২৪ দিনে ১ হাজার কোটি, ‘ধুরন্ধর’ কোন জাদুতে বাজিমাত করেছে

বলিউডের ধুরন্ধর ছবির একটি দৃশ্য।ছবি: সংগৃহীত

৫ ডিসেম্বর মুক্তির পর থেকেই বক্স অফিসে ঝড় তুলেছিল আদিত্য ধরের সিনেমা ‘ধুরন্ধর’। হেসেখেলে বক্স অফিসে হাজার কোটি রুপি আয় পূর্ণও করেছে। সবাইকে পেছনে ফেলে চলতি বছর ভারতের সবেচেয়ে আয় করা সিনেমা এখন এটি। কিন্তু কোন জাদুতে বাজিমাত করল সিনেমাটি?

হাজার কোটির ক্লাবে রণবীর সিং, অক্ষয় খান্না, সঞ্জয় দত্ত, আর মাধবন, অর্জুন রামপাল ও সারা অর্জুনকে নিয়ে নির্মিত স্পাই–থ্রিলার ‘ধুরন্ধর’ এখনো বক্স অফিসে দুর্দান্ত ব্যবসা করছে। আদিত্য ধর পরিচালিত ছবিটি মুক্তি পায় ৫ ডিসেম্বর। প্রথম দিন থেকেই এটি বক্স অফিসে দাপট দেখাতে শুরু করে। মুক্তির মাত্র ২১ দিনের মাথায় এটি ঢুকে পড়ে ‘হাজার কোটির ক্লাবে’।

সারা বিশ্বে ধুরন্ধর আয় করেছে ১ হাজার ৬ কোটি ১৫ লাখ রুপি। মুক্তির প্রথম সপ্তাহে আয় ২১৮ কোটি, দ্বিতীয় সপ্তাহে ২৬১ কোটি ৫০ লাখ রুপি। বড়দিনে একাই আয় করে ২৮ কোটি ৬০ লাখ রুপি। ভারতীয় বক্স অফিস থেকে এখন পর্যন্ত ছবিটির আয় ৭৮৯ কোটি ১৮ লাখ রুপি। বাণিজ্য–বিশ্লেষকদের মতে, ধুরন্ধর–এর ঝড় এখনো থামার নয়।

‘ধুরন্ধর’ কেন আলাদা
বলিউডে যশরাজ স্পাই ইউনিভার্সসহ নানা ধরনের সিনেমা ফি বছর মুক্তি পায়, কিন্তু সব ছবির ভিড়ে ‘ধুরন্ধর’ কোথায় আলাদা?

‘ধুরন্ধর’-এর শিরোনাম গান শুরু হয় এক ঘোষণায়—‘লেডিস অ্যান্ড জেন্টলম্যান, ইউ আর নট রেডি ফর দিস।’ প্রথম শুনতে এটি বলিউডের পরিচিত একধরনের হাইপ-ডায়ালগ বলেই মনে হয়—যা সাধারণত ঝাঁ–চকচকে, স্টাইলিশ, অ্যাকশনভরা গুপ্তচর ছবির আগে শোনা যায়। ট্রেলার, টিজার ও গানগুলোও সেই প্রত্যাশাই তৈরি করে—সহিংসতা, বিশাল স্কেল, বাস্তব ঘটনা থেকে প্রেরণা এবং তারকাখচিত অভিনয়, যা দর্শককে বড় রোমাঞ্চের প্রতিশ্রুতি দেয়।

একমুহূর্তের জন্য যদি ধরে নেওয়া হয় হামজা যে ভারতীয় গুপ্তচর—এই তথ্য বাদ দেওয়া হলো, তাহলেও ছবিটি টিকে থাকে। তখন এটি হয়ে ওঠে এক সাধারণ মানুষের সহিংস আন্ডারওয়ার্ল্ডে ধাপে ধাপে উঠে আসার গল্প—ভয়, কর্তৃত্ব ও বেঁচে থাকার লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে। ভারতীয় বাণিজ্যিক সিনেমার চিরচেনা ধারাও এখানে গুপ্তচর কাহিনির সঙ্গে সমান্তরালভাবে চলে। এ কারণেই ‘ধুরন্ধর’ একসঙ্গে দুটি ছবি হয়ে ওঠে—একটি মাটির কাছাকাছি থাকা গুপ্তচর থ্রিলার এবং একটি আন্ডারওয়ার্ল্ড উত্থানের গল্প।

কিন্তু ছবিটি সেই লাইনটির সত্যতা প্রমাণ করে একেবারেই ভিন্নভাবে। ছবিতে সহিংসতার তীব্রতার আর বিষয়বস্তুর গভীরতার জন্য কেউই প্রস্তুত ছিল না। সিনেমায় এমন অনেক কিছুই আছে যা সাধারণত মূল ধারার বাণিজ্যিক হিন্দি সিনেমায় দেখা যায় না।

‘ধুরন্ধর’ সিনেমায় রণবীর সিং। এক্স থেকে

‘ধুরন্ধর’ কাউকে মুগ্ধ করতে তাড়াহুড়া করে না। ঘরানার প্রতি সম্পূর্ণ দায়বদ্ধ থেকে এমন এক কাজ করে, যা বলিউডের গুপ্তচর সিনেমায় খুবই বিরল—এটি গুপ্তচরবৃত্তিকে ফ্যান্টাসি হিসেবে নয়, বরং দীর্ঘস্থায়ী মানসিক বন্দিত্ব হিসেবে উপস্থাপন করে।

অ্যাকশনের চেয়ে রাজনীতি বেশি

কাগজে-কলমে ‘ধুরন্ধর’-এর গল্প বলিউডের পরিচিত ছকেই শুরু হয়—ভারতে ধারাবাহিক সন্ত্রাসী হামলা, গোয়েন্দা সংস্থার অনুসন্ধানে সূত্রের শেষ গন্তব্য করাচি, আর সেই সূত্র ভেদ করতে পাঠানো হয় একজন আন্ডারকভার এজেন্টকে, করাচির লিয়ারিতে।

কিন্তু আদিত্য ধর এটিকে অ্যাকশন কাঠামো হিসেবে ব্যবহার করতে রাজি নন। তিনি গল্পটিকে সাজান রাজনৈতিক দাবার বোর্ডের মতো—যেখানে প্রতিটি চাল ধীর, পর্যবেক্ষিত ও পরীক্ষিত।

‘ধুরন্ধর’ সিনেমায় অক্ষয় খান্না। এক্স থেকে

হামজা লিয়ারিতে কোনো নায়ক বা সুপারস্পাই হিসেবে প্রবেশ করে না। সে ঢোকে স্রেফ এক সাধারণ মানুষ হিসেবে—যাকে পরীক্ষা করা হবে, আর টিকে থাকতে হবে। তার আগমনের প্রথম দৃশ্যই নির্মাতার উদ্দেশ্য স্পষ্ট করে দেয়। এই ছবি গুপ্তচরবৃত্তিকে ‘কুল’ দেখাতে চায় না। এটিকে বিপজ্জনক সেটা অনুভব করাতে চায়।

গুপ্তচর কাহিনির আড়ালে আন্ডারওয়ার্ল্ডের উত্থান

এই ছবির চালিকাশক্তি কেবল মিশন নয়। লিয়ারির অভ্যন্তরীণ ক্ষমতার কাঠামো, গ্যাং রাজনীতি, দর–কষাকষি ও দ্বন্দ্ব গল্পে অনেক বেশি জায়গা নেয়।

একমুহূর্তের জন্য যদি ধরে নেওয়া হয় হামজা যে ভারতীয় গুপ্তচর—এই তথ্য বাদ দেওয়া হলো, তাহলেও ছবিটি টিকে থাকে। তখন এটি হয়ে ওঠে এক সাধারণ মানুষের সহিংস আন্ডারওয়ার্ল্ডে ধাপে ধাপে উঠে আসার গল্প—ভয়, কর্তৃত্ব ও বেঁচে থাকার লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে।

ভারতীয় বাণিজ্যিক সিনেমার চিরচেনা ধারাও এখানে গুপ্তচর কাহিনির সঙ্গে সমান্তরালভাবে চলে। এ কারণেই ‘ধুরন্ধর’ একসঙ্গে দুটি ছবি হয়ে ওঠে—একটি মাটির কাছাকাছি থাকা গুপ্তচর থ্রিলার এবং একটি আন্ডারওয়ার্ল্ড উত্থানের গল্প।

বলিউডের ধুরন্ধর ছবির একটি দৃশ্য।
ছবি: সংগৃহীত

বলিউড যেটা খুব কমই চেষ্টা করে

‘ধুরন্ধর’-এর উচ্চাকাঙ্ক্ষা সবচেয়ে স্পষ্ট হয় এর নির্মাণভঙ্গিতে। আদিত্য ধর ইচ্ছাকৃতভাবে সময় নেন, কিন্তু নিয়ন্ত্রণ হারান না।

প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টার দৈর্ঘ্যের এই ছবি মূলত একই ভৌগোলিক ও মানসিক পরিসরের মধ্যেই উন্মোচিত হয়। অধ্যায়ভিত্তিক কাঠামো, পর্দায় লেখা টেক্সট, দীর্ঘ সংলাপ আর অপেক্ষার দৃশ্য—সব মিলিয়ে ছবিটি দ্রুত এক শিখর থেকে আরেক শিখরে ছুটতে চায় না।

এটি অন্য গুপ্তচর ছবির মতো পর্যটন বিজ্ঞাপনের ঢঙে এ দেশ থেকে ও দেশে ঘুরে বেড়ায় না।

তথ্যচিত্র ঘরানার বাস্তবতা আর ‘মাস’ স্টাইল—এই দুইয়ের মিশ্রণই ছবিটির পরিচয় গড়ে তোলে।

ধূসর দুনিয়ায় স্বাগতম

‘ধুরন্ধর’-এর মাধ্যমে আদিত্য ধর এমন এক নির্মাতার স্বাক্ষর প্রতিষ্ঠা করেন, যা আজকের বলিউডে বিরল। এখানে লিয়ারি কেবল পটভূমি নয়। এটি জীবন্ত।

ময়লা, গরম, ঘাম, হতাশা—সবকিছু স্পর্শযোগ্য। প্রোডাকশন ডিজাইন এতটাই নিখুঁত যে রাস্তাঘাট, বাড়িঘর, গুদাম কিংবা জিজ্ঞাসাবাদ কক্ষ—কিছুই সাজানো মনে হয় না। সবকিছু যেন সময় আর সহিংসতায় ক্ষয়ে যাওয়া বাস্তব জায়গা।

কেন ‘ধুরন্ধর’ গুরুত্বপূর্ণ? ‘ধুরন্ধর’ দেশপ্রেমের লেকচার বা বাড়তি চমক দিয়ে ঘরানা বদলায় না। এটি তা করে বাস্তবতা লঘু না করে। এখানে পুরুষত্ব মানে বুক ঠুকে বীরত্ব নয়। মানে টিকে থাকার ক্ষমতা। সহিংসতা প্রদর্শনী নয়, পরিণতি। ছবিটি নিখুঁত নয়—প্রেমের ট্র্যাক দুর্বল, দৈর্ঘ্য ধৈর্য চায়। কিন্তু এর দৃঢ়তা কখনো টলে না। বলিউডের স্টাইলিশ গুপ্তচর কল্পনার ভিড়ে ‘ধুরন্ধর’ আলাদা হয়ে দাঁড়ায়, কারণ এটি দর্শককে স্বস্তি দেয় না বরং কঠিন বাস্তবতার মুখে ঠেলে দেয়।

সংগীতও সেই বাস্তবতাকে গভীর করে। পাকিস্তান দেখাতে গিয়ে সাধারণত যে আরবি-মধ্যপ্রাচ্য সাউন্ড ব্যবহার করা হয়, ‘ধুরন্ধর’–এ সেটা করা হয়নি। শাশ্বত সচদেবের সংগীতে পুরোনো কাওয়ালি, রেট্রো বলিউড, পাঞ্জাবি লোকগান আর ডিস্কোর ছায়া—সব মিলেমিশে পরিবেশকে অস্বস্তিকর করে তোলে, এক্সোটিক নয়।

স্টাইল নয়, টিকে থাকার জন্য গড়া চরিত্র ‘ধুরন্ধর’ বুঝতে পারে—গুপ্তচর ছবিতে সবচেয়ে জরুরি হলো চরিত্র। রণবীর সিং এখানে হামজাকে গড়ে তোলেন অসাধারণ সংযমে। তার স্থিরতা কৌশলগত, নীরবতা পরিকল্পিত।

শত্রু পরিবেশে আন্ডারকভার এজেন্টের আবেগ প্রকাশের সুযোগ নেই—এই সত্য ছবিটি মেনে চলে। ফলে যখন সহিংসতা আসে, তা আরও গভীরভাবে আঘাত করে।

এখানে নেই দেশপ্রেমের চেনা আরাম—কোনো ভাষণ নেই, নিরাপদ ঘর নেই, স্বীকৃতির আশ্বাস নেই। হামজা জানে, ধরা পড়লে দেশ তাকে অস্বীকার করবে, মরলে মিশনসহ সে হারিয়ে যাবে। এই নামহীনতা কোনো আদর্শবাদ নয়—এটি প্রক্রিয়াগত বাস্তবতা।

অক্ষয় খান্না ছবির আবেগী ভারসাম্য রক্ষা করেন—সন্দেহ, কর্তৃত্ব আর সহমর্মিতার সূক্ষ্ম মিশেলে।

‘ধুরন্ধর’ সিনেমায় সারা অর্জুন। এক্স থেকে

সহিংসতা এখানে পরিণতি, প্রদর্শনী নয়

‘ধুরন্ধর’-এর সহিংসতা কাঁচা এবং অনেক সময় দেখার মতো নয়। কিন্তু এটি কখনোই গৌরবের বিষয় হয়ে ওঠে না। এটি লিয়ারির বাস্তব গ্যাং ইতিহাসের প্রতিফলন—যেখানে সহিংসতা ব্যতিক্রম নয়, দৈনন্দিন।

অ্যাকশনকে নৃত্যের মতো কোরিওগ্রাফ না করে, আদিত্য ধর দেখান রাখঢাক ছাড়াই; এই অস্বস্তি ইচ্ছাকৃত। এখানে সহিংসতা হাততালির জন্য নয়, বাস্তবতার পরিণতি।

আরও পড়ুন

অপেক্ষা বোঝে যে গুপ্তচর ছবি

সবচেয়ে সাহসী সিদ্ধান্ত সম্ভবত ছবিটির ধৈর্য। বাস্তব গোয়েন্দা কাজ মানে লাগাতার উত্তেজনা নয়; বরং দীর্ঘ অপেক্ষা, পর্যবেক্ষণ ও আনুগত্য—মাঝে মাঝে হঠাৎ আতঙ্ক।

এই ছন্দ ছবিটি মেনে নেয়। তাই দৈর্ঘ্য চ্যালেঞ্জিং হলেও সৎ। ‘ধুরন্ধর’ মিশনের চেয়ে বেশি দেখায়—মিশন মানুষের সঙ্গে কী করে।

‘ধুরন্ধর’ সিনেমার পোস্টার থেকে। আইএমডিবি

কেন ‘ধুরন্ধর’ গুরুত্বপূর্ণ? ‘ধুরন্ধর’ দেশপ্রেমের লেকচার বা বাড়তি চমক দিয়ে ঘরানা বদলায় না। এটি তা করে বাস্তবতা লঘু না করে।

এখানে পুরুষত্ব মানে বুক ঠুকে বীরত্ব নয়। মানে টিকে থাকার ক্ষমতা। সহিংসতা প্রদর্শনী নয়, পরিণতি।

ছবিটি নিখুঁত নয়—প্রেমের ট্র্যাক দুর্বল, দৈর্ঘ্য ধৈর্য চায়। কিন্তু এর দৃঢ়তা কখনো টলে না।

বলিউডের স্টাইলিশ গুপ্তচর কল্পনার ভিড়ে ‘ধুরন্ধর’ আলাদা হয়ে দাঁড়ায়, কারণ এটি দর্শককে স্বস্তি দেয় না বরং কঠিন বাস্তবতার মুখে ঠেলে দেয়।

ইন্ডিয়া টুডে ও হিন্দুস্তান টাইমস অবলম্বনে