‘খ্যাতির লোভে আমি নগ্ন হতে পারিনি’
পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত মার্কিন মডেল ও বলিউড অভিনেত্রী নার্গিস ফাখরি। ২০১১ সালে ‘রকস্টার’ ছবির মাধ্যমে নার্গিসের বলিউডে অভিষেক। ‘ম্যায় তেরা হিরো’, ‘মাদ্রাজ ক্যাফে’, ‘হাউসফুল থ্রি’ ইত্যাদি সিনেমা তাঁকে পরিচিতি এনে দেয়। ‘রকস্টার’ ছবির সহ-অভিনেতা রণবীর কাপুরের সঙ্গে নার্গিসের প্রেমের খবর চাউর হয়। পরবর্তী সময়ে উদয় চোপড়া, রানা দাগুবতির সঙ্গেও তাঁর প্রেমের খবর ডালপালা মেলে। একসময় ‘ম্যায় তেরা হিরো’ ছবির সহ-অভিনেতা বরুণ ধাওয়ানের সঙ্গে চুটিয়ে প্রেম করেছেন নার্গিস ফাখরি। আজ এই অভিনেত্রীর জন্মদিন। জন্মদিনে জেনে নিই এই অভিনেত্রীর প্রেমের খবর।
নিউইয়র্ক থেকে বলিউড
১৯৭৯ সালের ২০ অক্টোবর নিউইয়র্কের কুইন্স সিটিতে জন্ম নেন নার্গিস ফাখরি। বাবা পাকিস্তানি, মা চেক রিপাবলিকের নাগরিক। ছয়-সাত বছর বয়সেই মা–বাবার বিচ্ছেদ তাঁকে ভীষণ নাড়া দিয়েছিল। ছোটবেলা থেকেই মায়ের প্রেরণায় বড় হয়েছেন নার্গিস। তিনি বলেন, ‘আমি ছোটবেলা থেকেই জানতাম, আমাকে লড়াই করে বাঁচতে হবে।’ জীবনের প্রথম অধ্যায় শুরু হয় মার্কিন মডেলিং জগতে। জনপ্রিয় রিয়েলিটি শো আমেরিকা’স নেক্সট টপ মডেল–এর মাধ্যমে তিনি আলোচনায় আসেন।সমালোচকদের মতে, লম্বা গড়ন, বুদ্ধিদীপ্ত চোখ আর আত্মবিশ্বাসী হাসিতে খুব দ্রুত ফ্যাশন দুনিয়ায় জায়গা করে নেন। কিন্তু তাঁর লক্ষ্য ছিল আরও বড়—চলচ্চিত্রে অভিনয়।
রণবীরের বিপরীতে তাঁর আবেগঘন অভিনয়, সরলতা ও পর্দায় উপস্থিতি দর্শকদের মুগ্ধ করে। একলাফে পরিচিতি পান ‘রকস্টার গার্ল’ হিসেবে।
‘রকস্টার’ দিয়ে যাত্রা
২০১১ সালে ইমতিয়াজ আলীর পরিচালনায় ‘রকস্টার’ ছবির মাধ্যমে বলিউডে আত্মপ্রকাশ করেন নার্গিস ফাখরি। ছবিতে তাঁর বিপরীতে ছিলেন রণবীর কাপুর। সিনেমাটি বক্স অফিসে সাফল্য পায় এবং সমালোচকদের কাছ থেকেও প্রশংসা কুড়ায়। রণবীরের বিপরীতে তাঁর আবেগঘন অভিনয়, সরলতা ও পর্দায় উপস্থিতি দর্শকদের মুগ্ধ করে। একলাফে পরিচিতি পান ‘রকস্টার গার্ল’ হিসেবে।
কিন্তু জনপ্রিয়তার সেই আলোয় যেমন প্রশংসা জোটে, তেমনি শুরু হয় ব্যক্তিগত জীবনের নানা গুঞ্জন। ‘রকস্টার’ ছবির শুটিং চলার সময় রণবীর কাপুর ও নার্গিস ফাখরির প্রেমের জোর গুঞ্জন ওঠে। প্রচুর সময় একসঙ্গে কাটাতে দেখা যায় তাঁদের। সে সময় নিজেদের সম্পর্ক নিয়ে ছবি মুক্তির আগপর্যন্ত মুখে কুলুপ এঁটে রেখেছিলেন তাঁরা। অবশেষে ছবি মুক্তির পর তাঁরা জানান, তাঁদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক নেই। সেই সময় প্রেমিকা ক্যাটরিনা কাইফের সঙ্গে প্রকাশ্যেই বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়াতে শুরু করেন রণবীর। আর নার্গিস নিজেকে সঁপে দেন অভিনেতা ও প্রযোজক উদয় চোপড়ার বাহুডোরে। পিটিআইসহ বিভিন্ন ভারতীয় গণমাধ্যমে খবরটি প্রকাশিত হয়।
প্রেম, বিচ্ছেদ আর আলোচনা
রণবীরের অধ্যায় শেষ না হতেই বলিউডে শোরগোল ওঠে আরেক প্রেমের গুঞ্জনে—নার্গিসের নতুন সঙ্গী উদয় চোপড়া। চোপড়া পরিবারের উত্তরাধিকারী উদয়ের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিল বলিউডের সবচেয়ে আলোচিত প্রেমগুলোর একটি। মালদ্বীপে তাঁদের ছুটি কাটানোর ছবি, সামাজিক অনুষ্ঠানে পাশাপাশি উপস্থিতি—সবকিছুই ইঙ্গিত দিচ্ছিল এক গভীর সম্পর্কের।
উদয় কখনো টুইটারে, কখনো ইনস্টাগ্রামে প্রকাশ্যে নার্গিসকে ভালোবাসার বার্তা দিয়েছেন। একবার টুইটে লিখেছিলেন, ‘নার্গিস, তুমি জানো না, আমাদের সম্পর্ক অনেক আগেই ঠিক হয়ে গিয়েছিল।’ পরে অবশ্য টুইটটি মুছে ফেলেন তিনি।
চোপড়া পরিবারের উত্তরাধিকারী উদয়ের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিল বলিউডের সবচেয়ে আলোচিত প্রেমগুলোর একটি। মালদ্বীপে তাঁদের ছুটি কাটানোর ছবি, সামাজিক অনুষ্ঠানে পাশাপাশি উপস্থিতি—সবকিছুই ইঙ্গিত দিচ্ছিল এক গভীর সম্পর্কের।
দীর্ঘদিন প্রেমের পর ২০১৪ সালে হঠাৎই বিচ্ছেদের খবর ছড়িয়ে পড়ে। ঘনিষ্ঠ সূত্রগুলো জানায়, উদয় চোপড়া সম্পর্কটিকে বিয়েতে রূপ দিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু নার্গিস তখন ক্যারিয়ারের দৌড়ে ব্যস্ত। প্রেম ভেঙে যাওয়ার পর তিনি বলেছিলেন, ‘আমি সবকিছু হারিয়েছিলাম—কিন্তু আবার উঠে দাঁড়াতে শিখেছি।’
সালমান খান ও রানা দাগুব
উদয়ের সঙ্গে বিচ্ছেদের পর বলিউডে নতুন গুঞ্জন—সালমান খানের সঙ্গে নার্গিসের ঘনিষ্ঠতা। সালমানের অনুরোধেই ‘কিক’ সিনেমার একটি আইটেম গানে তাঁকে নেওয়া হয়। তাঁদের সম্পর্ক বন্ধুত্বের সীমা অতিক্রম করেছে কি না, তা নিয়ে তখন নানা কানাঘুষা চলেছে ইন্ডাস্ট্রিতে।
তবে বলিউডে থিতু হতে না পারলেও দক্ষিণ ভারতের সিনেমায়ও পা রাখেন নার্গিস। সে সময় রানা দাগুবতির সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতার খবর ছড়িয়ে পড়ে। চেন্নাইয়ের এক শুটিংয়ে তাঁদের পরিচয় থেকে শুরু হয় বন্ধুত্ব, পরে সেটি পরিণতি পায় স্বল্পস্থায়ী প্রেমে।
২০১৪ সালে মুক্তি পাওয়া ‘ম্যায় তেরা হিরো’ সিনেমায় নার্গিসের সঙ্গে ছিলেন বরুণ ধাওয়ান। ছবির সময়কার রসায়ন বাস্তবেও আলোচনার জন্ম দেয়। গুঞ্জন ওঠে—উদয়ের সঙ্গে বিচ্ছেদের পর বরুণের সঙ্গেই সময় কাটাচ্ছেন নার্গিস। যদিও কোনো পক্ষই কখনো মুখ খোলেনি।
বলিউডে থিতু হতে না পারলেও দক্ষিণ ভারতের সিনেমায়ও পা রাখেন নার্গিস। সে সময় রানা দাগুবতির সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতার খবর ছড়িয়ে পড়ে। চেন্নাইয়ের এক শুটিংয়ে তাঁদের পরিচয় থেকে শুরু হয় বন্ধুত্ব, পরে সেটি পরিণতি পায় স্বল্পস্থায়ী প্রেমে।
বিদেশে সময় কাটানো, ব্যক্তিগত জীবনকে প্রাধান্য দেওয়া এবং পাপারাজ্জিদের চোখ এড়িয়ে চলা—সব মিলিয়ে যেন হারিয়ে যেতে থাকেন তিনি। এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘মানুষ আমার কাজের চেয়ে ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে বেশি আগ্রহী। সবাই জানতে চায়, আমি কাকে ভালোবাসি, কার সঙ্গে ডেট করছি। এতে আমি ক্লান্ত।’
গোপন বেদনা
‘মাদ্রাজ ক্যাফে’, ‘হাউসফুল থ্রি’, ‘আজহার’, ‘বানজো’—একটার পর একটা ছবি করলেও নার্গিস বলিউডে নিজের অবস্থান মজবুত করতে পারেননি। ধীরে ধীরে তাঁকে দেখা যায় কম কাজ করতে। বিদেশে সময় কাটানো, ব্যক্তিগত জীবনকে প্রাধান্য দেওয়া এবং পাপারাজ্জিদের চোখ এড়িয়ে চলা—সব মিলিয়ে যেন হারিয়ে যেতে থাকেন তিনি। এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘মানুষ আমার কাজের চেয়ে ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে বেশি আগ্রহী। সবাই জানতে চায়, আমি কাকে ভালোবাসি, কার সঙ্গে ডেট করছি। এতে আমি ক্লান্ত।’
নার্গিস নিজের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে খোলাখুলি কথা বললেও এক বিষয় সব সময় আড়াল রেখেছেন—তাঁর একাকিত্ব। তিনি বলেছিলেন, ‘খ্যাতির দাম দিতে হয়। আপনি যত জনপ্রিয় হবেন, তত একা হয়ে পড়বেন।’ তিনি আরও বলেন, ‘ইন্টারনেট আর সামাজিক মাধ্যম আমাদের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা কেড়ে নিয়েছে। এখন আমি নিজেকে যেন নগ্ন মনে করি, সবাই আমার জীবনে উঁকি দেয়।’
নার্গিস তাঁর কাজের নীতি নিয়ে বরাবরই আপসহীন। আবেদনময়ী চরিত্রে অভিনয়ে আপত্তি নেই, তবে কখনোই নগ্ন হতে রাজি নন। তাঁর ভাষায়, আবেদনময়ী বা যৌনতা নিয়ে নির্মিত সিরিজে অভিনয়ে আপত্তি নেই তাঁর। কিন্তু কখনোই নগ্ন হতে পারবেন না। চরিত্রের প্রয়োজনে কখনোই পর্দায় নগ্ন হবেন না বলেও জানান নার্গিস। তিনি বলেন, ‘আমি কখনোই নগ্ন হতে পারব না। এতে আমার সমস্যা আছে।’
নার্গিসের জীবনের গল্প কেবল একজন অভিনেত্রীর নয়—এ এক সাহসী নারীর গল্প, যিনি নিজের সীমারেখা টেনেছেন নিজের মতো করে। তিনি নাম-যশের জন্য সমঝোতা করেননি, ক্যারিয়ারের ক্ষতি মেনেও মর্যাদা বেছে নিয়েছেন।
এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, পরিচালকের শয্যাসঙ্গী হননি বলে তাঁকে ছবি থেকে বাদ পড়তে হয়েছিল। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি সব সময় জানতাম যে আমি কোন জিনিসের জন্য ক্ষুধার্ত। আমি কখনোই নাম বা যশের জন্য ক্ষুধার্ত ছিলাম না। তাই আমি কোনো কিছুর সঙ্গে সমঝোতা করতে পারিনি। নাম বা খ্যাতির লোভে আমি নগ্ন হতে পারিনি। আর পরিচালকের সঙ্গে রাত কাটাতে পারিনি। এ কারণে আমার হাত থেকে প্রচুর কাজ বেরিয়ে গেছে। আমার জীবনে এমন সব ঘটনা আছে, যা সবাইকে শিহরিত করবে।’
নার্গিসের জীবনের গল্প কেবল একজন অভিনেত্রীর নয়—এ এক সাহসী নারীর গল্প, যিনি নিজের সীমারেখা টেনেছেন নিজের মতো করে। তিনি নাম-যশের জন্য সমঝোতা করেননি, ক্যারিয়ারের ক্ষতি মেনেও মর্যাদা বেছে নিয়েছেন।
আজ ২০ অক্টোবর, তাঁর জন্মদিন। বলিউডে তিনি হয়তো আর নিয়মিত নন, কিন্তু একসময়কার সেই ঝলমলে উপস্থিতি আজও ভোলেননি দর্শকেরা। নিজের জীবন ও সিদ্ধান্তের প্রতি নার্গিসের আত্মবিশ্বাস তাঁকে অন্যদের থেকে আলাদা করে তোলে। তিনি একবার বলেছিলেন, ‘আমি হয়তো সবার মতো সাফল্য পাইনি, কিন্তু নিজের মতো করে বাঁচতে পেরেছি—এই তো আমার জয়।’