‘বিকিনি কিলার’ চার্লস শোবরাজ নিয়ে অনেকগুলো আসল ও ভয়ংকর গল্প

‘বিকিনি কিলার’ বলা হতো শোবরাজকে। কারণ, চার্লস শোবরাজ মূলত পশ্চিমা নারী পর্যটকদের লক্ষ্য করতেনকোলাজ

মনোজ বাজপেয়ী নামটা দেখেই সিনেমাটা দেখা। আবার নেটফ্লিক্সে আছে। তাই পথে, যানজটে, মেট্রোতে, এখানে-সেখানে বসে সহজেই দেখা সম্ভব। চোর-পুলিশের সেই প্রচলিত কাহিনি। তবে সিনেমার শুরুতেই বলা আছে, সত্য ঘটনা অবলম্বনে। সুতরাং সিনেমাটা নিয়ে বাড়তি কিছু বলাই যায়। সিনেমার নাম ‘ইন্সপেক্টর জেনডে’। তিনি মুম্বাই পুলিশের একজন ইন্সপেক্টর, কার্ল ভোজরাজ নামের এক কুখ্যাত সিরিয়াল কিলারকে ধরার দায়িত্ব পেয়েছেন। এই কার্ল আবার সুইমস্যুট কিলার নামে পরিচিত।

এবার আসল গল্প। ইন্সপেক্টর জেনডের পুরো নাম মাধুকর জেনডে। তবে কার্ল ভোজরাজ আসলে চার্লস শোবরাজ, তিনি কুখ্যাতি পেয়েছিলেন ‘বিকিনি কিলার’ হিসেবে। আর সিনেমাটা খুব সিরিয়াস ভঙ্গিতে বানানো হয়নি; বরং হাস্যরসাত্মক উপাদান আছে অনেক। অর্থাৎ কমেডি জনরার সিনেমা। যাঁরা সিনেমাটি দেখেননি বা শোবরাজ নিয়ে জানেন কম, তাঁদের আগেই সতর্ক করছি—লেখাটির মধ্যে যথেষ্ট স্পয়লার আছে। যদিও চার্লস শোবরাজকে নিয়ে অনেক লেখালেখি ও সিনেমা হয়েছে। সুতরা অনেকেই সবকিছু জানেন। তবে সে তুলনায় ইন্সপেক্টর জেনডে কম আলোচিত। সেই কম আলোচিত অধ্যায় নিয়েই নেটফ্লিক্সের সিনেমা—‘ইন্সপেক্টর জেনডে’।

কে এই চার্লস শোবরাজ

সহজলভ্য ইন্টারনেটের এই যুগে চার্লস শোবরাজকে নিয়ে জানা কঠিন কোনো কাজ নয়। তাঁকে নিয়ে অসংখ্য লেখালেখি হয়েছে। আর বলিউডের সিনেমাটি মুক্তি পাওয়ায় নতুন করে আবার লেখালেখি শুরুও হয়েছে। যেমন টাইম ম্যাগাজিনে গত ৫ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত লেখাটির শিরোনাম হচ্ছে, ‘চার্লস শোবরাজ ও নেটফ্লিক্সের ইন্সপেক্টর জেনডের আসল গল্প’। সেখান থেকে কিছু তথ্য উল্লেখ করছি।

‘ইন্সপেক্টর জেনডে’র দৃশ্য। আইএমডিবি

দশকের পর দশক ধরে চার্লস শোবরাজ ‘দ্য সার্পেন্ট’ নামে পরিচিত ছিলেন। কারণ, তিনি বারবার পুলিশের হাত থেকে পালিয়ে যেতেন। শোবরাজ ছিলেন এশিয়ার সবচেয়ে ভয়ংকর অপরাধীদের একজন। ১৯৪৪ সালে ফরাসি–শাসিত ভিয়েতনামের সায়গনে (বর্তমান হো চি মিন সিটি) জন্ম নেওয়া শোবরাজ প্রথম গ্রেপ্তার হন ১৯৬৩ সালে প্যারিসে, চুরির অভিযোগে। পরের বছরগুলোতে তিনি ফ্রান্স, গ্রিস, তুরস্ক, ইরান, আফগানিস্তান, পাকিস্তান, নেপাল, ভারত, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়াসহ বহু দেশে অপরাধে জড়ান এবং বহুবার কারাগার থেকেও পালিয়ে যান।

‘বিকিনি কিলার’ বলা হতো শোবরাজকে। কারণ, চার্লস শোবরাজ মূলত পশ্চিমা নারী পর্যটকদের লক্ষ্য করতেন। ১৯৭০-এর দশকে এশিয়ার ‘হিপি ট্রেইল’ পথে ঘুরতে আসা তরুণ-তরুণীদের তিনি মাদক খাইয়ে, লুট করে হত্যা করতেন। ধারণা করা হয়, তিনি ৩০ জনের বেশি মানুষকে হত্যা করেছিলেন। এসব হত্যাকাণ্ডের বেশির ভাগ ঘটনা ঘটেছিল ভারত, নেপাল ও থাইল্যান্ডে।

এখন ‘হিপি ট্রেইল’ প্রসঙ্গ। কারণ, চার্লস শোবরাজের অপরাধের সঙ্গে এর গুরুত্বপূর্ণ সংযোগ রয়েছে। ১৯৬০ থেকে ১৯৭০-এর দশকে পশ্চিমা তরুণদের মধ্যে এক বিশেষ ভ্রমণপথ জনপ্রিয়তা পায়, যা ইতিহাসে পরিচিত ‘হিপি ট্রেইল’ নামে। ইউরোপ থেকে শুরু হয়ে এটি তুরস্ক, ইরান, আফগানিস্তান, পাকিস্তান হয়ে ভারতের দিল্লি ও নেপালের কাঠমান্ডু পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। অনেকেই এখান থেকে আরও দক্ষিণে গোয়া বা শ্রীলঙ্কা পর্যন্ত যেতেন।

এই পথ ধরে একদল তরুণ যাত্রা করতেন, যাঁরা পশ্চিমা সমাজের ভোগবাদ, যুদ্ধবিরোধী রাজনীতি ও কঠোর সামাজিক নিয়ম থেকে মুক্তি খুঁজছিলেন। তাঁরা নিজেদের বলতেন ‘হিপি’। অর্থাৎ যাঁরা শান্তি, ভালোবাসা ও আধ্যাত্মিকতার অনুসন্ধানে ছিলেন। তাঁদের জন্য ভারত ও নেপাল ছিল আত্ম-অন্বেষণের কেন্দ্র। কেউ ঋষিকেশ বা বেনারসে যেতেন যোগ ও ধ্যান শেখার জন্য, কেউ গোয়ায় যেতেন স্বাধীন জীবনযাপনের স্বপ্নে। ১৯৭৯ সালে ইরানে ইসলামি বিপ্লব ও আফগানিস্তানে যুদ্ধ শুরু হলে হিপি ট্রেইল কার্যত বন্ধ হয়ে যায়।

