যৌনতা আছে কিন্তু ‘আগ্রা’ কেবল যৌনতা নিয়ে নয়
মানুষ কেন যৌন সম্পর্ক তৈরি করে? সন্তানের জন্ম দেওয়ার জন্য? সম্পর্কের বন্ধন গড়ার জন্য? নাকি শারীরিক ও মানসিক তৃপ্তির জন্য? ২০১৪ সালে ‘তিতলি’ বানিয়ে চমকে দিয়েছিলেন কানু বেহেল; এবার ‘আগ্রা’য় তিনি যৌনতা নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নগুলোর গভীর অনুসন্ধান করেছেন। এ সিনেমা দেখায়, যৌনতা কীভাবে নিয়ন্ত্রণের মাধ্যম হয়ে দাঁড়ায়।
একনজরে
সিনেমা: ‘আগ্রা’
নির্মাতা: কানু বেহেল
অভিনয়: মোহিত আগরওয়াল, রাহুল রায়, প্রিয়াঙ্কা বোস, রুহানি শর্মা, বিভা চিব্বার
দৈর্ঘ্য: ২ ঘণ্টা ১২ মিনিট
সিনেমার মূল চরিত্র গুরু (মোহিত আগরওয়াল), বছর চব্বিশের যুবক; যার শৈশব আর কৈশোর কেটেছে দুঃস্বপ্নের মতো। সেই ট্রমা এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি। তার যৌন চাহিদার প্রকাশ এমনভাবে দেখিয়েছেন নির্মাতা, যা অনেক দর্শকের জন্য অস্বস্তিকর হতে পারে।
কানু বেহেল ও সহচিত্রনাট্যকার আতিকা চোহানের তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমরা দেখি, কীভাবে বিষাক্ত পিতৃতন্ত্র নারীর প্রতি পুরুষের মনে বিদ্বেষ তৈরি করে। গুরুর জীবনের নারী চরিত্ররা—মালা (রুহানি শর্মা), মা (বিভা চিব্বার) এবং পরে প্রীতি (প্রিয়াঙ্কা বোস)—শুধু গল্পের অংশ নয়; তারা যে গুরুর ভেতরের অন্ধকার ও সামাজিক কাঠামোর প্রতিফলন।
কে কোন ঘরে থাকবে, কার ওপরে কার নিয়ন্ত্রণ—সবই যেন মনস্তত্ত্বের প্রতীক। ছেলের কামনা, বাবার মালিকানা, ওপরের ঘরে ‘মিসট্রেস’-এর উপস্থিতি; প্রতিটাই লুকানো ক্ষমতার খেলা, নিয়ন্ত্রণ-লজ্জা-স্বাধীনতার টানাপোড়েন।
নিজের বন্ধ কক্ষ আর ‘ব্যর্থ জীবন’ গুরুকে ঠেলে দেয় একাকিত্ব আর ডিজিটাল যৌন কল্পনার দিকে। সহকর্মীর প্রতি আকর্ষণ তাকে বিভ্রমের জগতে নিয়ে যায়। বাড়িতে ফিরে বয়স্কদের দ্বন্দ্ব, অফিসে নিজের অসহায়ত্ব—সব মিলে সে ক্রমেই ভেঙে পড়ে। এ অবস্থায় বাড়িতে বোনের আগমন বাড়ির ক্ষমতার লড়াইকে আরও জটিল করে তোলে।
যখন মনে হয় গল্পটা পুরুষদের যৌন হতাশার বিজ্ঞাপনে পরিণত হবে, তখনই হাজির হন প্রীতি (প্রিয়াঙ্কা বোস); পোলিওতে আক্রান্ত এক বিধবা যে নিজস্ব আইনি ঝামেলায় জর্জর। প্রীতি চরিত্রটি হয়ে ওঠে গুরুর জন্য আবেগের মোড়।
একাকিত্ব আর সামাজিক ক্ষতই তাদের কাছে টেনে আনে। দুই ভেঙে পড়া মানুষ, যারা সমাজের চোখে অপূর্ণ; একসঙ্গে দাঁড়িয়ে পূর্ণতা খুঁজে পায়। সিনেমাটি সূক্ষ্মভাবে যৌনতা আর সামাজিক প্রভাবের মিল দেখায়, বুঝিয়ে দেয় ট্রমা কীভাবে কামনা আর হিংসার জন্ম দিতে পারে।
ছবিতে কোনো ‘পরিচ্ছন্ন’ চরিত্র নেই। ইচ্ছাকৃতভাবেই বেহেল দর্শককে অস্বস্তিতে ফেলেছেন বারবার। তিনি চেয়েছেন, দর্শক যেন নিজেদের অস্বীকার করা অন্ধকারের মুখোমুখি হয়। ছবির প্রতিটি ফ্রেমে উঁকি দেয় আতঙ্ক আর নীরব চাপা অস্বস্তি।
এ ধরনের সংবেদনশীল বিষয়ে সিনেমা নির্মাণে অনেক ভারতীয় নির্মাতা কমেডির আশ্রয় নেন, তবে কানু বেহেল কোনো রাখঢাক না রেখেই তিক্ত বাস্তব দর্শকের সামনে তুলে ধরেছেন।
গল্পের কিছু অংশ খানিকটা দুর্বল। সিনেমাটিতে নিম্নমধ্যবিত্ত ভারতীয় জীবন—ছোট বাড়ি, ব্যক্তিগত জায়গার অভাব, পারিবারিক চাপ—দর্শকের কাছে প্রাসঙ্গিক হলেও শেষ দিকে কিছুটা সহজ সমাধান মনে হয়।
অভিনয়ের দিক থেকে সবাই নিজেদের জায়গায় দুর্দান্ত। গুরুর চরিত্রে মোহিত আগরওয়াল, তাঁর বাবার চরিত্রে রাহুল রায় সিনেমার মূল আকর্ষণ। প্রিয়াঙ্কা বোস, বিভা চিব্বার, অঞ্চল গোস্বামী, রুহানি শর্মা নিজেদের চরিত্রে মনে রাখার মতো কাজ করেছেন।
কানু বেহেলের ‘আগ্রা’ চলতি বছর মুক্তি পাওয়া ভারতের সবচেয়ে সাহসী সিনেমাগুলোর একটি। এখানে নির্মাতা যৌনতার মোড়কে তিনি আলো ফেলেছেন সমাজের এক অন্ধকার দিকে; যা আমরা দেখেও দেখি না।
‘আগ্রা’ সবার জন্য নয়; দেখতে গিয়ে বারবার অস্বস্তিতে পড়তে হবে। তবে সেসব অস্বস্তি কাটিয়ে যাঁরা দেখতে পারবেন, তাঁদের অনেকের এ সিনেমার কথা অনেক দিন মনে থাকবে।