যে ব্যথা, যে দ্বন্দ্ব লুকিয়ে রেখেছিলেন রবিশঙ্কর

রবিশঙ্কর (৭ এপ্রিল ১৯২০—১১ ডিসেম্বর ২০১২)

পণ্ডিত রবিশঙ্কর—সেতারের কিংবদন্তি শিল্পী, যাঁকে শ্রদ্ধাভরে ‘সেতারসম্রাট’ বলা হতো—ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতকে শুধু একটি ধারায় সীমাবদ্ধ রাখেননি। তিনি সে সংগীতকে সময়, ভূগোল আর সংস্কৃতির সীমারেখা পেরিয়ে পৌঁছে দিয়েছেন বিশ্বমঞ্চে। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সংগীতধারার সেতুবন্ধ ঘটিয়ে তিনি সৃষ্টি করেছিলেন এক নতুন সাংস্কৃতিক জাগরণ। অথচ এই মহিরুহ শিল্পীকেও তাঁর দীর্ঘ ও বর্ণিল শিল্পীজীবনে অন্তর্গত দ্বন্দ্ব, নীরব প্রতিযোগিতা ও সামাজিক বাস্তবতার মোকাবিলা করতে হয়েছে। আজ ১১ ডিসেম্বর—এই মহান সংগীতস্রষ্টার প্রয়াণদিবসে তাঁর সেই বিস্তৃত, জটিল ও মানবিক অধ্যায়গুলো নতুন করে ফিরে দেখা যাক।

নড়াইল থেকে বারানসি
রবিশঙ্করের পূর্ণ নাম রবীন্দ্রশঙ্কর চৌধুরী। তাঁর পৈতৃক নিবাস বাংলাদেশের নড়াইল জেলায় হলেও জীবনের শুরুটা হয় ভারতের উত্তর প্রদেশের বারানসিতে। কর্মসূত্রে তাঁর বাবা নড়াইল ছেড়ে বারানসিতে চলে যান। সেখানেই ১৯২০ সালের ৭ এপ্রিল জন্ম নেন রবিশঙ্কর। এই শহরের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক আবহ, গঙ্গার তীরঘেঁষা সংগীতচর্চা তাঁর মননে প্রাথমিকভাবে প্রভাব ফেলে।
রবিশঙ্করের বড় ভাই উদয়শঙ্কর ছিলেন উপমহাদেশের অন্যতম পথিকৃৎ নৃত্যশিল্পী। ভারতীয় নৃত্যকে আধুনিক মঞ্চে উপস্থাপন করে তিনি ইউরোপজুড়ে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেন। দাদার নৃত্যদলের সদস্য হিসেবেই শৈশবে ইউরোপ ভ্রমণের সুযোগ পান রবিশঙ্কর। সেই সময়েই তাঁর ভেতর জন্ম নেয় সংগীত, ছন্দ ও শিল্পবোধের গভীর আকাঙ্ক্ষা। নৃত্য, সরোদ ও সংগীতের সমন্বিত চর্চা তাঁর শিল্পীসত্তার ভিত্তিকে বহুমাত্রিক করে তোলে।

গুরু আলাউদ্দিন খাঁ প্রসঙ্গ
রবিশঙ্করের জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাঁক আসে প্যারিসে। উদয়শঙ্করের দলের সঙ্গে ইউরোপ সফরের সময় সেখানে তাঁর সঙ্গে পরিচয় ঘটে কিংবদন্তি সংগীতগুরু ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর। এ সাক্ষাৎই নির্ধারণ করে দেয় রবিশঙ্করের ভবিষ্যৎ। পরবর্তী সময়ে মধ্যপ্রদেশের মাইহার শহরে গিয়ে তিনি গ্রহণ করেন আলাউদ্দিন খাঁর কঠোর শিষ্যত্ব।

দিনের পর দিন নিরবচ্ছিন্ন রেওয়াজ, শারীরিক ক্লান্তি আর মানসিক পরীক্ষার মধ্য দিয়ে তিনি গড়ে ওঠেন একজন পরিপূর্ণ সেতারবাদক হিসেবে।
পণ্ডিত রবিশঙ্কর ছিলেন সেতারের কিংবদন্তি শিল্পী
ছবি: রাগ-অনুরাগ বই থেকে

মাইহারে কাটানো বছরগুলো ছিল রবিশঙ্করের জীবনের সবচেয়ে কঠিন অথচ সবচেয়ে সৃষ্টিশীল সময়। দিনের পর দিন নিরবচ্ছিন্ন রেওয়াজ, শারীরিক ক্লান্তি আর মানসিক পরীক্ষার মধ্য দিয়ে তিনি গড়ে ওঠেন একজন পরিপূর্ণ সেতারবাদক হিসেবে। এখানেই তিনি ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত হন আলাউদ্দিন খাঁর পুত্র ওস্তাদ আলী আকবর খাঁর সঙ্গে, যাঁর সরোদবাদন পরবর্তী সময়ে বিশ্বজুড়ে কিংবদন্তি হয়ে ওঠে।

বিশ্বসংগীতে রবিশঙ্করের উত্থান
১৯৫৪ সাল থেকে পণ্ডিত রবিশঙ্করের জীবনে শুরু হয় এক নতুন অধ্যায়—আন্তর্জাতিক সংগীতযাত্রা। এই সময় থেকেই তিনি নিয়মিতভাবে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, সোভিয়েত ইউনিয়নসহ বিশ্বের নানা দেশে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীত পরিবেশন করতে থাকেন। পাশ্চাত্যের শ্রোতাদের কাছে তখনো রাগ, তাল ও রাগিণীর জগৎ ছিল প্রায় অজানা। সেই অচেনা সংগীতভূমিকে তিনি ধীরে ধীরে সহজ ভাষায়, নতুন সংবেদনশীলতায় তুলে ধরেন। কেবল পরিবেশনা নয়, বক্তৃতা, আলোচনা ও কর্মশালার মাধ্যমে তিনি ব্যাখ্যা করেন ভারতীয় সংগীতের দর্শন, কাঠামো ও আধ্যাত্মিক ভিত্তি। ফলে রবিশঙ্কর হয়ে ওঠেন এক অর্থে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের দূত।
পাশ্চাত্য সংগীতজগতের সঙ্গেও রবিশঙ্কর গড়ে তোলেন সেতুবন্ধ। জ্যাজ সংগীতশিল্পী, পাশ্চাত্য ধ্রুপদি সুরকার ও জনপ্রিয় ব্যান্ডের সঙ্গে তাঁর যৌথ কাজ সংগীতের ভাষাকে এনে দেয় নতুন মাত্রা। ষাটের দশকে পাশ্চাত্যে যে ‘ওয়ার্ল্ড মিউজিক’ বা ভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগীতধারার প্রতি আগ্রহ তৈরি হয়, তার পেছনে রবিশঙ্করের ভূমিকা ছিল মৌলিক। জর্জ হ্যারিসনসহ দ্য বিটলস গোষ্ঠীর সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক সেতারকে পৌঁছে দেয় তরুণ পশ্চিমা শ্রোতাদের ঘরে ঘরে। সেতার তখন আর শুধু ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের বাদ্যযন্ত্র নয়, হয়ে ওঠে এক বৈশ্বিক প্রতীক।

পাশ্চাত্য সংগীতজগতের সঙ্গেও রবিশঙ্কর গড়ে তোলেন সেতুবন্ধ। জ্যাজ সংগীতশিল্পী, পাশ্চাত্য ধ্রুপদি সুরকার ও জনপ্রিয় ব্যান্ডের সঙ্গে তাঁর যৌথ কাজ সংগীতের ভাষাকে এনে দেয় নতুন মাত্রা।

ভারতীয় চলচ্চিত্রেও রবিশঙ্করের অবদান অনস্বীকার্য ও পথপ্রদর্শক। সত্যজিৎ রায়ের ‘পথের পাঁচালী’ ও ‘অপরাজিত’-এর সংগীত পরিচালনা করে তিনি চলচ্চিত্রের আবহসংগীতে এক নতুন সংযমী ভাষা তৈরি করেন, যেখানে অতিরঞ্জন নয়, বরং সংক্ষিপ্ত অথচ গভীর সুরে উঠে আসে চরিত্রের অনুভূতি ও সময়ের বেদনা। এ কাজ ভারতীয় চলচ্চিত্রসংগীতে এক দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলে।
রবিশঙ্করের বিশ্বমানবিক ভূমিকার উজ্জ্বলতম উদাহরণ ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ। যুদ্ধবিধ্বস্ত মানুষের পাশে দাঁড়াতে তিনি উদ্যোগ নেন নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে আয়োজিত ঐতিহাসিক ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’-এর। জর্জ হ্যারিসনসহ বিশ্বের নামী শিল্পীদের একত্র করে তিনি যে সাংগঠনিক ও সাংস্কৃতিক প্রচেষ্টা গড়ে তুলেছিলেন, তা সংগীতকে মানবিক প্রতিবাদের এক শক্তিশালী ভাষায় পরিণত করে। এই কনসার্ট শুধু ত্রাণ তহবিল সংগ্রহই নয়, বিশ্বজনমত গঠনের ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
এ সবকিছু মিলিয়ে রবিশঙ্করের আন্তর্জাতিক উত্থান কেবল ব্যক্তিগত খ্যাতির গল্প ছিল না; বরং তিনি ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতকে বিশ্বসংস্কৃতির মূল স্রোতে যুক্ত করেছিলেন—সম্মান, গভীরতা ও মানবিক দায়বদ্ধতার সঙ্গে।

সুরবাহার হাতে পণ্ডিত রবিশঙ্কর ও অন্নপূর্ণা দেবী
সংগৃহীত

রবিশঙ্কর-বিলায়েত খাঁ: প্রতিদ্বন্দ্বিতা, সখ্য ও নীরব দ্বন্দ্ব
পণ্ডিত রবিশঙ্করের সংগীতজীবনের সবচেয়ে সংবেদনশীল ও আবেগঘন অধ্যায়গুলোর একটি জড়িয়ে আছে ওস্তাদ বিলায়েত খাঁর সঙ্গে। বয়সে সাত বছরের ছোট হলেও বিলায়েত খাঁ তাঁকে গভীর শ্রদ্ধায় ‘দাদা’ বলে ডাকতেন। কিন্তু সে সময়ের সংগীতবোদ্ধা ও রসিকদের একটি বড় অংশ সেতারে বিলায়েত খাঁকে কিছুটা বেশি অগ্রসর মনে করতেন। এই তুলনামূলক দৃষ্টিভঙ্গিই ধীরে ধীরে রবিশঙ্করের মনে একধরনের অস্বস্তি ও আত্মসংঘাতের জন্ম দেয়, যা তিনি কখনো প্রকাশ্যে নয়, বরং নিজের ভেতরেই বহন করেছেন।

১৯৩৯ সালে এলাহাবাদের এক সংগীত সম্মেলনে তাঁদের প্রথম সাক্ষাৎ। তখন বিলায়েত খাঁর বয়স মাত্র ১২ বছর। সেই অনুষ্ঠানে রবিশঙ্কর বাজান সুরবাহার, আর আলী আকবর খাঁ বাজান সরোদ। আত্মজীবনী ‘রাগ-অনুরাগ’-এ রবিশঙ্কর স্মৃতিচারণা করে লেখেন, এত অল্প বয়সেই বিলায়েত খাঁ কঠোর তালিমের ফলে আশ্চর্য রকম পরিণত হয়ে উঠেছিল। বিশেষ করে তাঁর মা যেভাবে ছেলেকে নিষ্ঠার সঙ্গে রেওয়াজে বেঁধে রেখেছিলেন, সে কথা তৎকালীন অনেকের অজানা ছিল বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
পরবর্তী সময়ে দিল্লির কার্জন রোডে পাশাপাশি বাড়িতে থাকার সুবাদে দুজনের সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ হয়। ভোরবেলা সাইকেলে চড়ে বিলায়েত খাঁ এসে রবিশঙ্করের রেওয়াজ শুনতেন, কখনো একসঙ্গে সাধনার প্রস্তাব দিতেন। সেই সময়ের স্মৃতিগুলো রবিশঙ্করের লেখায় ভরে আছে আন্তরিকতা ও স্নেহে। তিনি বিলায়েত খাঁকে বর্ণনা করেছেন প্রাণচঞ্চল, উচ্ছল এবং অবিশ্বাস্য জীবনীশক্তিতে ভরপুর এক তরুণ শিল্পী হিসেবে, যাঁর প্রতিভার দীপ্তি তখনই আলাদা হয়ে উঠেছিল।
এই সখ্যপূর্ণ সম্পর্কের মধ্যেই ধীরে ধীরে জন্ম নিতে থাকে এক নীরব দ্বন্দ্ব—যেখানে রয়েছে গভীর শ্রদ্ধা, পারস্পরিক মুগ্ধতা, আবার একই সঙ্গে শ্রেষ্ঠত্বের প্রশ্নে অনিবার্য তুলনা। এই দ্বৈত অনুভূতিই রবিশঙ্কর-বিলায়েত খাঁ সম্পর্ককে করে তুলেছিল বিশেষ, মানবিক এবং ইতিহাসের জন্য গভীরভাবে তাৎপর্যপূর্ণ।

সংবাদপত্র, মান-অভিমান ও সংযম
এক যৌথ অনুষ্ঠানের পর সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়, বিলায়েত খাঁ নাকি রবিশঙ্করকে ‘হারিয়ে দিয়েছেন’। এই প্রতিবেদন তাঁকে গভীরভাবে আহত করে। ক্ষোভে একসময় তিনি প্রকাশ্য প্রতিদ্বন্দ্বিতার আহ্বান জানিয়ে ফেলেন। কিন্তু বিলায়েত খাঁ নিজেই তাঁকে শান্ত করেন, অনুরোধ করেন লোকের কথায় কান না দিতে এবং সংগীতকে লড়াইয়ের জায়গা না বানাতে।

রবিশঙ্করের প্রয়াণদিবসে বাবাকে স্মরণ করে কনসার্টে তোলা রবিশঙ্করের ছবিটি ফেসবুকে পোস্ট করেছেন সেতারবাদক অনুষ্কা শঙ্কর। ২০১২ সালের ৪ নভেম্বর লং বিচের টেরেস থিয়েটারে রবিশঙ্করের শেষ কনসার্টে মঞ্চে বাবার পাশে অনুষ্কাও ছিলেন। সে বছরের ১১ ডিসেম্বর প্রয়াত হয়েছেন রবিশঙ্কর
ছবি: অনুষ্কার ফেসবুক থেকে
এক যৌথ অনুষ্ঠানের পর সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়, বিলায়েত খাঁ নাকি রবিশঙ্করকে ‘হারিয়ে দিয়েছেন’। এই প্রতিবেদন তাঁকে গভীরভাবে আহত করে। ক্ষোভে একসময় তিনি প্রকাশ্য প্রতিদ্বন্দ্বিতার আহ্বান জানিয়ে ফেলেন। কিন্তু বিলায়েত খাঁ নিজেই তাঁকে শান্ত করেন, অনুরোধ করেন লোকের কথায় কান না দিতে এবং সংগীতকে লড়াইয়ের জায়গা না বানাতে।