যাঁরা জিনাত আমান–ভক্ত, তাঁরা তো কারণে-অকারণে দেব আনন্দের ‘হরে রামা হরে কৃষ্ণা’ সিনেমার ‘দম মারো দম’ গানটি দেখে নেন। এ সিনেমায় লাস্যময়ী জিনাত আমান ছিলেন এ রকম এক হিপি ট্রেইলেরই সদস্য।

চার্লস শোবরাজ: টাইমলাইন

২০২২ সালের ২৩ ডিসেম্বর আল–জাজিরা চার্লস শোবরাজের জীবন নিয়ে একটি টাইমলাইন প্রকাশ করেছিল। সেটি এখানে সংক্ষেপে উল্লেখ করা হলো।

১৯৪৪: জন্ম—৬ এপ্রিল ১৯৪৪ সালে তিনি ভিয়েতনামের সায়গনে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা ছিলেন ভারতীয় ও মা ভিয়েতনামি। পরে তাঁর মা এক ফরাসিকে বিয়ে করেন।

১৯৬৩: অপরাধজীবনের সূচনা—১৮ বছর বয়সে প্রথম কারাগারে যান, পরে বিয়ে করেন, একটি সন্তানের জন্ম হয়, কিন্তু অপরাধই হয়ে ওঠে তাঁর পেশা। তাঁর মা বলেছিলেন, ‘তার মুখে ফেরেশতার হাসি, কিন্তু মনে যেন শয়তান বাসা বেঁধেছে।’ ১৯৬৩ সালে তিনি আন্তর্জাতিক অপরাধজীবনে পা রাখেন। এ সময় তিনি গ্রিস, তুরস্ক, ইরান, পাকিস্তান, আফগানিস্তানসহ নানা দেশে ভ্রমণ করেন।

চার্লজ শোবরাজ। এএফপি ফাইল ছবি

১৯৭০: ভারতে আগমন—১৯৭০ সালে তিনি ভারতে চলে আসেন। পরের বছর এক গয়নার দোকানে চুরির অভিযোগে গ্রেপ্তার হন। জামিনে মুক্তি পেয়ে তিনি পালিয়ে যান গ্রিসে, যেখানে আবার গ্রেপ্তার হন। কিন্তু সেখান থেকেও পালিয়ে যেতে সক্ষম হন।

১৯৭৫: থাইল্যান্ডের ‘বিকিনি কিলার’—১৯৭৫ সালে শোবরাজ তাঁর কানাডীয় প্রেমিকা ও এক ভারতীয় সহযোগীকে নিয়ে ব্যাংককে আসেন।

তিনি নিজেকে ‘মূল্যবান পাথরের ব্যবসায়ী’ হিসেবে পরিচয় দিতেন এবং পর্যটকদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতেন।

ওই বছরের অক্টোবরে থাইল্যান্ডের পাতায়া সমুদ্রসৈকতে এক তরুণীর দেহ পাওয়া যায়—তিনি বিকিনি পরে ছিলেন। এরপর আরও কয়েকজনকে হত্যা করা হয়। কাউকে পিটিয়ে, কাউকে শ্বাস রোধ করে আবার কাউকে আগুনে পুড়িয়ে মারা হয়। তারপরই তিনি বিকিনি কিলার হিসেবে পরিচিতি পান।

শোবরাজ নিহত ব্যক্তিদের পাসপোর্ট ব্যবহার করে মূল্যবান পাথর ও মাদক চোরাচালানের কাজ করতেন। সন্দেহ দেখা দিলে তিনি থাইল্যান্ড ছেড়ে ভারতে পালিয়ে আসেন।

১৯৭৬: ভারতে গ্রেপ্তার—১৯৭৬ সালের জুলাই মাসে নয়াদিল্লির এক হোটেলে ২০ জনের বেশি ফরাসি পর্যটককে ওষুধ খাইয়ে অচেতন করার চেষ্টা করার সময় তিনি ধরা পড়েন। এ ছাড়া মুম্বাইয়ের এক হোটেলে বিষ প্রয়োগে ফরাসি নাগরিক লুক সালোমন নামের এক ব্যক্তিকে হত্যার অভিযোগও তাঁর বিরুদ্ধে ওঠে।

১৯৮২ সালের মে মাসে ভারতীয় আদালত ১৯৭৬ সালে ইসরায়েলি পর্যটক অ্যালান জ্যাকবকে হত্যার দায়ে তাঁকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন। তবে প্রমাণের অভাবে ১৯৮৩ সালে আপিলে তিনি খালাস পান, কিন্তু অন্যান্য অপরাধের কারণে কারাগারেই থাকতে হয়।

১৯৮০-৮৫: থাইল্যান্ডের প্রত্যর্পণ দাবি—১৯৮৫ সালের শেষ দিকে থাইল্যান্ড সরকার শোবরাজকে হস্তান্তরের দাবি জানায়। তাদের অভিযোগ ছিল, তিনি সেখানে একজন তুর্কি নাগরিক ও এক মার্কিন নারী টেরেসা নোল্টনকে হত্যা করেছেন। থাইল্যান্ডে তাঁর মৃত্যুদণ্ড হওয়ার আশঙ্কা ছিল।

১৯৮৬: দিল্লি থেকে জেল ভাঙা—১৯৮৬ সালের মার্চে দিল্লির তিহার জেল থেকে তিনি পালিয়ে যান। তিনি জেলরক্ষীদের মিষ্টির সঙ্গে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে খাইয়ে অচেতন করেন। কয়েক দিন পর গোয়া রাজ্যের এক রেস্টুরেন্টে তাঁকে আবার ধরা হয়। আজও সেই রেস্টুরেন্টে তাঁর একটি মূর্তি রাখা আছে তাঁর পরিচিতি ক্যাপসহ।

১৯৯৭ সালে যখন তিনি ভারতীয় কারাগার থেকে মুক্তি পান, তখন তাঁর বিরুদ্ধে থাইল্যান্ডের অভিযোগগুলোর সময়সীমা শেষ হয়ে গিয়েছিল।

১৯৯৭: মুক্তি ও ফ্রান্সে ফেরা—১৯৯৭ সালে মুক্তি পেয়ে তিনি ফ্রান্সে চলে যান এবং কয়েক বছর শান্তভাবে সেখানেই বসবাস করেন।

