শাড়ি ছেড়ে বিকিনি, প্রথা ভেঙেছিলেন শর্মিলা ঠাকুর

শাড়ি ছেড়ে প্রথা ভেঙে বিকিনি পরেও সাবলীল ছিলেন ক্যামেরার সামনে শর্মিলা ঠাকুরকোলাজ

বর মানসিক ভারসাম্যহীন। বিয়েটা ভেঙে যায় অপর্ণার। কিন্তু বিয়ের আসর থেকে বরপক্ষ ফিরে গেলে সেটা ভালো চোখে দেখা হতো না সে সময়। এমন পরিস্থিতিতে অনুরোধে পড়ে তরুণ অপু অপর্ণাকে বিয়ে করে। শুরু হয় তাদের ছোট্ট সংসার। সব মিলিয়ে পর্দায় তাদের মিনিট বিশেক দেখা যায়। আর পর্দায় ২০ মিনিটে অপর্ণা আর অপুর যে অসাধারণ সম্পর্ক দেখানো হয়েছে, এখনো সেটি ভালোবাসার প্রতীক হিসেবে তাদের কথা ঘুরেফিরে আসে। দর্শকদের মনে স্থায়ী হয়েছে সেই সংলাপ, ‘যে টিউশনিটা আছে, সেটাও ছেড়ে দাও, তারপর আমার গরিব বর সন্ধ্যের আগেই বাড়ি ফিরে আসবে আর আমার কোনো অনুশোচনা থাকবে না।’ সেই সংলাপ, আঙ্গিক, বাচিক অভিনয়, সেই চোখ কি ভোলার মতো? ১৪ বছরের কিশোরী ‘অপর্ণা’র সুনিপুণ অভিনয় মনে থাকবে দর্শকদের। দর্শকের মননে আজও টাটকা সিগারেটের প্যাকেটে সেই লেখা, ‘খাবার পরে, একটা করে কথা দিয়েছ।’

সত্যজিতের সাদা–কালো পর্দার অপর্ণার চরিত্রে অভিনয় করেছেন শর্মিলা ঠাকুর। এ কালের তরুণ দর্শকদের কাছে তিনি হয়তো নায়ক সাইফ আলী খানের মা, নায়িকা কারিনা কাপুরের শাশুড়ি আর তৈমুরের দাদি। কিন্তু একসময় ভারত, এমনকি আমাদের দেশেও তিনি ছিলেন স্বপ্নের নায়িকা!

কিছু বিশেষণ তাঁর নামের পাশে চিত্রসমালোচকেরা প্রায়ই ব্যবহার করেন। তাঁকে বলা হয় ‘চিরসবুজ’। পর্দায় তাঁর সুমিষ্ট হাসি আর হরিণী চোখের চাহনি আজও তাঁকে আকর্ষণীয় করে তোলে সবার কাছে।
শর্মিলা ঠাকুরের প্রসঙ্গ এলে রবীন্দ্রনাথের নামটি চলে আসে। কবির ‘ঠাকুর’ পদবিটা নিয়ে তাঁর নিজেরও গর্ব ছিল। তাঁর ভাষায়, ‘এমন একই পরিবারে জন্মগ্রহণ করাটাও আমার জন্য অনেক সম্মানের। আমার জন্মের বছর তিনেক আগেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মারা যান। তাই তাঁর সঙ্গে আমার সরাসরি যোগাযোগ না হলেও, মায়ের মুখে তাঁর অনেক গল্প শুনেছি।’ এক সাক্ষাৎকারে শর্মিলা ঠাকুর এমনটাও বলেছেন, কবিগুরুর প্রভাব আছে তাঁর ওপর। ১৯৬০ সালে মুক্তি পাওয়া বাংলা ছবি ‘দেবী’ তার প্রমাণ। ‘আমার ছবি “দেবী” রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অনুপ্রেরণায় তৈরি। মূল বিষয় একই।’

তাঁর সুমিষ্ট হাসি আর হরিণী চোখের চাহনি আজও তাঁকে আকর্ষণীয় করে তোলে সবার কাছে
ফেসবুক থেকে

প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের ছোটগল্প অবলম্বনে সত্যজিৎ রায় পরিচালিত ‘দেবী’ মূলত রবীন্দ্রনাথের লেখনী ও তাঁর সাহিত্যের নারী চরিত্রের সঙ্গে বেশ মিলে গেছে।
যখন ‘অপুর সংসার’-এর জন্য অভিনেত্রী খোঁজা হচ্ছিল, তখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র ১৩ বছর। সে সময় বাঙালি নারীকে চলচ্চিত্রে কাজ করাটা তখন খুব একটা ভালো চোখে দেখা হতো না। কিন্তু সত্যজিৎ রায় বলে কথা!

তাঁকে মুখের ওপর ‘না’ করে দেওয়া একটু কঠিনই ছিল। তিনি শর্মিলা ঠাকুরের বাবাকে ফোন দিয়ে বাড়িতে আসেন, কথা বলেন। এরপর স্টুডিওতে নিয়ে গিয়ে কিশোরী শর্মিলাকে শাড়ি পরিয়ে ছবি তোলেন। এভাবেই ‘অপুর সংসার’-এর অপর্ণার চরিত্রে নির্বাচিত করা হলো শর্মিলা ঠাকুরকে। অপর্ণার বিয়ের পর প্রথম ঘরে প্রবেশের দৃশ্য দিয়ে শুরু হয় তাঁর অভিনয়জীবন। সত্যজিৎ রায়ের ছেলে সন্দীপ রায় এক স্মৃতিচারণায় লিখেছেন, ‘আমার বাবা সত্যজিৎ রায় “অপুর সংসার”-এর অপর্ণাকে দেখতে পৌঁছে যান শর্মিলা ঠাকুরের বাড়ি। ওঁর মা-বাবার সঙ্গে কথা বলার জন্য। হলুদ রঙের ফ্রক পরা, ববছাঁট চুলের সেই মেয়েকেই আমার মা একটি শাড়ি পরিয়ে, চুলে খোঁপা বেঁধে, কপালে টিপ পরিয়ে দিয়েছিল। তৈরি হলো অপর্ণা। ১৩ বছরের মেয়ে অনায়াসে ক্যামেরার মুখোমুখি। পাশে অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়।’ সন্দীপ রায় লিখেছেন, ‘বাবার পরিচালনায় নিজেকে সমর্পণ করেছিলেন সেই ১৩ বছরের তরুণী।’

শর্মিলা ক্যারিয়ারের মধ্যগগনেই বিয়ের সিদ্ধান্ত নেন ভারতের ক্রিকেট দলের অধিনায়ক মনসুর আলী খান পতৌদির সঙ্গে
ফেসবুক থেকে

সেবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, ব্রিটিশ ফিল্ম ইনস্টিটিউট পুরস্কারসহ বেশ কয়েকটি পুরস্কার অর্জন করে নেয় সিনেমাটি। আর ‘অপর্ণা’ ধীরে ধীরে হয়ে ওঠেন বাংলা চলচ্চিত্রের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। একে একে অভিনয় করেছিলেন সত্যজিৎ রায়ের ‘দেবী’, ‘নায়ক’, ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’, ‘সীমাবদ্ধ’ ছাড়া আরও অনেক বাংলা ছবিতে।

১৯৬৪ সালে ২০ বছর বয়সে বাংলা থেকে পাড়ি দেন আরব সাগরের তীরে, মানে তৎকালীন বোম্বাইতে। সে বছর শক্তি সামন্ত পরিচালিত ‘কাশ্মীর কি কলি’ ছবি দিয়ে শুরু হয় তাঁর মুম্বাই অভিযান। প্রথম ছবিতেই তাঁর অনবদ্য অভিনয় নজর কাড়ে গোটা ভারত উপমহাদেশের দর্শকের। সে সময় রুপালি পর্দায় শর্মিলা ঠাকুর মানেই সিনেমা সুপারহিট। একের পর এক মুক্তি পায় ‘ওয়াক্ত’, ‘অনুপমা’, ‘দেবর’, ‘শাওয়ান কি ঘাটা’ নামে বাণিজ্যসফল সিনেমা।
প্রতিবার পর্দায় ভিন্নভাবে খুঁজে পাওয়া যেত শর্মিলা ঠাকুরকে। ১৯৬৬ সালে সত্যজিৎ রায়ের ‘নায়ক’ সিনেমায় উত্তমকুমারের বিপরীতে ভিন্নভাবে দেখা যায় তাঁকে। সাংবাদিকের চরিত্রায়ণে আবারও অসাধারণ অভিনয়শৈলীর প্রমাণ দেন তিনি। নিজেকে ভাঙতে ভালোবাসতেন শর্মিলা। তাই তো শাড়ি ছেড়ে প্রথা ভেঙে বিকিনি পরেও সাবলীল ছিলেন ক্যামেরার সামনে। যা কেউ ভাবতেও পারেননি, তিনি তা করেছিলেন অবলীলায়। ১৯৬৭ সালে শক্তি সামন্তের ‘অ্যান ইভিনিং ইন প্যারিস’ সিনেমায় বিকিনি পরে তাঁর পর্দায় আবির্ভাব রীতিমতো আলোড়ন ফেলে দেয় সারা দেশে।

শুটিং সেটে সত্যজিৎ রায় ও শর্মিলা ঠাকুর। ছবি: ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস

রক্ষণশীল মানুষ তীব্র নিন্দা করলেও, লাস্যভঙ্গিমায় তাঁর অভিনয় বিপুলভাবে প্রশংসিত হয়। সেই বছরই ফিল্মফেয়ার ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদেও এই বেশে দেখা যায় তাঁকে। সে সময় আলোচিত এক ফটোশুটে দেখা যায়, বিকিনি পরে নীল সমুদ্রের ওপর দিয়ে স্কি করছেন নায়িকা শর্মিলা ঠাকুর। প্রথমবার প্রথা (ট্যাবু) ভেঙে বিকিনি পরে রুপালি পর্দায় ভেসে ওঠেন নায়িকা শর্মিলা ঠাকুর।

ফিল্মফেয়ারের প্রচ্ছদে

১৯৬৭ থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত শর্মিলা ঠাকুরের ব্যবসাসফল ছবিগুলো ‘আমনে সামনে’, ‘হামসায়া’, ‘সত্যকাম’, ‘তালাশ’। তবে আগের খ্যাতির রেকর্ড ভাঙে ১৯৬৯ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘আরাধনা’। ১৯৭০ সালে মুক্তি পায় সত্যজিৎ রায় পরিচালিত ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ এবং ১৯৭১ সালে ‘সীমাবদ্ধ’। দুটি সিনেমাতেই তিনি অন্যতম প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেন এবং সাফল্য পান। হিন্দিতে তাঁর উল্লেখযোগ্য সিনেমা ‘সফর’, ‘অমর প্রেম’, ‘রাজারানি’, ‘দাগ’, ‘আ গালে লাগ যা’, ‘দাস্তান’ দারুণ ব্যবসাসফল হয়। ১৯৭৫ সালে গুলজার পরিচালিত ‘মৌসুম’ সিনেমায় সঞ্জীব কুমারের বিপরীতে অসাধারণ অভিনয়ের জোরে ভারতের ‘জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার’ অর্জন করেন শর্মিলা ঠাকুর।
১৯৭৭ সালে উত্তমকুমারের বিপরীতে ‘অমানুষ’ ও ‘আনন্দ আশ্রম’ সিনেমা দুটি দারুণভাবে প্রশংসিত হয়।

অরণ্যের দিনরাত্রি সৌমিত্রের সঙ্গে
ছবি: ইনস্টাগ্রাম

১৯৮৩ সালে বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তানের যৌথ প্রযোজনায় শর্মিলা-শশী কাপুর জুটি উপহার দেন ছবি ‘গ্যাহরি চোট’ (বাংলা নাম ‘দূরদেশ’)। বাংলাদেশের বিভিন্ন সিনেমা হলেও ছবিটি মুক্তি পায় এবং বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করে। রঞ্জিত মল্লিক, রাজেশ খান্না, দিলীপ কুমার, শশী কাপুর, অমিতাভ বচ্চনসহ চলচ্চিত্রজগতের বহু বিখ্যাত অভিনেতার বিপরীতে দেখা গেছে শর্মিলা ঠাকুরকে।