প্রতিভার স্বীকৃতি
বিলায়েত খাঁর সংগীতজীবনের বিকাশ রবিশঙ্কর নিজ চোখেই দেখেছেন—বাবা ইনায়েত খাঁর মৃত্যু, মায়ের কঠোর অনুশাসন, দাদামশাই বন্দে হাসান খাঁ, ওস্তাদ আমির খাঁসহ নানা প্রভাব। সব মিলিয়ে বিলায়েত নিজেকে গড়ে তুলেছিলেন এক অনন্য শিল্পী হিসেবে। এই সত্য অকপটে স্বীকার করে রবিশঙ্কর লিখেছেন, বিলায়েত খাঁ তাঁর ‘গ্রেটেস্ট অ্যাডমায়ারার’-দের একজন।
তবু জনপ্রিয়তার চূড়ায় উঠে দুজনের মধ্যে তুলনা প্রায় অনিবার্য হয়ে ওঠে। কে সেরা সেতারবাদক—এ প্রশ্ন ছড়িয়ে পড়ে ভক্ত, শিষ্য ও সমালোচকদের মধ্যে। রবিশঙ্কর বারবার বলে দিয়েছেন, তাঁর সামনে বসে কেউ বিলায়েত খাঁর নিন্দা করলে তিনি খুশি হবেন না। কিন্তু মানুষের কৌতূহল ও পক্ষপাত থামেনি।
বোম্বে সম্মেলন ও বিতর্কের বিস্তার
১৯৪৩ সালে বোম্বেতে (বর্তমানে মুম্বাই) ভারতীয় ক্ল্যাসিক্যাল মিউজিকের এক বিশাল সম্মেলনে বিলায়েত খাঁ ও বড়ে গোলাম আলী খাঁর পরিবেশনা ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয়। শেষ মুহূর্তে জ্বরে আক্রান্ত হওয়ায় রবিশঙ্কর সেখানে বাজাতে পারেননি। এই অনুপস্থিতিকে কেন্দ্র করে তাঁদের দুজনকে তুলনামূলকভাবে দেখা শুরু হয়। আত্মজীবনীতে রবিশঙ্কর লিখেছেন, তাঁর ও বিলায়েত খাঁর মধ্যে ফ্রিকশন তৈরি করার অপচেষ্টা বহু আগে থেকেই চলছিল।


বিলায়েত খাঁর শিল্পভাষা: একজন মহাশিল্পীর চোখে আরেকজন
রবিশঙ্কর বিলায়েত খাঁর বাজনার যে বিশ্লেষণ করেছেন, তা এক শিল্পীর পক্ষেই সম্ভব। তাঁর মতে, বিলায়েত খাঁর বাজনায় ছিল একধরনের রোমান্টিক লিরিসিজম, বয়ান্সি ও ভিগারের অনন্য সমন্বয়। স্বচ্ছ তান, নিখুঁত মিড়, গায়কি অঙ্গ ও জ্বালাময় ঝালা—সব মিলিয়ে তিনি ছিলেন এক অসাধারণ সংগীতব্যক্তিত্ব।

পণ্ডিত রবিশঙ্কর ও জর্জ হ্যারিসন
ছবি : সংগৃহীত

‘রব্বন খাঁ’ হয়ে ওঠার ভাবনা
আত্মজীবনী ‘রাগ-অনুরাগ’-এ পণ্ডিত রবিশঙ্করের সবচেয়ে সংবেদনশীল ও সাহসী স্বীকারোক্তিগুলোর একটি উঠে এসেছে ধর্ম ও পরিচয়ের প্রশ্নে। তিনি অকপটে লিখেছেন, ১৯৪০-৪১ সালে হিন্দুস্তানি শাস্ত্রীয় সংগীতের জগতে মুসলমান শিল্পীদের প্রাধান্য ছিল প্রায় একচেটিয়া। দীর্ঘদিন ধরে সংগীতচর্চার ঐতিহ্য, ঘরানা ও উত্তরাধিকার মূলত তাঁদের হাতেই গড়ে ওঠায় একটি ধারণা সমাজে গেঁথে গিয়েছিল—একজন শিল্পীর নামের সঙ্গে ‘খাঁ’ না থাকলে তাঁর গায়কি বা বাজনায় সেই জৌলুশ, গভীরতা কিংবা গ্রহণযোগ্যতা আসে না।
এ ধারণা শুধু শ্রোতা বা সমালোচকদের মধ্যেই নয়, অনেক ক্ষেত্রেই সংগীতের ভেতরের পরিসরেও প্রভাব ফেলেছিল। রবিশঙ্কর লিখেছেন, এ মানসিকতা এমন এক অদৃশ্য দেয়াল তৈরি করেছিল, যার মধ্য দিয়ে হিন্দু শিল্পীদের পক্ষে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো সহজ ছিল না। অসাধারণ মেধা, কঠোর সাধনা ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি থাকা সত্ত্বেও তাঁকেও বারবার এই পরিচয়গত দেয়ালের মুখোমুখি হতে হয়েছে।
এই অবমূল্যায়ন ও অবজ্ঞার অভিজ্ঞতা রবিশঙ্করকে ভেতরে–ভেতরে আহত করেছিল। একসময় সেই রাগ, ক্ষোভ ও হতাশার জায়গা থেকেই তিনি ভাবতে শুরু করেন, যদি নামের শেষে ‘খাঁ’ থাকলে গ্রহণযোগ্যতা বাড়ে, তবে তিনিও কি নিজের নাম বদলে ফেলবেন? সে ভাবনাতেই তাঁর মনে এসেছিল ‘রব্বন খাঁ’ নামটি। যদিও শেষ পর্যন্ত তিনি সে পথে যাননি, তবু এ ভাবনা তাঁর মানসিক অবস্থার গভীরতা ও তৎকালীন সামাজিক বাস্তবতার কঠিন চাপকে স্পষ্ট করে।
এই স্বীকারোক্তি শুধু রবিশঙ্করের ব্যক্তিগত যন্ত্রণার কথা বলে না, বরং সে সময়ের হিন্দুস্তানি সংগীতজগতের ধর্মগত ও পরিচয়ভিত্তিক টানাপোড়েনও তুলে ধরে। একই সঙ্গে এটি রবিশঙ্করের আত্মমর্যাদা ও শিল্পীসত্তার শক্তির সাক্ষ্য—যিনি শেষ পর্যন্ত নাম নয়, নিজের সংগীত, সাধনা ও সৃজনশীলতার মাধ্যমেই সব পরিচয়কে অতিক্রম করে গেছেন।