২০০৩-০৪: আবার ধরা—২০০৩ সালে তিনি নেপালে ফিরে যান, সেখানে ভুয়া নামে এক শাল রপ্তানি কোম্পানি খোলেন। তবে খুব দ্রুত তাঁকে চিনে ফেলে পুলিশ এবং ১৯৭৫ সালে দুই পর্যটক—কানাডীয় লরেন্ট আরমান্ড ক্যারিয়ার ও মার্কিন কননি জো ব্রনজিচকে হত্যার দায়ে গ্রেপ্তার করে।

২০০৪ সালের আগস্টে শোবরাজকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। তিনি ২০ বছরের সাজা থেকে ১৯ বছর কারাগারে কাটান।

২০০৮: জেলেই বিয়ে—২০০৮ সালে, কারাগারে থাকাকালে, তিনি নিজের চেয়ে ৪৪ বছর কম বয়সী নেপালি নারী নিহিতা বিশ্বাসকে বিয়ে করেন।

২০২২: মুক্তি—২১ ডিসেম্বর ২০২২ সালে নেপালের সর্বোচ্চ আদালত অসুস্থতার কারণে তাঁর মুক্তির নির্দেশ দেন। ২৩ ডিসেম্বর তিনি মুক্তি পান এবং ফ্রান্সে ফিরে যান। এখনো তিনি সেখানেই আছেন।

চলচ্চিত্রপ্রেমীদের জন্য

যাঁরা সিনেমা দেখতে পছন্দ করেন এবং চার্লস শোবরাজ নিয়ে বিশেষভাবে আগ্রহী, তাঁরা কয়েকটি সিনেমা বা ওয়েব সিরিজ দেখতে পারেন। এর মধ্যে অবশ্যই দেখা দরকার ‘দ্য সার্পেন্ট’। এটি চার্লস শোবরাজের অপরাধজীবনের ওপর নির্মিত একটি ব্রিটিশ ক্রাইম থ্রিলার সিরিজ। আট পর্বের সিরিজটি ২০২১ সালে বিবিসি ওয়ানে প্রচারিত হয় এবং পরে নেটফ্লিক্সে মুক্তি পায়।

‘দ্য সার্পেন্ট’–এর দৃশ্য। আইএমডিবি

গল্পের মূল চরিত্র চার্লস শোবরাজ। একজন ঠান্ডা মাথার প্রতারক ও খুনি। এ কাজে তাঁর সঙ্গী ছিলেন প্রেমিকা মারি-আন্দ্রে লেক্লার ও অজয় নামের একজন ভারতীয়। সিরিজে দেখানো হয়েছে হারম্যান নিপেনবার্গ নামের এক ডাচ কূটনীতিকের অক্লান্ত তদন্ত। তিনিই নিখোঁজ পর্যটকদের খোঁজ করতে গিয়ে ভয়ংকর সব হত্যাকাণ্ডের সূত্র আবিষ্কার করেন। তাঁর উদ্যোগেই আন্তর্জাতিক তদন্ত শুরু হয় এবং শেষ পর্যন্ত শোবরাজের আসল পরিচয় প্রকাশিত হয়ে পড়েছিল।

এর বাইরে বলিউডে একটি সিনেমা হয়েছিল, ‘ম্যায় অউর চার্লস’। রণদীপ হুদা এখানে চার্লস শোবরাজের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। এর বেশি বলা সম্ভব হলো নয়। কারণ, এটি দেখা হয়নি। ভারতীয়রাই যেখানে সিনেমাটি তেমন দেখেননি, সুতরাং আমাদের না দেখাটা দোষের কিছু নয়। এর পরিবর্তে সিনেমাপ্রেমীরা বরং আরেকটি সিরিজ দেখতে পারেন। ‘ব্ল্যাক ওয়ারেন্ট’ নামের সিরিজটা পাবেন নেটফ্লিক্সেই। দিল্লির তিহার জেলের এক নবীন জেলারের গল্প।

এই ফাঁকে মজার একটা ঘটনা বলে নেওয়া যাক। আসলে অনেকেই চার্লস শোবরাজকে নিয়ে সিনেমা বানানোর চেষ্টা করেছেন, কিন্তু কেউ সফল হননি। কারণ, তিনি তাঁর জীবনী স্বত্ব বিক্রি করেছেন। ২০১৫ সালে মুক্তি পাওয়া ক্রাইম থ্রিলার ‘ম্যায় অউর চার্লস’ হলো শোবরাজের জীবনের ওপর নির্মিত প্রথম চলচ্চিত্র। আর কীভাবে এটা সম্ভব হলো?

‘ব্ল্যাক ওয়ারেন্ট’–এর দৃশ্য। আইএমডিবি

সিনেমাটি মুক্তির সময় ২০১৫ সালের ২৫ অক্টোবর কাঠমান্ডুর জেলে চার্লস শোবরাজের সঙ্গে দেখা করেছিলেন রণদীপ। টাইমস অব ইন্ডিয়ায় প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী সে সময় শোবরাজ রণদীপকে বলেছিলেন, ‘আমি কাউকেই আমার জীবনের ওপর সিনেমা বানানোর অনুমতি দিইনি। আমি ফ্রান্সে আমার আইনজীবীর সঙ্গে পরামর্শ করেছিলাম এবং তোমাদের এই সিনেমা থামানোর চেষ্টা করেছি। কিন্তু যেহেতু তুমি আমোদ কান্তের কাছ থেকে (যিনি আমার মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ছিলেন) আইনি অনুমতি নিয়েছ, আমি জানতাম কিছুই করতে পারব না। এটা ছিল তোমার বুদ্ধিমানের কাজ।’

রণদীপ হেসে জবাব দিয়েছিলেন, ‘চার্লস, এই চালাকি তো আমরা তোমার কাছ থেকেই শিখেছি।’ এ কথা শুনে শোবরাজ কিছু না বলে শুধু তাঁর বিখ্যাত হাসিটা দিয়েছিলেন।

সুনীল গুপ্ত: তিহারের ভেতরের রাজা ‘চার্লস শোবরাজ’

‘ব্ল্যাক ওয়ারেন্ট’ মুক্তি পায় ২০২৪ সালে। গল্পটি মূলত ইন্সপেক্টর সুনীল গুপ্ত নামে এক কারা কর্মকর্তার স্মৃতিকথা ‘ব্ল্যাক ওয়ারেন্ট: কনফেশনস অব আ তিহার জেলার’ বই থেকে নেওয়া। প্রথম দিন থেকেই চার্লস শোবরাজের সঙ্গে তাঁর একটা বন্ধুত্ব হয়। কিন্তু এর মধ্যেই চার্লস ঠিকই জেল থেকে পালানোর পরিকল্পনা করতে থাকেন এবং শেষ পর্যন্ত জন্মদিন উদ্‌যাপনের কথা বলে জেলের গার্ডদের ঘুমের ওষুধ খাইয়ে পালিয়েও যান।

