হরর সিনেমার শুটিংয়ে অর্ধগলিত মৃতদেহ...
বলিউডের ইতিহাসে কাপুর পরিবারের নাম যতবার উচ্চারিত হয়, তার আড়ালে চাপা পড়ে যায় আরেক চলচ্চিত্র পরিবার—রামসে ব্রাদার্স। পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশ থেকে দেশভাগের পর মুম্বাইয়ে পাড়ি জমানো এই পরিবার একসময় ভৌতিক ছবিকে বলিউডে স্বতন্ত্র ধারায় প্রতিষ্ঠিত করে। শুরুতে তাদের কেউ পাত্তা না দিলেও পরে ঠিকই চলচ্চিত্রে নিজেদের ছাপ রাখেন রামসে ব্রাদার্স।
শুরু গল্প
কপর্দকহীন, নিঃস্ব পরিবারের কর্তা এফ ইউ রামসে প্রথমে হাত দেন প্রযোজনায়। একের পর এক ব্যর্থতা তাঁকে ক্লান্ত করে তোলে। ১৯৭০ সালে ‘এক নান্নি মুন্নি লড়কি থি’ নামে একটি ছবি বানালেন, যেখানে অভিনয় করেছিলেন মুমতাজ, শত্রুঘ্ন সিনহা আর প্রীতিভূষণ কাপুর। ছবিটি চলেনি, তবে প্রদর্শনীর রাতে এক ঘটনার মধ্যে দিয়েই বদলে যায় রামসে পরিবারের ভাগ্য। ছবির এক ডাকাতির দৃশ্যে প্রীতি ভূষণ কাপুর প্রস্থেটিক মেকআপ পরে হঠাৎ হাজির হলে ঘুমন্ত দর্শক হকচকিয়ে উঠে চিৎকার শুরু করে। সেদিনই তুলি রামসের মাথায় আসে ভাবনা—‘পুরোদস্তুর ভৌতিক ছবি কেন বানানো যাবে না?’
নতুন ইতিহাস
নাটকীয় এই ঘটনার পরেই শুরু হয় ইতিহাস। অল্প বাজেট, আত্মীয়স্বজনকে নিয়ে বানানো ‘দো গজ জমিন কে নিচে’ ছবিই পাল্টে দেয় সব। দিনে মাত্র ৫০০ টাকায় ভাড়া করা পুরোনো প্রাসাদ, ধার করা যন্ত্রপাতি, খণ্ডকালীন অভিনেতা, আর রান্না করতেন তাঁদের মা নিজ হাতে।
কাকতালীয়ভাবে শুটিং চলাকালীন আসলেই মাটির নিচে একটি অর্ধগলা মৃতদেহ বেরিয়ে আসে। হইচই থামাতে মরদেহ আবার কবর দিয়ে সেখানে প্রদীপ জ্বালানো হয়। ৪০ দিনে ৩ দশমিক ৫ লাখ রুপি তৈরি ছবিটি আয় করে ৪৫ লাখ রুপি। সাফল্যের এই সূত্র পরে তাঁরা আরও ৩৫ বার ব্যবহার করেন।
এবং ‘পুরানা মন্দির’
১৯৮৪ সালে ‘পুরানা মন্দির’ বক্স অফিসে ঝড় তোলে—আয় ২ দশমিক ৫ কোটি রুপি। এই ছবিই প্রথমবার রামসেদের নাম নিয়ে যায় মূলধারার আলোচনায়। বড় পরিবারগুলোর দৃষ্টি তখন তাঁদের দিকে। তুলি রামসে পরে বলেছিলেন, ‘কাপুররা আমাদের দেখে হাসতেন, ভাবতেন আমরা কী করছি। কিন্তু তাঁরাও আমাদের ছবি দেখতেন।’ মজার ব্যাপার, তাঁদের প্রেরণার উৎসও ছিলেন একজন কাপুর—‘এক নান্নি মুন্নি লড়কি থি’ ছবির সেই প্রীতি ভূষণ কাপুর!
সাফল্যের রহস্য
রামসে হাউসে তখনকার দিনগুলো ছিল পরিশ্রম আর স্বপ্নের মিশ্রণ। সাত ভাই দুই কামরায় গাদাগাদি করে থাকতেন। কাজ শেষে বসে গল্প লিখতেন, ভূতের কাহিনি বানাতেন, বাজি ধরতেন—কার গল্প চা-পানের সময় সেরা হয়। বড় তারকা না পেলেও তাঁরা জানতেন, তাঁদের ছবির আসল নায়ক হলো ‘দানব’। তুলি মজা করে বলতেন, ‘আমার কাছে রাজেশ খান্না আছে, আমার কাছে শাহরুখ খান আছে’—মানে তাঁদের ভৌতিক চরিত্রই আসল তারকা।
রামসে যুগের ইতি
রামসে ভ্রাতৃদ্বয়ের সাফল্যের কেন্দ্র ছিল ছোট শহরের দর্শক। শ্যাম রামসে বলেছিলেন, ‘মফস্বলের প্রেক্ষাপট ভয় জাগাতে শহরের চেয়ে অনেক বেশি কার্যকর।’ তবে নব্বইয়ের দশক নাগাদ এই সূত্র আর আগের মতো কাজ করছিল না। সমালোচক খালিদ মোহাম্মদ বলেছিলেন, ‘আসলে দর্শকের রুচি পাল্টায়নি, পাল্টেছিল রামসে ভাইদের ঐক্য।’
পরবর্তী প্রজন্মের দীপক রামসে ছোটপর্দায় ‘জি হরর শো’ বানিয়ে কিছুটা সাড়া ফেললেও মাল্টিপ্লেক্স যুগে এসে রামসে ব্রাদার্সের অধ্যায় শেষ হয়।
তুলি এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘সিনেমায় টিকে থাকতে লাগে আগুন। আমাদের শুরুর দিনে ছিল সেই আগুন। যেমন রাজ কাপুরের ছিল, আজ রণবীর কাপুরের আছে।’
২০১৯ সালের মধ্যে তুলি আর শ্যাম দুজনেই পৃথিবী ছেড়ে যান। তাঁদের মৃত্যুর পর ‘রাইটিং উইথ ফায়ার’-এর অস্কার মনোনীত নির্মাতা সুশমিত ঘোষ ও রিন্তু থমাস মন্তব্য করেন, ‘রামসেরা হিন্দি সিনেমায় এমন এক ভাষা তৈরি করেছিলেন, যার কোনো নজির ছিল না। কিন্তু দুঃখজনকভাবে, ভারতীয় শিল্পীদের মতো তাঁরাও জীবদ্দশায় তাঁদের অবদান যথাযথ মর্যাদা পাননি।’
তথ্যসূত্র: ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস