দিলজিৎ দোসাঞ্জের চামকিলা হয়ে ওঠা

‘চামকিলা’ সিনেমার দৃশ্য। আইএমডিবি

সিনেমার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত একাই টেনে নিয়ে গেছেন। কোথাও মনে হয়নি অমর সিং চামকিলা হিসেবে অন্য কাউকে দেখছি। পরিচালক ইমতিয়াজ আলী ভারতের পাঞ্জাবের লোকগানের শিল্পী অমর সিং চামকিলার বিভিন্ন সময়ের স্থিরচিত্র পর্দায় যখন হাজির করছেন, তখনো বুঝতে অসুবিধা হয় না, আমরা অন্য চামকিলাকে দেখছি। সময়ের ব্যবধানে কিংবা বাস্তবের একজনকে অন্য মানুষের মাধ্যমে পর্দায় ফুটিয়ে তুলতে গেলে কিছুটা তো পার্থক্য ধরা দেবেই। কিন্তু গায়ক দিলজিৎ দোসাঞ্জ পর্দায় সেই কিছুটাকে পাশ কাটিয়ে দারুণভাবে অমর সিং চামকিলা হয়ে উঠতে পেরেছেন।
বলছিলাম নেটফ্লিক্সের আলোচিত সিনেমা ‘অমর সিং চামকিলা’র কথা। প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছেন পাঞ্জাবের আরেক জনপ্রিয় গায়ক, গীতিকার ও অভিনেতা দিলজিৎ দোসাঞ্জ। তাঁর সঙ্গে অমর সিং চামকিলার স্ত্রী অমরজোত কৌর চরিত্রে নিজের সবটা ঢেলে অভিনয় করেছেন পরিণীতি চোপড়া। সিনেমার আরেকটি চমক হচ্ছে গায়িকা পরিণীতি চোপড়া।

লোকগানের শিল্পী অমর সিং চামকিলা
লোকগানের শিল্পী অমর সিং চামকিলা ১৯৮০-এর দশক যেন নিজের করে নিয়েছিলেন। পাঞ্জাবের সাধারণ জনতাকে মাতিয়ে রেখেছিলেন মুখে মুখে বলা কামনা, বাসনার কথা গানে গানে তুলে ধরার মাধ্যমে। যে গান অশ্লীলতার দায়ে দুষ্ট হয়েছিল।
পাঞ্জাবের লুধিয়ানার ডুগরি গ্রামে জন্ম নেওয়া অমর সিং ওরফে চামকিলার আসল নাম ধানি রাম। দলিত শিখ সম্প্রদায়ের চামকিলা বাজাতে পারতেন হারমোনিয়াম ও ঢোলক। টুম্বি নামে একধরনের বাদ্যযন্ত্র ছিল চামকিলার নিত্যসঙ্গী।

আরও পড়ুন

১৯৭৯ সালে পাঞ্জাবের লোকগানের আরেক প্রথিতযশা শিল্পী সুরিন্দর সিন্দার অফিসে গিয়ে হাজির হন। চামকিলার গায়কি ও গানের কথা ভালো লেগে যায় সিন্দার। গানের কথা যে চামকিলার লেখা, এটা জেনে সিন্দা অবাক হয়ে যান। পরে নিজের শিষ্য বানিয়ে নেন চামকিলাকে। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। একে একে সব হিট অ্যালবাম চামকিলা উপহার দেন এবং পাঞ্জাবের লোকগানের বাজার দখল করে নেন। তাঁর অ্যালবাম পাঞ্জাবে সর্বোচ্চ বিক্রির বেকর্ড গড়ে, যা এখনো কেউ ভাঙতে পারেননি। ওই সময় তিনি স্টেজ শো করতে সবচেয়ে বেশি পারিশ্রমিক নিতেন।

‘চামকিলা’ সিনেমার দৃশ্য। আইএমডিবি

চামকিলা যখন ক্যারিয়ারের তুঙ্গে, তখন পাঞ্জাবের পাশাপাশি ভারতবর্ষে খালিস্তান আন্দোলন জোরদার হয়ে ওঠে। তাঁর বাড়িতে মৃত্যুর হুমকি-সংবলিত চিঠি আসতে শুরু করে। বলা হয়, অশ্লীল গান বন্ধ না করলে তাঁকে মেরে ফেলা হবে। খালিস্তানপন্থী গুরু যাঁরা, তাঁরাও চামকিলাকে ডেকে গান বন্ধ করার জন্য হুমকি দেন।

মজার ব্যাপার হচ্ছে, ধর্মগুরুদের কাছ থেকে হুমকি পাওয়ার পর চামকিলা ধর্মীয় সংগীত গাইতে শুরু করেন এবং তাঁর ধর্মীয় সংগীতের অ্যালবাম লোকগানের অ্যালবামের বিক্রিকেও ছাড়িয়ে যায়। কিন্তু চামকিলা তো জনগণের শিল্পী। স্টেজে উঠে জনগণের চাওয়ার মুখে লোকগান না গেয়ে পারেন! একসময় কোনো হুমকিকে আর পরোয়া করেন না। গাইতে থাকেন নিজের গান। অবশেষে ঘটে যায় সেই অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। ১৯৮৮ সালের ৮ মার্চ পাঞ্জাবের মেহসামপুরে একটি শো করতে গিয়ে গাড়ি থেকে নামার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় গুলিবর্ষণ। তবে এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে কারা ছিল, তা এখন পর্যন্ত কেউ জানতে পারেনি।
অমর সিং চামকিলাকে ‘পাঞ্জাবের এলভিস প্রিসলি’ বলা হতো।