বইটিতে সুনীল গুপ্ত লিখেছেন, শোবরাজ ছিলেন বিশেষ সুবিধাভোগী বন্দী। কারাগারের সাধারণ বন্দীদের মতো তাঁর জন্য কোনো নিয়ম ছিল না। শোবরাজ নিজের বুদ্ধি আর প্রভাব ব্যবহার করে তিহারে এক রাজকীয় পরিবেশ তৈরি করেছিলেন। তিনি ধনী কয়েদিদের হয়ে আদালতের আবেদনপত্র লিখে টাকা কামাতেন, জেলরক্ষীদের ঘুষ দিতেন আর গোপনে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের কথোপকথন রেকর্ড করতেন, যেন প্রয়োজনে তাঁদের বিরুদ্ধে প্রমাণ হিসেবে ব্যবহার করতে পারেন। সুনীল গুপ্ত শোবরাজকে ব্যাখ্যা করেছিলেন, ‘একজন হৃদয়হীন প্রতারক, কিন্তু অসাধারণ মনস্তত্ত্ববিদ, যে অপরাধকেও বুদ্ধির খেলা হিসেবে দেখত।’

এবার ‘ইন্সপেক্টর জেনডে’ প্রসঙ্গ

নেটফ্লিক্সের এ সিনেমা তৈরি হয়েছে ভারতের বিখ্যাত পুলিশ কর্মকর্তা মাধুকর জেনডের বাস্তব জীবনের গল্প নিয়ে, যিনি দুবার চার্লস শোবরাজকে ধরেছিলেন। মূল ঘটনাটি আগে জানি।

‘ইন্সপেক্টর ডেনডে’ র দৃশ্য। আইএমডিবি

ভারতে প্রথম গ্রেপ্তার: ১৯৭১ সালের ঘটনা। মুম্বাইয়ের গামদেবী থানার পুলিশ কর্মকর্তা মাধুকর জেনডে কিছু তথ্য পান আজয় পারেখ নামের এক চোরের কাছ থেকে। পারেখ জানান, চার্লস শোবরাজ ও তাঁর দল নিউ ইন্ডিয়া অ্যাসুরেন্স ভবনে একটি ডাকাতির পরিকল্পনা করছে। শোবরাজ তাজমহল প্যালেস হোটেলে উঠেছিলেন। চমৎকার পোশাক পরে নিজেকে ভদ্রলোক হিসেবে পরিচয় দিয়েছেন, যেন কেউ চিনতেই না পারে। সঙ্গে পাঁচজন সহযোগী ছিলেন, যাঁরা কাছাকাছি হোটেলে উঠেছিলেন। পুলিশ অভিযান চালিয়ে তাঁদের গ্রেপ্তার করে। তবে একই বছর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বিদ্যুৎ চলে যাওয়ার সুযোগ নিয়ে তিনি ড্রেন পাইপ ধরে নেমে পালিয়ে যান। অ্যাপেন্ডিসাইটিস হয়েছে বলে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন।

ফরাসি নাগরিক জঁ-লুক সলোমনকে হত্যার অভিযোগে ১৯৭৬ সালে শোবরাজকে ১২ বছরের সাজা দেওয়া হয়। তাঁকে রাখা হয় তিহার জেলে। কারাগারে অবশ্য রাজার হালেই থাকতেন। প্রহরীদের ঘুষ দিয়ে ভালো খাবার ও আরামদায়ক জীবন যাপন করতেন।

আসল জেনডের সঙ্গে সিনেমার জেনডে

গোয়ায় নাটকীয় গ্রেপ্তার: ১৯৮৬ সালে শোবরাজ পালানোর পর আবারও মাধুকর জেনডেকে তাঁকে ধরার দায়িত্ব দেওয়া হয়। জেনডের হাতে গুরুত্বপূর্ণ সূত্র ছিল দুটি। যেমন এক বিদেশি অতিথি (শোবরাজ) সন্দেহজনক বাইসাইকেল ব্যবহার করছে, যার নম্বরপ্লেট ভুয়া। আর স্থানীয় টেলিফোন এক্সচেঞ্জ সূত্রে জানা যায়, শোবরাজ প্রায়ই ও’কোকোয়িরো নামে একটি রেস্তোরাঁয় যাতায়াত করেন, যেখানে বিদেশি পর্যটকেরা ফোন ব্যবহার করতেন। জেনডে ছদ্মবেশে পর্যটক সেজে রেস্তোরাঁটির বাইরে নজরদারি করেন।

অবশেষে ১৯৮৬ সালের ৬ এপ্রিল রাতে জেনডে শোবরাজকে দেখতে পান। টুপি পরে কিছুটা ছদ্মবেশে এলেও শোবরাজকে চিনতে পারেন। জেনডে কাছে গিয়ে শান্তভাবে বলেন, ‘হ্যালো চার্লস, কেমন আছ?’ এর মাধ্যমে তিনি ভারতের অন্যতম সেরা পুলিশ কর্মকর্তা হিসেবে খ্যাতি পান।

এ ঘটনা ধরেই সিনেমা ‘ইন্সপেক্টর জেনডে’।

আসল ইন্সপেক্টর জেনডে যা বলেছিলেন

সম্প্রতি ‘দ্য আওয়ারা মুসাফির শো’ নামের এক অনুষ্ঠানে ৮৬ বছর বয়সী মাধুকর জেনডে তাঁর অভিজ্ঞতার কথা জানান। সেখানে তিনি বিস্তারিতভাবে বলেন কীভাবে তিনি গোয়ায় শোবরাজকে ধরেছিলেন, কী কী ঝুঁকি নিয়েছিলেন। তিনি সেই সময়ের পুলিশিংয়ের ধৈর্য, বুদ্ধি ও দৃঢ়তা সম্পর্কে কথা বলেন আর মনে করিয়ে দেন ‘হ্যালো চার্লস, হাউ আর ইউ’ বলার সেই অবিস্মরণীয় মুহূর্তটিকে। চার্লস শোবরাজের অংশটুকু ছিল এ রকম—

প্রশ্ন :

গোয়ায় চার্লস শোবরাজকে আপনি কীভাবে ধরেছিলেন?

উত্তর: ৬ এপ্রিল আমি হোটেলের গেট দেখছিলাম। এক সাদা ট্যাক্সি এল, দুজন নামল, মাথায় নাইট ক্যাপ। আমি চুপচাপ তাদের পেছনে বসলাম। ট্যাক্সিচালক যখন শোবরাজকে সতর্ক করতে গেল, আমি দৌড়ে গিয়ে ধরে ফেললাম। চিৎকার করে বললাম, ‘চার্লস! মনে আছে আমি সেই জেনডে, তোমাকে ’৭১-এ ধরেছিলাম!’

প্রশ্ন :

গ্রেপ্তারের পর চার্লস শোবরাজকে কীভাবে নিয়ে গিয়েছিলেন?

উত্তর: আমাদের কাছে তখন হাতকড়া ছিল না। তাই রিভলবারের দড়ি আর হোটেলমালিকের দেওয়া সুতা দিয়ে তাকে বেঁধে ফেললাম। কারণ, সে মার্শাল আর্টসে ব্ল্যাক বেল্ট ছিল। গাড়িতে ওকে পেটের ওপর উপুড় করে দুজন কনস্টেবলকে বসিয়ে দিয়েছিলাম।

প্রশ্ন :

গ্রেপ্তারের পর চার্লস শোবরাজের সঙ্গে কী কথা হয়েছিল?

সে ভীষণ অমার্জিত স্বভাবের। একটাই কথা বলেছিল, ‘তোমার কাজ করো। এখন তুমি আমাকে ধরেছ, তুমি অনেক প্রচার পাবে।’

বইপ্রেমীদের জন্য

সিনেমা নয়, যাঁরা বই পড়ে কাউকে জানতে আগ্রহী, তাঁদের জন্য এবার কিছু তথ্য দিচ্ছি। শোবরাজের জীবন ও অপরাধ নিয়ে বেশ কিছু বই লেখা হলেও দুটি নাম সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তাঁরা হলেন অস্ট্রেলিয়ান সাংবাদিক ও লেখক রিচার্ড নেভিল ও জুলি ক্লার্ক।

রিচার্ড নেভিল ছিলেন প্রতিষ্ঠানবিরোধী বিখ্যাত ব্যঙ্গাত্মক ম্যাগাজিন ওজের সহপ্রতিষ্ঠাতা ও সম্পাদক। ১৯৭৭ সালে নেভিল সঙ্গিনী ও সহকর্মী সাংবাদিক জুলি ক্লার্ককে নিয়ে ভারতে আসেন। জুলি ক্লার্ক এবিসি টেলিভিশনে কাজ করতেন। চার্লস শোবরাজ তখন তিহার জেলে বন্দী ছিলেন। তাঁরা তাঁর সরাসরি সাক্ষাৎকার নেন এবং তাঁর জীবন, অপরাধ ও চিন্তাভাবনা ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করেন। সেই অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করেই ১৯৭৯ সালে প্রকাশিত হয় তাঁদের বিখ্যাত বই ‘দ্য লাইফ অ্যান্ড ক্রাইমস অব চার্লস শোবরাজ’। এ বইয়েরই পরে নতুন সংস্করণ বের করা হয়, যার নাম ছিল, ‘অন দ্য ট্রেইল অব দ্য সার্পেন্ট’। শোবরাজের ওপর যৌথভাবে লেখা বইগুলো তাঁদের আন্তর্জাতিক খ্যাতি এনে দিয়েছিল। এ বই অবলম্বনেই বিবিসি ও নেটফ্লিক্সের সিরিজ ‘দ্য সার্পেন্ট’ বানানো হয়।

রিচার্ড নেভিল ২০১৬ সালে মৃত্যুবরণ করেন। জুলি ক্লার্ক এখনো বেঁচে আছেন। তিনি ২০২১ সালে যুক্তরাজ্যের দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকায় এ বিষয়ে একটি লেখা লিখেছিলেন। লেখাটা এবার পড়তে পারি:

‘১৯৭৭ সাল। আমি আর আমার প্রেমিক রিচার্ড নিউইয়র্কে সাংবাদিকতা করছিলাম। আমার বয়স ছিল ২৩ আর রিচার্ডের ৩৩। রিচার্ড তখন যুক্তরাজ্যে তার প্রতিষ্ঠানবিরোধী ম্যাগাজিন ওজের জন্য বেশ পরিচিত। সে সময় তাকে একটি বই লেখার প্রস্তাব দেওয়া হয়, ফরাসি-ভিয়েতনামি এক যুবক চার্লস শোবরাজকে নিয়ে, যাকে সদ্য হত্যার অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সারা পৃথিবীতে তার খোঁজে অভিযান চলেছিল। গ্রেপ্তার হওয়ার পরপরই সে নিজের জীবনের গল্পের স্বত্ব বিক্রি করে দেয় ব্যাংককের এক ব্যবসায়ীর কাছে। সেই ব্যবসায়ী তা বিক্রি করেন র‍্যান্ডম হাউস নামে প্রকাশনা সংস্থার কাছে, যারা রিচার্ডকে দিল্লিতে যেতে বলে।

‘এ ঘটনা তখন আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল—প্রতারণা, মাদক, রত্ন চোরাচালান, বন্দুক, দুর্নীতি, নাটকীয় জেল ভাঙা আর এক আড়ম্বরপূর্ণ নারী সহযোগী, বড় সানগ্লাস পরে কোলের কুকুর নিয়ে যার ছবি তোলা হয়েছিল। একটি পত্রিকার শিরোনামই ছিল, “হিপি ট্রেইলে মৃত্যু ঘুরে বেড়াচ্ছে!”

‘রিচার্ড কাজটি পেয়েছিল; কারণ, আমরা হিপি ট্রেইলের সঙ্গে পরিচিত ছিলাম। কিন্তু অপরাধ সাংবাদিকতা বা অপরাধজগতের কিছুই জানতাম না। তবু আমরা দিল্লি উড়ে গেলাম আর নিজেরা জড়িয়ে পড়লাম এক নৈতিক জটিলতায়।

‘হোটেল রুমেই দেখা হলো নানা দাগওয়ালা অপরাধীদের সঙ্গে, তারা তিহার জেল থেকে শোবরাজের বার্তা নিয়ে আসত। রিচার্ড দ্রুতই ঘুষ আর দালালির নানা ধরন শিখে ফেলল। আর এ মাধ্যমে সাক্ষাৎকারের নিয়মিত সুযোগ তৈরি করল। প্রথমবার যখন শোবরাজের সঙ্গে দেখা হলো, সে শিকল বাঁধা অবস্থায় ছিল। কিন্তু আমাদের ভদ্রভাবে স্বাগত জানাল। (আমরা কি সত্যিই তার সঙ্গে হাত মেলালাম? সেই হাত দিয়েই তো সে মানুষের গলা টিপে মেরেছে!) এখান থেকেই শুরু হলো তার বিকৃত মানসিক জগতের ভেতরে আমাদের প্রবেশ।

‘আমরা নিজেদের মজা করে নাম দিয়েছিলাম “বাঙলস আর মিশ্যাপ, নিউজ স্লুথস”। এর মানে হচ্ছে ভুলভ্রান্তিতে ভরা গোয়েন্দা যুগল। এ রসিকতাই আমাদের টিকিয়ে রেখেছিল; কারণ, আসলে আমরা ছিলাম ভয় আর বিভ্রান্তিতে ভরা। শোবরাজ তখন খুনগুলোর বর্ণনা দিচ্ছিল একে একে। আমরা দুজনই দুঃস্বপ্ন দেখতে শুরু করলাম, সে যেন আমাদের পিছু নিয়েছে বা হঠাৎ আমাদের ঘরে ঢুকে পড়ছে। মাঝেমধ্যেই তার সহযোগীরা রাতবিরাতে এসে চিঠি দিত। এক রাতে তো আমাদের দরজায় ড্রিল মেশিন দিয়ে ছিদ্র করা হচ্ছিল, একদম পরিষ্কার বোঝা গেল, আমরা নজরদারিতে আছি।

‘অবশেষে যখন দিল্লি ছেড়ে উড়াল দিলাম, মনে হলো মুক্তি পেলাম। এরপরও আমরা এই হত্যাকাণ্ডগুলোর ওপর গবেষণা চালিয়ে গেলাম। বন্ধুরা ভাবছিল আমরা পাগল হয়ে গেছি। তারা তখন রাজনৈতিক লেখা বা সামাজিক পরিবর্তন নিয়ে কাজ করছে, আর আমরা ব্যস্ত এক খুনির কাহিনিতে। আমার নিজেরও কিছুটা লজ্জা লাগছিল, কিন্তু আমরা জানতাম, কাজটা শেষ করতেই হবে, আর সঠিকভাবেই করতে হবে।

‘শেষমেশ আমরা কাজটা শেষ করেছিলাম। চার বছর আগে রিচার্ড মারা গেছে। এখন পেরিয়ে গেছে ৪০ বছরের বেশি সময়, তবু মনে হয় গর্বের বিষয় যে দুই তরুণ অপটু সাংবাদিক, একদিন লিখেছিল এক চিরকালীন সত্যিকারের অপরাধকাহিনি।’

আরেকটি বই লিখেছিলেন রমেশ কৈরালা নামের একজন চিকিৎসক। এই রমেশ কৈরালাই নেপালে চার্লস শোবরাজের হার্টের ভালভ প্রতিস্থাপন করেছিলেন। ‘চার্লস শোবরাজ: ইনসাইড দ্য হার্ট অব দ্য বিকিনি কিলার’ নামের বইটি রমেশ কৈরালার ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ ও সাক্ষাতের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে লেখা। তিনি শোবরাজের সঙ্গে সরাসরি কথা বলেছেন এবং তাঁর মনস্তত্ত্ব, অপরাধের যুক্তি ও নিজের প্রতি তাঁর অদ্ভুত আত্মবিশ্বাস বিশ্লেষণ করেছেন। এটি একধরনের মনস্তাত্ত্বিক বায়োগ্রাফি, যেখানে দেখা যায়, একজন খুনি নিজের অপরাধকেও কেমন করে বুদ্ধিমত্তা হিসেবে দেখেন।

নেভিল ও জুলির বইয়ে যা আছে

রিচার্ড নেভিল চার্লস শোবরাজের সাক্ষাৎকার নিয়ে জানতেন তাঁর মনের জগৎ। প্রথমে নেভিলের ধারণা ছিল, শোবরাজ হয়তো এমন একজন মানুষ, যিনি পশ্চিমাদের আধিপত্য আর ভোগবাদী সংস্কৃতির বিরুদ্ধে রাগে-ঘৃণায় অপরাধে নেমেছেন। কিন্তু পরে তিনি বুঝেছিলেন, বিষয়টা অনেক গভীর ও ভয়ংকর।

শোবরাজকে নিয়ে লিখিত বই

নেভিল তাঁর বইয়ে বর্ণনা করেছেন, কীভাবে শোবরাজ নিজের হত্যাকাণ্ডকে দর্শন, রাজনীতি ও মনোবিজ্ঞানের আড়ালে যুক্তিসংগত করার চেষ্টা করতেন। শোবরাজ বলতেন, ‘আমি কখনো ভালো মানুষকে মারিনি।’ নেভিল লিখেছেন, ‘তিনি মনোবিশ্লেষণ, বৈশ্বিক রাজনীতি ও বৌদ্ধ দর্শনের তত্ত্ব টেনে এনে এমন এক দুনিয়া তৈরি করেছিলেন, যেখানে তাঁর অপরাধকেই তিনি ন্যায্য বলে মনে করতেন। তিনি দাবি করতেন যে তাঁর অপরাধমূলক জীবন আসলে ফরাসি আইনি ব্যবস্থার বিরুদ্ধে এক প্রতিবাদ। কখনো বলতেন, ভিয়েতনাম ও এশিয়ার প্রতি তাঁর ভালোবাসাই তাঁকে এই পথে এনেছে। কিন্তু এসব ব্যাখ্যা ছিল পুরোপুরি অবাস্তব। তবু মনস্তাত্ত্বিক প্রতারণার হাতিয়ার হিসেবে এসব ছিল অসাধারণ কার্যকর।’

নেভিল একবার শোবরাজকে সরাসরি প্রশ্ন করেছিলেন, ‘একজন মানুষ খুনি হয় কেন?’

শোবরাজ উত্তর দিয়েছিলেন, ‘দুই ধরনের খুনি আছে, যাদের অনুভূতি খুব বেশি, তাই তারা নিজেদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না, আর যাদের কোনো অনুভূতিই নেই।’

নেভিল লিখেছেন, ‘তিনি বলেননি, এই দুই শ্রেণির মধ্যে তিনি কোনটিতে পড়েন।’ রিচার্ড নেভিলের চোখে, ‘চার্লস শোবরাজ ছিলেন এমন এক মানুষ, যাঁর মুখে ফেরেশতার হাসি, কিন্তু মনে শয়তানের হিসাব। একজন অপরাধী, যিনি নিজের বুদ্ধি, আকর্ষণ আর ঠান্ডা যুক্তির মাধ্যমে মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করতেন এবং সবচেয়ে ভয়ংকর বিষয়, তিনি নিজের অপরাধে কখনো অনুশোচনা অনুভব করতেন না।’

আসল নায়ক ছিলেন একজন কূটনীতিক

ডাচ কূটনীতিক হারম্যান নিপেনবার্গ না থাকলে সম্ভবত চার্লস শোবরাজ কখনোই ধরা পড়তেন না। হয়তো আরও অনেক খুন করে রাজার মতো জীবন যাপন করতেন। হারম্যান নিপেনবার্গ ১৯৭৬ সালে ব্যাংককের ডাচ দূতাবাসে কাজ করতেন। ঘটনার শুরু হয়েছিল এক ডাচ পরিবারের চিঠি থেকে। পরিবারটির প্রধান ডাচ দূতাবাসে চিঠি লিখেছিলেন শ্যালিকা কর্নেলিয়া হেমকার ও তাঁর প্রেমিক হেনরিকুস বিনতাঞ্জার খোঁজ পেতে। নিপেনবার্গ বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে পুলিশের মর্গে পাওয়া দুটি পোড়া লাশ ডেন্টাল রেকর্ড মিলিয়ে শনাক্ত করান যে তাঁরাই ছিলেন ওই ডাচ দম্পতি।

এরপর নিপেনবার্গ বন্ধু বেলজিয়ান দূতাবাসের পল সিয়েমনসের সূত্রে পৌঁছান নাদিন জিরের কাছে, যিনি শোবরাজের একই অ্যাপার্টমেন্টে থাকতেন। নাদিন জানান, শোবরাজের ঘরে নিখোঁজ মানুষের অনেক পাসপোর্ট দেখা গেছে, তিনি নিজেও ডাচ দম্পতিকে সেখানে যেতে দেখেছেন। নিপেনবার্গ থাই পুলিশকে খবর দেন, পুলিশ অভিযান চালায়, কিন্তু শোবরাজ ভুয়া পাসপোর্টে নিজেকে মার্কিন নাগরিক সাজিয়ে ছাড়া পেয়ে যান।

ডাচ কূটনীতিক হারম্যান নিপেনবার্গ ও চার্লস শোবরাজ

পরদিন রাতে নাদিনকে শোবরাজের সহচর ডেকে পাঠালে নিপেনবার্গ ঝুঁকি সত্ত্বেও যেতে বলেন, যাতে সন্দেহ না পড়ে। নাদিন সুযোগ পেয়ে কয়েকটি পাসপোর্ট-ফটো লুকিয়ে আনেন, যা ভুক্তভোগীদের সম্পর্কে আরও তথ্য দেয়। শোবরাজ তখন মালয়েশিয়ায় পালালেও নিপেনবার্গ থামেননি। তিনি স্ত্রী অ্যাঞ্জেলাকে নিয়ে মামলার কাগজপত্র ব্যাংককের বিভিন্ন দূতাবাসে দিয়ে রাখেন। ১৯৭৬-এর ৫ মে ডাচ রাষ্ট্রদূতের পরামর্শে তিনি গণমাধ্যমকে এসব তথ্য দেন। এরপর ব্যাংকক পোস্ট ‘ওয়েব অব ডেথ’ শিরোনামে প্রথম পাতায় খবর ছাপলে থাই কর্তৃপক্ষ নড়েচড়ে বসে। শোবরাজ এরপর ভারতে চলে গেলে ১৯৭৬ সালের ৫ জুলাই দিল্লিতে শোবরাজ গ্রেপ্তার হন।

ব্যাংকক পোস্টে প্রকাশিত সেই রিপোর্ট

দুই দশক পরও নিপেনবার্গের ভূমিকা শেষ হয়নি। ২০০৩ সালে শোবরাজ নেপালে ধরা পড়লে তিনি নিজের গ্যারেজে রাখা ছয় বাক্স পুরোনো নথি থেকে শোবরাজের অপরাধের সঙ্গী মারি-আন্দ্রে লেক্লারের ১৯৭৬ সালের জবানবন্দি খুঁজে বের করেন। সেখানে নেপালে শোবরাজের অবস্থানের বিস্তারিত বর্ণনা ছিল। তিনি নথিগুলো এফবিআইকে পাঠান, যা পরে নেপাল পুলিশকে দেওয়া হয়। ফলে শেষ পর্যন্ত দুই মামলায় শোবরাজকে নেপালে প্রায় ২০ বছর জেলে থাকতে হয়েছিল।

নেপালের কারাগারে কেমন ছিলেন

‘প্যারিস ম্যাচ’ ফ্রান্স থেকে প্রকাশিত ফরাসি ভাষার একটি ম্যাগাজিন। ২০২১ সালে তারা ‘চার্লস শোবরাজ: দ্য সার্পেন্টের শেষ অধ্যায়’ নামে একটি লেখা প্রকাশ করেছিল। তখনো চার্লস নেপালেই কারাগারে ছিলেন। সেখান থেকে কিছু অংশ পড়া যেতে পারে—

‘একসময় চার্লস শোবরাজের চোখে এমন এক তীব্র দৃষ্টি ছিল, যা কথার চেয়েও বেশি শক্তিশালী মনে হতো। আজ তার চোখে আর সেই ঝিলিক নেই। পুরু কালো চশমার আড়ালে সেগুলো এখন নিস্তেজ ও দুঃখভারাক্রান্ত। কাঠমান্ডুর জগন্নাথ দেয়াল কারাগারের সামান্য কিছু ছবিতে দেখা যায়—তার আগের জৌলুশ, আত্মবিশ্বাস আর চেহারার সৌন্দর্য উধাও। একসময় চকচকে কালো চুলের জায়গায় এখন ধূসর পাতলা চুল, মাথা প্রায় টাক। একদা আকর্ষণীয়, ফ্যাশনেবল “বিকিনি কিলার” আজ কুঁজো, দুর্বল ও ক্লান্ত এক বৃদ্ধ মানুষ।

‘৭৭তম জন্মদিনে (৬ এপ্রিল) তিনি একা ছিলেন নেপালের “গোলঘর” নামে পরিচিত উচ্চ নিরাপত্তা কারাগারে, যেখানে ২০০৩ সাল থেকে তাঁকে একেবারে একা রাখা হয়। সেই দিন তিনি শুধু ডাল-ভাত আর তরকারি খেয়ে জন্মদিন কাটান। কারারক্ষীদের ভাষায়—তাঁকে প্রতি মাসে ২২ কেজি চাল, ডাল ও সবজি দেওয়া হয়, যা দিয়ে তিনি নিজেই রান্না করে খান। অন্য কোনো বন্দীর সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ নেই; কারণ, কর্তৃপক্ষ মনে করে, তিনি অত্যন্ত প্রভাবশালী ও ধূর্ত—সহজেই অন্যদের প্ররোচিত করতে পারেন। তাই ছয় মাস পরপর তাঁর পাহারাদার বদলানো হয়, যেন কাউকে তিনি কিনে ফেলতে না পারেন।