‘মন’, ‘ধাড়কান’, ‘আবার অরণ্যে’ ইত্যাদি ছবিতে পার্শ্বচরিত্রে অভিনয় করেন তিনি। ২০০৩ সালে ‘আবার অরণ্যে’ ছবিতে অভিনয়ের জন্য সেরা অভিনেত্রী হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান। ২০১৩ সালে লাভ করেন ভারতের রাষ্ট্রীয় সম্মাননা ‘পদ্মভূষণ’। শর্মিলা ঠাকুর দীর্ঘদিন ভারতীয় চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ডের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এ ছাড়া বর্তমানে তিনি ইউনিসেফের শুভেচ্ছাদূত হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন। ব্যক্তিগত জীবনেও প্রথা ভেঙেছেন এ নারী। বহু তরুণের স্বপ্নের নায়িকা শর্মিলা ক্যারিয়ারের মধ্যগগনেই বিয়ের সিদ্ধান্ত নেন পতৌদি নবাব বংশের সন্তান, ভারতের ক্রিকেট দলের অধিনায়ক মনসুর আলী খান পতৌদির সঙ্গে।

‘নায়ক’ ছবিতে উত্তমকুমার ও শর্মিলা ঠাকুর।
ছবি: সংগৃহীত

১৯৬৯ সালের ২৭ ডিসেম্বর বিয়ের পিঁড়িতে বসেন দুজন। ভিন্নধর্মাবলম্বী হওয়ায় অনেক সমালোচনার মুখোমুখি হয়েছিলেন তখন। বিয়ের আগে শর্মিলা ধর্ম পরিবর্তন করেন। তাঁর নতুন নাম হয় বেগম আয়েশা সুলতানা। সুখেও ছিলেন তাঁরা।

পতৌদি পরিবারের আদর্শ বধূ হিসেবেও শর্মিলার বেশ প্রশংসা শোনা যায়। শর্মিলা-মনসুর দম্পতির তিন সন্তান। সাইফ আলী খান ও সোহা আলী খান বলিউডে প্রতিষ্ঠিত অভিনেতা-অভিনেত্রী, সাবা আলী খান জুয়েলারি ডিজাইনার।ওহ্‌, বলাই হয়নি। যে কারণে আজ শর্মিলাকে নিয়ে লিখতে বসা—আজ এই প্রখ্যাত অভিনেত্রীর জন্মদিন। ৭৭-এ পা দিলেন ‘বলি’ অভিনেত্রী শর্মিলা ঠাকুর।

১৯৪৬ সালের ৮ ডিসেম্বর কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের বংশধর গীতিন্দ্রনাথ ঠাকুর ও ইরা ঠাকুরের সংসারে জন্ম হয় শর্মিলার। মা ইরা ঠাকুর ছিলেন আসামের বিখ্যাত লেখক জ্ঞানদাভিরাম বড়ুয়ার মেয়ে। শর্মিলা ঠাকুরের মায়ের পরিবারের দিক থেকেও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে। ইরা ঠাকুরের মা লতিকা বড়ুয়া ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাই দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাতনি।

পরিবারের সবার সঙ্গে শর্মিলা ঠাকুর। ছবি: ইনস্টাগ্রাম থেকে নেওয়া

শর্মিলা ঠাকুরের আরও দুজন বোন ছিলেন—ঐন্দ্রিলা ও রমিলা। শর্মিলার আগে বোন ঐন্দ্রিলা ঠাকুর টিংকু প্রথম শিশুশিল্পী হিসেবে অভিনয়জগতে আসেন। ১৯৫৬ সালে তপন সিনহার ‘কাবুলিওয়ালা’ সিনেমার মুখ্য চরিত্র ‘মিনি’ হিসেবে দেখা যায় তাঁকে।

(সূত্র: উইকিপিডিয়া, আনন্দবাজার, প্রথম আলো)