ম করতাম। রোববারে সমুদ্রসৈকতে পারফর্ম করতাম। ওই টাকায় সিনেমা দেখতাম’, বলেন সাজিদ খান।
তাঁদের কষ্টের সময়ের কথা স্মরণ করে সাজিদ আরও বলেন, ‘আমরাই ছিলাম পাড়ার একমাত্র পরিবার, যাদের টিভি ছিল না। একটাই ফ্যান ছিল। এমনও সময় গেছে, বিদ্যুৎ বিল দিতে না পেরে দুই সপ্তাহ অন্ধকারে ছিলাম। ফারাহ আর আমি হলে ঘুমাতাম। মা তখন এক হোটেলে কাজ করতেন আর আলাদা থাকতেন।’
সাজিদ আরও জানান, তাঁদের অবস্থা এতটাই খারাপ ছিল যে কামরান খান মারা যাওয়ার পর দাফনের খরচও ছিল না। তিনি বলেন, ‘বাবা মারা যাওয়ার পর আত্মীয়ের কাছে গিয়ে দাফনের জন্য টাকা চাইলাম। কেউ দেয়নি। সেলিম আঙ্কেল—মানে সালমানের বাবা, তিনিই টাকা দিয়েছিলেন’, বলেন সাজিদ।
দুর্দান্ত প্রত্যাবর্তন
ফারাহ খান কোরিওগ্রাফার হিসেবে বলিউডে পরিচিত হয়ে ওঠেন, পরে পরিচালনা করেন ‘ম্যায় হুঁ না’, ‘ওম শান্তি ওম’—শাহরুখ খান অভিনীত ব্লকবাস্টার দুটি ছবি। সাজিদ খানও একাধিক হিট ছবি পরিচালনা করেন, তবে যৌন হেনস্তার অভিযোগ ওঠে। এরপর আর কোনো ছবি পরিচালনা করেননি।
এই দুই ভাইবোনের জীবনের গল্প বলিউডের রূপকথার মতোই শূন্য থেকে শুরু করে বলিউডের প্রভাবশালী নাম হয়ে ওঠা।
তথ্যসূত্র: ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস