ইরফান খানের একমাত্র জাতীয় পুরস্কার পাওয়া সিনেমার গল্পটা জানেন কি

‘পান সিং তোমার’ সিনেমার দৃশ্য। আইএমডিবি

সিনেমা এমন একটি শক্তিশালী মাধ্যম, যা মানুষকে জীবনের বড় সিদ্ধান্ত নিতে অনুপ্রাণিত করতে পারে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সেটা উল্টোও ঘটতে পারে। কেমন সেটা? এই যেমন সিনেমা বাস্তব জীবন থেকে অনুপ্রেরণা নেয়, অনেক সময় সিনেমার গল্প থেকেই আমরা অনুপ্রাণিত হই। কিন্তু কিছু মানুষের জীবনের গল্প এতই অসাধারণ যে তা বড় পর্দাকে করে তোলে অনন্য।
এমনই এক জীবন ছিল পান সিং তোমারের। ভারতের সাতবারের জাতীয় স্টিপলচেজ চ্যাম্পিয়ন পান সিং তোমার ছিলেন সেনাবাহিনীর সুবেদার। ঘটনাচক্রে যিনি পরে হয়ে ওঠেন ভয়ংকর দস্যু। তাঁর জীবনের গল্পই ভারতের প্রয়াত অভিনেতা ইরফান খান ফুটিয়ে তুলেছিলেন অনন্যভাবে। এই ক্রীড়াবিদের নামেই সিনেমার নাম ‘পান সিং তোমার’ রাখা হয়। যে চরিত্র ইরফানকে এনে দিয়েছে একমাত্র জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। চলুন পান সিং তোমারকে খুঁজে পাওয়ার গল্প জেনে আসি:

কে এই পান সিং তোমার
পান সিং তোমারের জন্ম ভারতের মধ্যপ্রদেশের চম্বল নদীর তীরে ভিদোসা গ্রামে। তিনি ছিলেন সেই ভয়ংকর চম্বল অঞ্চলের সন্তান, যা ছিল দস্যুরানি ফুলন দেবীর অভয়ারণ্য। ফুলন দেবীর জীবন নিয়েই তৈরি হয়েছিল শেখর কাপুরের জাতীয় পুরস্কারজয়ী চলচ্চিত্র ‘ব্যান্ডিট কুইন’।

‘পান সিং তোমার’ সিনেমার দৃশ্য। আইএমডিবি

অনেকের মতো পান সিংও সেনাবাহিনীতে যোগ দেন সুবেদার হিসেবে। কিন্তু তাঁর অসাধারণ দৌড়ানোর ক্ষমতা তাঁকে দ্রুত আলাদা করে তোলে এবং তিনি হয়ে ওঠেন এক অনন্য ক্রীড়াবিদ। তিনি ১৯৫৮ সালে টোকিও এশিয়ান গেমসে ভারতকে প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন। তবে ভালো করতে পারেননি। কারণ, প্রতিযোগিতার মাত্র দুই দিন আগে তাঁকে নতুন জুতা দেওয়া হয়েছিল। মিলখা সিংয়ের সমসাময়িক এই ক্রীড়াবিদ পরবর্তী সময়ে সাতবার জাতীয় স্টিপলচেজ চ্যাম্পিয়ন হন।

জীবনে নেমে এল অন্ধকার
সেনা ও ক্রীড়াজীবনে সাফল্যের পর পান সিং তোমারের জীবনে নেমে আসে অন্ধকার। পারিবারিক জমিজমা নিয়ে চাচা বাবু সিংয়ের সঙ্গে বিরোধের কারণে তিনি আগেভাগেই অবসর নিতে বাধ্য হন। সমাধানের আশায় তিনি পঞ্চায়েত, কালেক্টর ও আদালতের আশ্রয় নেন। কিন্তু দুর্নীতি তাঁকে হতাশ করে তোলে। এমনকি বিভিন্ন সময় তাঁর পদক ও সার্টিফিকেট নিয়েও বিদ্রূপ করা হয়। অবশেষে যখন তাঁর মা ও ছেলেকে চাচা বাবু সিং ও তাঁর লোকেরা প্রহার করেন, তখন পান সিং নিজেই হাতে তুলে নেন অস্ত্র। প্রতিশোধ নিতে তিনি ২৮ জনের একটি দস্যু দল গঠন করেন।

‘পান সিং তোমার’ সিনেমার দৃশ্য। আইএমডিবি

১৯৭৭ সালে ভাই খুন হওয়ার পর পান সিং ও তাঁর দল প্রতিশোধ নিতে গোয়ালিয়রের কাছে পাওয়া পোটা নামের একটি গ্রামে নয়জনকে হত্যা করে। এরপর প্রশাসন তাঁর মাথার দাম ঘোষণা করে ১০ হাজার টাকা। অবশেষে ১৯৮১ সালে ১২ ঘণ্টা ধরে চলা এক এনকাউন্টারে তিনি নিহত হন। জানা যায়, গুলিবিদ্ধ অবস্থায় মৃত্যুর আগে তিনি পুলিশের কাছে পানি চেয়েছিলেন, কিন্তু পুলিশ তা দিতে অস্বীকার করে।

‘ব্যান্ডিট কুইন’-কে খুঁজতে গিয়ে
পরিচালক তিগমাংশু ধুলিয়া শেখর কাপুরের ‘ব্যান্ডিট কুইন’-এর জন্য গবেষণা করার সময় পান সিং তোমারের গল্প আবিষ্কার করেছিলেন। তিনি এক প্রবন্ধে পান সিংয়ের সম্পর্কে পড়ে সিদ্ধান্ত নেন, এই গল্পকে চলচ্চিত্রে রূপ দেবেন। কিন্তু কাজটি সহজ ছিল না। কারণ, একজন সুবেদার হলেও পরবর্তী জীবনে পান সিং দস্যু হয়ে যাওয়ায় সরকারি দপ্তরে তাঁর কোনো নথিই ছিল না।

‘পান সিং তোমার’ সিনেমার দৃশ্য। আইএমডিবি

পরিচালক তিগমাংশু ধুলিয়া একটি সাক্ষাৎকারে গণমাধ্যম রেডিফকে বলেন, ‘আমি এই সিনেমার চিত্রনাট্য ঘরে বসে লিখতে পারিনি। কারণ, এটার জন্য গবেষণা দরকার ছিল। কিন্তু কোনো প্রযোজকই গবেষণায় টাকা খরচ করতে রাজি ছিলেন না। কারণ, বলিউডে এমন গল্পকে কেউ উৎসাহ দেয় না।’
এমন সময় পাশে এসে দাঁড়ায় ইউটিভি স্পটবয়। প্রতিষ্ঠানটি তিগমাংশুকে অর্থায়ন করে। ধুলিয়ার দল তোমারের স্ত্রী ইন্দ্রা ও ছেলের সঙ্গে দেখা করে। তবে তাঁদের রাজি করানো সহজ ছিল না। তিগমাংশু বলেন, ‘আমরা কিছু দস্যুর সঙ্গে দেখা করি। যারা বলেছিল তাদের নিয়েই সিনেমা বানাতে; কারণ, তারা অনেক অপহরণ ও খুন করেছে। আমরা সাবেক দস্যু মোহর সিংয়ের সঙ্গেও দেখা করি তথ্য সংগ্রহের জন্য। তাঁর কাছ থেকে ফেরার পথে এক প্রহরী আমাদের বলেছিলেন কীভাবে পান সিং মারা গিয়েছিলেন।’
পান সিং তোমারকে নিয়ে গবেষণা করতে তিগমাংশুর প্রায় দুই দশক লেগে যায়।

আহত ও হতাশ ইরফান খান
শারীরিকভাবে বেশ কঠিন ছিল ‘পান সিং তোমার’ সিনেমার শুটিং। এ সময় ইরফান খান বারবার আঘাত পান। জাতীয় কোচ সৎপল সিংয়ের কাছে স্টিপলচেজের প্রশিক্ষণও নেন।
সিনেমাটি নিয়ে বলতে গিয়ে ইরফান খান ফিল্ম কম্প্যানিয়নকে জানান, ‘শুটিং চলাকালে আমি এতবার আঘাত পেয়েছি, আপনি বিশ্বাস করবেন না। হঠাৎ হাঁটতে গিয়ে পিঠে টান, ক্রিকেট খেলতে গিয়ে টেনিস বল চোখে লেগে যায়, লিগামেন্ট ছিঁড়ে যায়...সিনেমাটা যেন ভিন্নভাবে আমার পরীক্ষা নিচ্ছিল।’ ইরফানের মতে, এই কষ্ট আসলে পান সিংয়ের জীবনের প্রতিফলন। একটা মানুষ যিনি পরিশ্রম করে খ্যাতি পান কিন্তু স্বীকৃতি পান না, যতক্ষণ না তিনি বিদ্রোহের পথ বেছে নেন।

‘পান সিং তোমার’ সিনেমার পোস্টার। আইএমডিবি

ইরফান আরও বলেন, ‘পান সিংয়ের জীবনে ঠিক যেমনটা ঘটেছিল, তেমনটাই ঘটেছিল সিনেমাটির কপালে। তিনি জাতীয় চ্যাম্পিয়ন ছিলেন, কিন্তু কেউ তাঁর নাম জানত না। সিনেমাটি বানানো থেকে শুরু করে মুক্তি পাওয়া পর্যন্তও একই ঘটনা ঘটে। সিনেমাটি বানানো শেষ হয়েছে, সবাই ভালো বলছে, কিন্তু মুক্তি পাচ্ছে না। এটা নিয়ে এতটাই হতাশ হয়ে পড়েছিলাম যে ৮-৯ মাস পর কেউ ওই সিনেমার কথা তুললে বলতাম, আমি পান সিংকে ভুলে গেছি, ওর কথা বোলো না।’

আরও পড়ুন

সীমিত বাজেটের স্লিপার হিট সিনেমা
‘পান সিং তোমার’ মাত্র ৭ কোটি টাকার সীমিত বাজেটে নির্মিত হয় এবং মাত্র ৬৫ দিনেই শুটিং শেষ হয়। লোকেশন ছিল চম্বল ভ্যালি, ধৌলপুরের জঙ্গল, জিম করবেট ন্যাশনাল পার্ক, রুরকি ও দেরাদুন। দুই বছর পর যখন ‘পান সিং তোমার’ মুক্তি পায়, তখন বলতে গেলে প্রচারও ছিল না। লোখান্ডওয়ালায় একটিমাত্র পোস্টারে ইরফানকে হাতে টাকাভর্তি ব্যাগ নিয়ে দৌড়াতে দেখা যায়। তবে সিনেমাটির গল্প দর্শকদের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে এবং হয়ে ওঠে স্লিপার হিট (সিনেমার ক্ষেত্রে নীরবে মুক্তি পাওয়ার পর আশ্চর্যজনক সাফল্য অর্জন)। ৭ কোটি টাকায় তৈরি এই সিনেমা আয় করে প্রায় ১৭ কোটি টাকা এবং সমালোচকদের ব্যাপক প্রশংসা অর্জন করে। শুধু তা-ই নয়, ৬০তম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে এটি সেরা পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের পুরস্কার জেতে আর ইরফান খান শ্রেষ্ঠ অভিনেতা হিসেবে পান তাঁর জীবনের একমাত্র জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার।

তথ্যসূত্র: ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস