নার্গিসের স্মৃতি, সুনীলের উদ্যোগ-বাংলাদেশে এখনো চলছে ক্যানসার-সহায়তা তহবিল
১৯৮১ সালে অগ্ন্যাশয়ের ক্যানসারে মারা যান ভারতীয় অভিনেত্রী নার্গিস দত্ত। স্ত্রীর মৃত্যুর পর ১৯৮২ সালে তাঁর স্বামী অভিনেতা পরিচালক ও প্রযোজক সুনীল দত্ত বানান ‘দর্দ কা রিশতা’। শুধু সিনেমা নয়, এটি ছিল একটি মানবিক উদ্যোগ, ক্যানসার সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি এবং চিকিৎসার জন্য তহবিল সংগ্রহে এটি বানানো হয়েছিল। বাংলাদেশেও ছবিটি প্রদর্শিত হয়, সেখান থেকে অর্জিত অর্থ চার দশক ধরে ক্যানসারে আক্রান্ত শিল্পী ও চলচ্চিত্রকর্মীদের চিকিৎসায় ব্যয় হচ্ছে।
বিদেশে প্রদর্শনী ও ফাউন্ডেশন
যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের কয়েকটি দেশে ‘দর্দ কা রিশতা’র বিশেষ প্রদর্শনী হয়, যেখান থেকে পাওয়া অর্থ দিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় নার্গিস দত্ত ক্যানসার ফাউন্ডেশন। ১৯৮২ সালে নিউইয়র্কের সেই বিশেষ প্রদর্শনীতে ছিলেন সুনীল দত্ত, স্মিতা পাতিল, পুনম ধিলন প্রমুখ। সুনীল দত্তর স্বপ্ন ছিল, ক্যানসারে আক্রান্ত অসহায় মানুষ যেন চিকিৎসার সুযোগ পান। বাংলাদেশেও ছবিটি প্রদর্শনের উদ্যোগ নেন সুনীল দত্ত। প্রদর্শনী থেকে পাওয়া অর্থ তিনি আর ফেরত নেননি, ‘ক্যানসার তহবিল’ গঠনের শর্তে বিএফডিসি কর্তৃপক্ষকে দিয়ে দেন।
বাংলাদেশে প্রদর্শনী
‘দর্দ কা রিশতা’ ছবিটি বাংলাদেশে প্রদর্শনের জন্য ১৯৮৩ সালে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়কে প্রস্তাব দেন সুনীল দত্ত। সে বছরের ২৩ আগস্ট ছবিটি প্রদর্শনের অনুমতি দেয় তথ্য মন্ত্রণালয়। ১৯৮৪ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশনকে (বিএফডিসি) বিষয়টি দেখভালের দায়িত্ব দেওয়া হয়। ১৯৮৫ সালের ২৯ অক্টোবর বাংলাদেশে ছবিটি মুক্তির অনুমতি পায়। তবে বিপণনের ক্ষেত্রে এফডিসির নিজস্ব লোকবল না থাকায় বিষয়টি দেখভাল করতে পাঁচ বছরের জন্য কিশোর ফিল্মস নামের একটি প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। প্রতিষ্ঠানটি আবার দরপত্রের মাধ্যমে মেসার্স ইসলাম অ্যান্ড ইসলাম ফিল্মসকে পরিবেশনার দায়িত্ব দেয়।
তহবিল সংগ্রহ শুরু, অর্থের ব্যবহার
‘দর্দ কা রিশতা’ ছবিটি থেকে পাওয়া অর্থের পরিমাণ নিয়ে কেউ নিশ্চিত তথ্য দিতে পারেননি। তবে পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে এফডিসির একটি সূত্র প্রথম আলোকে জানিয়েছে, ৪০ বছর আগে তহবিল সংগ্রহ শুরু হয়। শুরুতে তহবিলে জমা পড়ে আড়াই থেকে তিন লাখ টাকা। সংগৃহীত অর্থ ‘দর্দ কা রিশতা ক্যানসার তহবিল’ নামে ঢাকার কারওয়ান বাজারের সোনালী ব্যাংকে এফডিআর করে রাখা হয়। গত ৪০ বছরে সে অর্থ বেড়ে ৮৫ লাখ টাকা ছাড়িয়েছে।
কারা এই সহায়তা পান
এফডিসির কর্মকর্তা-কর্মচারী থেকে চলচ্চিত্র-সংশ্লিষ্ট যে কেউ এ তহবিল থেকে নিজের ও পরিবারের কোনো সদস্যের ক্যানসার চিকিৎসায় অর্থসহায়তা চাইতে পারেন। শুধু ক্যানসারে আক্রান্তদের নয়, যাঁরা পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন, তাঁদের চিকিৎসার প্রয়োজনেও তহবিলে আবেদন করা যায়।
