আমির বুড়ো হবেন কবে

মিস্টার পারফেকশনিস্ট, নাকি বহুরূপী? তাঁর বেলায় কোন উপমা মানানসই? ধন্দে পড়তে হয়। বাহারি রূপে রুপালি পর্দায় হাজির হয়েছেন বছরের পর বছর। ৫৬ বছর পেরিয়েও আমিরের সে ধারাবাহিকতায় ছেদ পড়েনি; বরং ভিন্ন ভিন্ন রূপেই হাজির হওয়ার চেষ্টা করছেন। সাময়িক স্মৃতিভ্রষ্ট ধনকুবের, কুস্তিগীর বাবা কিংবা ভিনগ্রহের এলিয়েন—ভক্তরা অপেক্ষায় থাকেন, নতুন আর কী রূপে দেখবেন আমিরকে! তিনি কি বুড়ো হবেন না?
কখন থেকে আমিরের এই নতুন যুগের সূচনা? ১৯৯৫ সালের ‘রঙ্গিলা’? কেউ বলবেন, হ্যাঁ, কেউ বলবেন, না। তবে এই ছবি দিয়ে আমিরকে বলিউডের ‘টিপিক্যাল’ নায়ক থেকে টেনে বের করে এনেছিলেন রাম গোপাল ভার্মা, এটা মানতেই হবে। আধখোলা কটকটে রঙের শার্ট, বাহারি সানগ্লাস, ঝাঁকড়া চুল, আর ঘাড়ে বাঁধা রুমাল আমিরকে দিয়েছিল নতুন পরিচয়। নিজের রোমান্টিক চরিত্র থেকে বেরিয়ে রাস্তার খ্যাপাটে যুবক মুন্নার চরিত্রে বুঁদ হয়ে ছিলেন তখনকার দর্শক। আমির ও তাঁর নায়িকা ঊর্মিলার পোশাক ফ্যাশন হয়ে গিয়েছিল। অফিশিয়াল না হলেও এই ছবিই যদি হয় আমিরের খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসার কাল, তবে বহুরূপী আমিরের এটাকেই ধরা যাক সূচনাপর্ব।

পাঁচ বছর পর। একটি ছবি নাড়িয়ে দিল বলিউডকে। মনোনীত হলো অস্কারে বিদেশি ভাষার ছবি বিভাগের সেরা ছবি হিসেবে। অথচ নেহাত ভাগ্যের জোরে এই ছবিতে ঢুকেছিলেন আমির। ছবিটির ভুবন চরিত্রের জন্য পরিচালক আশুতোষ গোয়ারিকড়ের প্রথম পছন্দ ছিলেন শাহরুখ খান।

‘ইশক’ সিনেমায় আমির খান ও জুহি চাওলা। আইএমডিবি

রোমান্টিক হিরো থেকে তখন হুট করেই বাইরে বেরোতে চাননি কিং খান। আমির এই সুযোগ লুফে নেন। শুধু তা–ই নয়, ছবিটির সহপ্রযোজক হিসেবেও তিনি নাম লেখান। ‘লগান’ ভারতীয় চলচ্চিত্রে একটি ইতিহাস বটে! ১৯৫৭ সালের ‘মাদার ইন্ডিয়া’ আর ১৯৮৮ সালের ‘সালাম বোম্বে’র পরে অস্কারে বিদেশি ভাষায় মনোনীত হয় এই সিনেমা। শুধু কি তা–ই, গ্রামের সাদাসিধে ভুবন চরিত্র শাহরুখের পছন্দ না হলেও এই চরিত্র দিয়েই ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ড বাগিয়ে নেন আমির। একই বছর ‘কাভি খুশি কাভি গাম’ ছবি দিয়েও সেরা অভিনেতা বিভাগে মনোনীত হয়েছিলেন শাহরুখ। ক্যারিয়ারের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল এই ছবি। মোড় ঘুরিয়েছিল বাস্তব জীবনেরও। এই ছবি আমিরকে দিয়েছিল জীবনসঙ্গী কিরণ রাওকে।
২০০১ সালের ১৫ জুন মুক্তি পেয়েছিল ‘লগান’। কে ভেবেছিল, এক মাসের ব্যবধানে নতুন এক আমিরকে দেখা যাবে। একই বছরের ১০ আগস্ট। মুক্তি পেল আমিরের নতুন ছবি ‘দিল চাহতা হ্যায়’।