দিলজিৎ ও চামকিলা
২০১৮ সালে মুক্তি পায় ব্রায়ান সিঙ্গার ও ডেক্সটার ফ্লেচার পরিচালিত বায়োগ্রাফিক্যাল চলচ্চিত্র ‘বোহেমিয়ান র‌্যাপসোডি’। নব্বইয়ের দশকের বিখ্যাত কুইন ব্যান্ডকে কেন্দ্র করে সিনেমাটি নির্মিত। ‘অমর সিং চামকিলা’র সঙ্গে ‘বোহেমিয়ান র‌্যাপসোডি’র সম্পর্ক নেই। কিন্তু কুইন ব্যান্ডের ফ্রেডি মার্কারি চরিত্রে রামি মালিক যে দুর্দান্ত অভিনয় করেন, অমর সিং চামকিলা চরিত্রে দিলজিৎ দোসাঞ্জকেও তেমনটাই মনে হয়েছে। একটাতে ব্যান্ড সংগীতে রামি মালিক মিলেমিশে একাকার, অন্যটাতে লোকগানে দিলজিৎ দোসাঞ্জ।

‘চামকিলা’ সিনেমার দৃশ্য। আইএমডিবি

১৯৮৪ সালে পাঞ্জাবে যখন খালিস্তানপন্থীদের সঙ্গে দাঙ্গা লাগে, সেই সময়ে জলন্ধর জেলার দোসাঞ্জ কালানের শিখ পরিবারে দিলজিতের জন্ম। তিনিও একজন গায়ক। দোসাঞ্জ কালানে শৈশব কাটিয়ে অমর সিং চামকিলার জন্মস্থান লুধিয়ানায় চলে যান দিলজিৎ। সেখানে পড়াশোনার পাশাপাশি স্থানীয় গুরুদুয়ারায় কীর্তন শিখতে শুরু করেন। মাত্র ১৮ বছর বয়সে তিনি প্রথম অ্যালবাম প্রকাশ করেন। পাঞ্জাবে হয়ে ওঠেন জনপ্রিয়।

‘অমর সিং চামকিলা’ সিনেমার পরিচালক ইমতিয়াজ আলী শুটিংয়ের সময় নকল সেট না বানিয়ে চামকিলা যেসব জায়গায় শো করেছেন বলে জানতে পেরেছেন, সেসব জায়গাতেই সেট ফেলেছেন। এমনকি পর্দায় যেখানে আমরা চামকিলার হত্যাকাণ্ড ঘটতে দেখি, সেখানেই ১৯৮৮ সালের ৮ মার্চ ঘটেছিল সেই হত্যাকাণ্ড।
সব মিলিয়ে পরিচিত গণ্ডি পেয়ে দিলজিৎ দোসাঞ্জ নিজেকে মেলে ধরেছেন শতভাগ। হয়ে উঠেছেন সত্যিকারের চামকিলা।

পরিণীতি চোপড়া ও অমরজোত কৌর
অমর সিং চামকিলার গানের জুটি প্রয়োজন। এ জন্য সুরিন্দর সিন্দার স্ত্রী সোনিয়া জুটি বাঁধেন চামকিলার সঙ্গে। এই জুটির বেশ কয়েকটি অ্যালবাম জনপ্রিয়তা পায়। পরে বনিবনা না হওয়ায় ভেঙে যায় এই জুটি। তাই বলে তো আর শো বন্ধ থাকতে পারে না! শুরু হয় খোঁজ। নতুন কারও সঙ্গে জুটি বাঁধতে চেয়েও মনের মতো কাউকে পাচ্ছিলেন না চামকিলা। এমন সময় এসে হাজির অমরজোত কৌর। পালাগানের আদলে চামকিলার গাওয়া গানগুলোর যোগ্য সঙ্গী হয়ে ওঠেন অমরজোত কৌর। একপর্যায়ে হয়ে ওঠেন চামকিলার জীবনসঙ্গী। এমনকি মৃত্যুকে একই সঙ্গে বরণ করে নেন। অমরজোত কৌর চরিত্রে বেশ সাবলীল ছিলেন পরিণীতি চোপড়া।

পর্দায় আমরা দিলজিৎ দোসাঞ্জের কণ্ঠ যেমন শুনতে পাই, তেমনি পরিণীতি চোপড়াও তাঁকে সমানতালে সঙ্গ দিয়ে গেছেন, গেয়েছেন গান। আর অভিনয়? পরিণীতির পারফেকশনের জায়গা বোঝা যায়, যখন আসল অমরজোতের ফুটেজ আমরা পাশাপাশি দেখতে পাই।

‘চামকিলা’ সিনেমার পোস্টার। আইএমডিবি

সবশেষে সংগীতায়োজনের কথা বলতে হয়। শুরুতে ‘চামকিলা’ গান দিয়ে শুরু, এরপর পুরো সিনেমায় দিলজিৎ দোসাঞ্জ ওরফে চামকিলার কণ্ঠে মাতোয়ারা হয়ে থাকা। শেষ দিকে এসে পুরো সংগীতায়োজন ছিল যাঁর কাঁধে, সেই এ আর রাহমানের কণ্ঠে বুঁদ হয়ে থাকে দর্শক।

‘অমর সিং চামকিলা’ এখন আলোচনার কেন্দ্রে। সেই সঙ্গে আলোচনার কেন্দ্রে দিলজিৎ দোসাঞ্জ আর পরিণীতি চোপড়া। কম যান না পরিচালক ইমতিয়াজ আলীও।