সেতারসাধক পণ্ডিত রবিশঙ্কর। ছবি: সংগৃহীত

উত্তরাধিকার ও মানবিকতা
এসব অকপট স্বীকারোক্তিই পণ্ডিত রবিশঙ্করকে আমাদের কাছে আরও গভীরভাবে মানবিক করে তোলে। অসামান্য প্রতিভা, বৈশ্বিক খ্যাতি ও শ্রেষ্ঠত্বের স্বীকৃতি পেয়েও তিনি প্রতিযোগিতার বাস্তবতা অস্বীকার করেননি। বরং প্রতিদ্বন্দ্বিতা, অবমূল্যায়ন, ঈর্ষা ও ব্যক্তিগত আঘাতের ভেতর দিয়েই তিনি নিজের শিল্পীসত্তাকে পরিশীলিত করেছেন। তর্কের মধ্যেও সৌন্দর্য দেখতে পারা, বিরোধের মধ্যেও শ্রদ্ধা ধরে রাখা এবং অন্য শিল্পীর মহত্ত্ব স্বীকার করার মানসিক দৃঢ়তাই তাঁকে আলাদা উচ্চতায় পৌঁছে দেয়।
রবিশঙ্করের শিল্পীজীবন দেখিয়ে দেয়, সংগীত কেবল কারিগরি দক্ষতা বা জনপ্রিয়তার বিষয় নয়, এটি এক গভীর মানবিক সাধনা। প্রতিদ্বন্দ্বীর বাজনায় লিরিসিজম খুঁজে পাওয়া, ভিন্নপথের শিল্পীর শক্তিকে স্বীকৃতি দেওয়া এবং নিজের যন্ত্রণাকেও শিল্পের অংশ করে নেওয়ার ক্ষমতাই তাঁর প্রকৃত উত্তরাধিকার। তিনি আমাদের শিখিয়েছেন, শিল্পে ‘কে সেরা’—এ প্রশ্নের চেয়ে বড় হলো, শিল্পকে কতটা সত্য, কতটা নিষ্ঠা ও কতটা মানবিকতা দিয়ে ধারণ করা যায়।
প্রয়াণদিবসে পণ্ডিত রবিশঙ্করের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা—একজন সেতারসম্রাট হিসেবে নয় শুধু, একজন সংবেদনশীল মানুষ ও মহান শিল্পী হিসেবে, যিনি নিজের জীবন ও স্বীকারোক্তির মধ্য দিয়ে আমাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, সংগীতে যেমন প্রতিযোগিতা থাকে, তেমনি তার ঊর্ধ্বে রয়েছে সৌন্দর্য, সত্য আর মানবিকতার এক বিস্তৃত, বহমান সুর।