ভড়কে গেলেন দর্শক। একি! একেবারে ৩৬০ ডিগ্রি উল্টো। গ্রামের সাদাসিধে ছেলে থেকে আমির পর্দায় এলেন একেবারে নগরের যুবক হয়ে। গ্রামের ভুবন থেকে একঝটকায় তিনি হয়ে গেলেন শহুরে আকাশ মালহোত্রা। শহরের ফ্যাশনচেতা যুবক আকাশ মালহোত্রা তত দিনে ভারতের তরুণদের ফ্যাশন আইকন।
ঐতিহাসিক চরিত্র ঠিকঠাক ফোটানো না গেলে সমালোচনার অন্ত থাকে না। আমির সেই ঝুঁকিটাই নিলেন ২০০৫ সালে। আমির হাজির ব্রিটিশ বিদ্রোহী হিসেবে। মঙ্গল পান্ডের চরিত্রে নিজেকে আবারও প্রমাণ করলেন জাত অভিনেতা হিসেবে। সে বছর চতুর্থ আয়কারী ছবি হিসেবে নাম করে সিনেমাটি।

‘লগান’–এর একটি দৃশ্য
ছবি: সংগৃহীত

পরের বছর আবারও জাতীয়তাবাদী চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন আমির। পরিচালক রাকেশ ওম প্রকাশ মেহরা দীর্ঘ সাত বছর সময় নেন ছবির গল্প ও চিত্রনাট্য তৈরিতে। তারপর শুরু হয় কাজ। চটপটে এক যুবক। গান গায়, আবৃত্তি করে, প্রেম করে। সে–ই কিনা সিনেমার শেষে গুলিতে ঝাঁঝরা করে দিতে চায় অন্যের বুক। তবে তা দেশের জন্য। এমন চরিত্রে কাকে নেবেন মেহরা? নাম ওঠে আমির খানের। আমিরও নিজেকে চেনালেন আরেকবার। ছবি মুক্তি পেতেই বক্স অফিস তোলপাড়। বাফটাতে বিদেশি ভাষার ছবি হিসেবে মনোনয়ন পায়। অস্কার ও গোল্ডেন গ্লোবে ভারত থেকে পাঠানো হয় এই ছবিকেই।

এর পরের গল্পগুলো একেবারেই চেনা। ‘তারে জমিন পার’-এর নিকুম্ব স্যার শুধু নয়, পুরো ছবিটিই ভালো লাগে আমিরের। ছবির প্রযোজনাসহ পরিচালনার ভারটিও তুলে নেন তিনি। তবে এর পরের যাত্রায় কষ্টটা হয়েছে আমিরের মেকআপ আর্টিস্টেরই। প্রতিটি ছবিতে আমিরকে ভিন্ন ভিন্ন লুকে আনতে ঘাম ঝরেছে তাঁদের।

‘থ্রি ইডিয়টস’ ছবির দৃশ্য
আইএমডিবি

‘গজনি’ ছবির সাময়িক স্মৃতিভ্রষ্ট ধনকুবের, ‘থ্রি ইডিয়টস’-এর ফুংসুক ওয়াংড়ু, ‘ধুম থ্রি’ ছবির দ্বৈত চরিত্র, ‘পিকে’ ছবির ভিনগ্রহের এলিয়েন, ‘দঙ্গল’-এর কুস্তিগীর বাবা, ‘সিক্রেট সুপারস্টার’-এর ডিস্কো ফাইটার (এলভিস প্রিসলি ও মিঠুন চক্রবর্তীর মিশেলে তৈরি) এবং ‘থাগস অব হিন্দুস্তান’–এর ঠগি আমির দর্শকের সামনে এসেছেন বহু রূপে, বহুরূপী হয়ে।
( শরীফ নাসরুল্লাহর লেখা প্রতিবেদনটি ২০২১ সালে আমির খানের জন্মদিনে বিনোদন অনলাইনে প্রকাশিত। আজ জন্মদিন উপলক্ষে আবার প্রকাশ করা হলো)