‘দর্দ কা রিশতা ক্যানসার তহবিল’ থেকে অর্থসহায়তা পেতে চাইলে আগ্রহীদের চিকিৎসার যাবতীয় কাগজপত্র, সমিতি বা প্রতিষ্ঠানের প্রত্যয়নপত্র ও চিকিৎসকের সুপারিশপত্রসহ আবেদন জমা দিতে হয়। এরপর এফডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালকের নেতৃত্বে গঠিত আট সদস্যের উপকমিটি বিষয়টি অনুমোদন দিয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে পাঠান। তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের সচিবের নেতৃত্বে গঠিত সাত সদস্যের কমিটি চূড়ান্ত অনুমোদন দেন। পুরো প্রক্রিয়ায় জাতীয় ক্যানসার ইনস্টিটিউট ও জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতালের প্রতিনিধিরাও যুক্ত থাকেন।
কতজনকে সহায়তা দেওয়া হয়েছে
‘দর্দ কা রিশতা ক্যানসার তহবিল’ থেকে এখন পর্যন্ত কতজন অর্থসহায়তা পেয়েছেন, তার পূর্ণাঙ্গ তালিকা না পাওয়া গেলেও এফডিসির প্রশাসন বিভাগ ও অর্থ শাখা জানিয়েছে, এখন পর্যন্ত ১২০ জনের বেশি আবেদনকারী এ তহবিল থেকে অর্থসহায়তা পেয়েছেন। এর মধ্যে ২০২৪ সালে সহায়তা পেয়েছেন তিনজন। আর চলতি বছর তিনজনের আবেদন প্রক্রিয়াধীন। কমিটির অনুমোদনের ওপর অর্থসহায়তার পরিমাণ নির্ভর করে। তবে আগে ৫০ হাজার টাকার মতো দেওয়া হলেও গত কয়েক বছরে একেকজন আবেদনকারীকে ১ লাখ টাকাও দেওয়া হচ্ছে। সংগত কারণে অনুদানগ্রহীতাদের নাম প্রকাশ করা হয় না।
নতুন পরিকল্পনা
‘দর্দ কা রিশতা ক্যানসার তহবিল’কে আরও সচল করতে নতুন উদ্যোগ নিচ্ছে এফডিসি। এরই মধ্যে একটি কমিটি গঠন করে বেশ কিছু খসড়া পরিকল্পনা করা হয়েছে, যা শিগগিরই মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। এফডিসি কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, এ পরিকল্পনার মধ্যে অন্যতম, ছবিটির প্রিন্ট ডিজিটালে রূপান্তর করে প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করা। এরপর সেখান থেকে আয় করা অর্থ তহবিলে যুক্ত করা। বিষয়টি এখনো চূড়ান্ত না হওয়ায় এফডিসির একজন কর্মকর্তা ও কমিটির সদস্য পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, ‘২০২৪ সালের নভেম্বরে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। এবার আমরা মিটিং করে কয়েকটি খসড়া প্রস্তাব তৈরি করেছি। মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে পরবর্তী সভায় এটি নিয়ে আলোচনা করা হবে। বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভের মাধ্যমে ডিজিটালে রূপান্তরের পরিকল্পনা নেওয়া হবে।’
সিনেমার প্রিন্টের সবশেষ অবস্থা কী
বিশেষ প্রদর্শনীর জন্য এফডিসিকে পাঁচ কপি প্রিন্ট পাঠিয়েছিল সুনীল দত্তর প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান ‘অজন্তা আর্টস’। এফডিসির তথ্যমতে, এখন দুই কপি সংরক্ষিত আছে। বাকি তিন কপির খবর জানে না এফডিসি কর্তৃপক্ষ। এফডিসির উৎপাদন শাখার অতিরিক্ত পরিচালক জানে আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘এটা অনেক আগের বিষয়। এখন যাঁরা এই বিভাগে কর্মরত, তাঁদের অনেকেই তখন চাকরিতে যোগদান করেননি। তবে আমি ল্যাব শাখা থেকে আরও কয়েকটি দপ্তরে কথা বলে দুই কপি সংরক্ষিত আছে, এমন তথ্য পেয়েছি। তবে প্রিন্টগুলোর অবস্থা এখন কেমন, সে বিষয়ে ধারণা নেই।’
বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভেও ‘দর্দ কা রিশতা’ ছবির কোনো কপি সংরক্ষিত নেই। বিষয়টি প্রথম আলোকে নিশ্চিত করেছেন আর্কাইভের চলচ্চিত্র কর্মকর্তা শাহজাহান কবির মজুমদার। তিনি বলেন, ‘এ চলচ্চিত্রের কোনো কপি আমাদের এখানে কখনো জমা পড়েনি।’