নেপালে চার্লজ শোবরাজ। এএফপি ফাইল ছবি

‘কারাগারে তাঁর দেখা হয় শুধু আইনজীবীদের সঙ্গে। সপ্তাহে একবার তিনি পরিবারের সঙ্গে ফোনে কথা বলতে পারেন। তিনি থাকেন কারাগারের “ভিআইপি সেল”-এর একটিতে। ১৮ বর্গমিটারের ঘরে একটি টিনের বালতি, একটি ছোট টয়লেট আর কাঁটাতারে ঘেরা চার মিটার জায়গা, যেখানে তিনি হাঁটেন। দূর থেকে দেখা যায় হিমালয়ের চূড়া ও নীল আকাশ। তাঁকে সপ্তাহে একবার পত্রিকা পড়তে দেওয়া হয়, স্থানীয় টেলিভিশন দেখতে পারেন, কিন্তু মুঠোফোন ও ইন্টারনেট নিষিদ্ধ। ফলে তিনি কখনো নেটফ্লিক্সের “দ্য সার্পেন্ট” সিরিজও দেখেননি।

‘কারাগারে থাকাকালে তিনি নিজের আইনজীবী শকুন্তলা থাপার মেয়ে নিহিতা বিশ্বাসের প্রেমে পড়েন। মাত্র ২০ বছর বয়সী নিহিতা তখন তাঁর অনুবাদক হিসেবে কাজ করতেন। দুজনের বয়সের পার্থক্য ছিল ৪৪ বছর। তাঁরা জেলে থেকেই বিয়ে করেন বলে প্রচারিত হয়, যদিও নেপালের কর্মকর্তারা বলেন, এর প্রমাণ পাওয়া যায়নি। নিহিতা পরে ২০১১ সালে ভারতের টেলিভিশন রিয়েলিটি শো “বিগ বস”-এ অংশ নেন, কিন্তু দ্রুত বাদ পড়েন।

‘২০০৮ সালে হৃদ্‌যন্ত্রের অস্ত্রোপচার হয় শোবরাজের। সেই অপারেশন করেন নেপালের বিখ্যাত কার্ডিয়াক সার্জন ড. রমেশ কৈরালা, যিনি পরে একটি বইয়ে লিখেছেন, “আমি এক হৃদয়হীন মানুষের হৃদয় হাতে নিয়েছিলাম।”

‘শোবরাজ এখন বৃদ্ধ, দুর্বল এবং ২০৩৪ সালে তাঁর শাস্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা। তিনি এখনো বিশ্বাস করেন, একদিন মুক্ত হয়ে ফ্রান্সে ফিরে যাবেন, প্রিয় নিহিতাকে নিয়ে প্যারিসের আইফেল টাওয়ারের নিচে শ্যাম্পেন খুলবেন। কিন্তু নেপালের প্রবাদ যেমন বলে, “অতীতের বিষ আজও বর্তমানকে বিষাক্ত করে তোলে।” চার্লস শোবরাজের ভাগ্যেও হয়তো সে সত্যই লেখা আছে।’

নিহিতা বিশ্বাস

শেষ কথা ও দুটি রহস্য

নেপাল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর শোবরাজ ফ্রান্সেই ফিরে যান। এখন তিনি মুক্ত মানুষ হিসেবে সেখানেই বসবাস করছেন। তবে এখনো তাঁকে নিয়ে আলোচনার শেষ নেই। লেখালেখি হয়, সিনেমাও হয়তো আরও হবে। তবে তাঁকে নিয়ে দুটি রহস্য এখনো রয়ে গেছে।

প্রথম রহস্য: ১৯৮৬ সালে দিল্লির তিহার জেল থেকে শোবরাজ কেন পালালেন, সেটি একটি রহস্য। কারণ, তাঁর সাজা প্রায় শেষ পর্যায়ে ছিল। তিনি এমনিতেই মুক্তি পেতেন। কিন্তু জেল থেকে পালানোর কারণে তাঁর সাজার পরিমাণ বাড়ানো হয়। বাড়তি আরও ১০ বছর জেলে থাকতে হয়। ফলে তিনি মুক্তি পান ১৯৯৭ সালে।

অবশ্য এ রহস্যের একটি সম্ভাব্য উত্তর আছে। ধারণা করা হয়, তাঁর পালানোটা ইচ্ছাকৃত ছিল। কারণ, তিনি চেয়েছিলেন নতুন অপরাধে আবার ভারতে ধরা পড়তে, যাতে তাঁকে থাইল্যান্ডে পাঠানো না হয়। সেখানে তাঁর জন্য মৃত্যুদণ্ড অপেক্ষা করছিল। অর্থাৎ মুক্তি পাওয়ার পর ভারত যেন তাঁকে থাইল্যান্ডের হাতে তুলে না দিতে পারে, সে ব্যবস্থা করেছিলেন। ১৯৯৭ সালে মুক্তি পাওয়ার পর আর সেই আশঙ্কা ছিল না। কারণ, থাইল্যান্ডের পরোয়ানার মেয়াদ তত দিনে শেষ হয়ে গিয়েছিল। ফলে তিনি ভারত থেকে প্যারিসে ফিরতে পেরেছিলেন।

দ্বিতীয় রহস্য: ২০০৩ সালে চার্লস শোবরাজ আবার নেপালে যান, ভিন্ন পরিচয়ে। কিন্তু কাঠমান্ডুর থামেল এলাকার এক রেস্তোরাঁয় তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। ২০০৪ সালে তাঁকে ১৯৭৫ সালের মার্কিন পর্যটক কনি জো ব্রনজিচকে হত্যার দায়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। এর ১০ বছর পর, কানাডিয়ান লরেন্ট ক্যারিয়ারের হত্যার দায়েও আরেকটি সাজা হয়। প্রায় ২০ বছর জেলে থাকার পর, বয়স ও অসুস্থতার কারণে ২০২২ সালে তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয়। নেপালের আইনে বলা আছে, যে বন্দী তিন-চতুর্থাংশ সাজা ভোগ করেছেন এবং শারীরিকভাবে অক্ষম, তাঁকে মুক্তি দেওয়া যেতে পারে।

কথা হচ্ছে, নেপালে শোবরাজের অপরাধের প্রমাণ ছিল। তারপরও ছদ্মপরিচয়ে ঝুঁকি নিয়ে নিয়ে তিনি কেন নেপালে গিয়েছিলেন, সে এক রহস্য। যার উত্তর একমাত্র দিতে পারবেন চার্লস শোবরাজ নিজেই।