অমিতাভের সঙ্গে বৃষ্টিভেজা সেই গান,অস্বস্তিতে পড়েছিলেন স্মিতা

স্মিতা পাতিলের জন্মদিন ১৭ অক্টোবর। কোলাজ

স্মিতা পাতিল বলিউডে কখনোই সহজ পথে হাঁটেননি। অর্থবহ চরিত্রের প্রতি দায়বদ্ধতা আর বাণিজ্যিক ছবির চাপে ভারসাম্য খুঁজতে গিয়ে বহুবারই তিনি নিজেকে দ্বিধায় আবিষ্কার করেছেন। ‘নমক হালালের’ মতো ছবিতে অস্বস্তিকর দৃশ্য কিংবা যশ চোপড়ার হঠাৎ সিদ্ধান্তে বাদ পড়ার কষ্ট—সবই তিনি অকপটে শেয়ার করেছিলেন। গতকাল ১৭ অক্টোবর ছিল স্মিতা পাতিলের জন্মদিন। এ উপলক্ষে জেনে নেওয়া যাক অভিনেত্রী সম্পর্কে কিছু তথ্য।

বাণিজ্যিক সিনেমায় প্রথম ধাক্কা
১৯৫৫ সালের ১৭ অক্টোবর ভারতের পুনেতে জন্ম স্মিতার। বাবা শিবাজিরাও গিরধর পাতিল রাজনীতিবিদ। মা বিদ্যাতাই পাতিল ছিলেন সমাজসেবী। দুজনের ব্যক্তিত্বের প্রভাব পড়েছিল স্মিতার বেড়ে ওঠায় ও মানসিকতায়। পুনে ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন ইনস্টিটিউটের প্রাক্তনী স্মিতা সাতের দশকে ক্যারিয়ার শুরু করেন মুম্বাই দূরদর্শনের সংবাদপাঠিকা হিসেবে। স্মিতা ছিলেন শ্যাম বেনেগালের আবিষ্কার। নায়িকা হতে হলেই গায়ের রং হবে ফর্সা—এমন ধারণাকে ভেঙে দিয়েছিলেন স্মিতা। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি বরাবর সরব হয়েছেন নারীদের সমস্যা ও অধিকার নিয়ে। তাঁর ব্যক্তিত্বের প্রভাব পূর্ণমাত্রায় পড়ত অভিনয়েও। তাঁর অভিনীত ছবিগুলো ছিল প্রথাগত নায়কপ্রধান ছবির বিপরীত মেরুর। মারাঠি ও হিন্দি ছবিতে নিজের সময়ে স্মিতা ছিলেন বলিষ্ঠ অভিনেত্রী।

বাণিজ্যিক সিনেমায় নারীর শরীরকেই প্রলোভনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়। তাই আমি চাই, আমরা নিজেদের এমনভাবে উপস্থাপন করি, যাতে মানুষ চরিত্রটাকে দেখে, শরীরকে নয়।
স্মিতা পাতিল

তাঁর প্রথম ছবি ‘মেরে সাথ চল’ মুক্তি পায় ১৯৭৪ সালে। এর পরের বছর শ্যাম বেনেগালের পরিচালনায় ‘নিশান্ত’। এরপর ‘চরণদাস চোর’, ‘মন্থন’, ‘ভূমিকা’ স্মিতার অভিনয় এবং শ্যাম বেনেগালের পরিচালনার যুগলবন্দিতে নতুন অধ্যায় বলিউডে। সেই অধ্যায় দীর্ঘ হয় অন্যান্য যশস্বী পরিচালকের নির্দেশনায়। স্মিতার নামের পাশে একে একে যোগ হয় ‘আক্রোশ’, ‘চক্র’, ‘সদগতি’, ‘অর্থ’, ‘দেবশিশু’, ‘চিদম্বরম’, ‘গুলামি’, ‘বাজার’, ‘আকালের সন্ধানে’, ‘মান্ডি’, ‘অর্ধসত্য’, ‘মির্চ মাশালার’ মতো মাইলফলক ছবি।

শৈল্পিকধারা বা বিকল্পধারার ছবির পাশাপাশি বাণিজ্যিক ছবিতেও স্মিতা ছিলেন সমান সাবলীল। ইন্ডিয়া টুডেকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে স্মিতা বলেছিলেন, ‘আমি ভাবতাম, একটি বাণিজ্যিক ছবি করলে মজা হবে। কিন্তু হিন্দি ছবিতে একটাতেই থামা যায় না। আমি ভাবছি, শাবানা (আজমি) পারবে কি না ওই বৃত্ত থেকে বের হতে—আমার মনে হয়, সে এখন অনেক ভেতরে ঢুকে গেছে।’ ক্যারিয়ারের শুরুতেই তিনি বুঝেছিলেন, নিজের পথ বেছে নিতে হবে। তাঁর স্পষ্ট মন্তব্য, ‘আমি ভালো ছবিতেই কাজ করতে চাই। কিন্তু ভালো পরিচালক পাওয়া কঠিন, তাঁরা প্রায়ই নতুন মুখকে প্রাধান্য দেন। আমি চাই না যে বাণিজ্যিক ছবির চাপে নিজেকে হারিয়ে ফেলি। কারণ, সেটাই হবে স্মিতা পাতিলের শেষ।’

রাজ-স্মিতার একমাত্র সন্তান প্রতীকের জন্ম হয় ১৯৮৬ সালের ২৮ নভেম্বর। সন্তান জন্মের পর থেকেই শারীরিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েন স্মিতা। ১৩ ডিসেম্বর জ্বর আসে, এতটাই যে শিশুকে কোলে নেওয়ার শক্তিও ছিল না তাঁর। সন্ধ্যার পর হঠাৎ খিঁচুনি ওঠে, শুরু হয় রক্তবমি। দ্রুত হাসপাতালে নেওয়া হলে তিনি কোমায় চলে যান। মাত্র দুই সপ্তাহ বয়সী সন্তানকে রেখে ১৯৮৬ সালের ১৩ ডিসেম্বর মাত্র ৩১ বছর বয়সে পৃথিবী ছেড়ে যান স্মিতা পাতিল।

যশ চোপড়ার প্রত্যাখ্যানের কষ্ট
একবার শাহরুখ খানের সঙ্গে কথোপকথনে যশ চোপড়া জানান, তিনি নিজে না জানিয়ে এক প্রকল্প থেকে স্মিতাকে বাদ দিয়েছিলেন—শুটিং শুরুর একদিন আগে। পরিবর্তে খবরটি পৌঁছে দিতে পাঠিয়েছিলেন শশী কাপুরকে।

‘নিশান্ত’ সিনেমায় গিরিশ কারনাড ও স্মিতা পাতিল। আইএমডিবি

পরে মুখোমুখি হলে স্মিতা বলেন, ‘যশজি, আপনি যা করেছেন, নিশ্চয়ই ভেবেচিন্তেই করেছেন। কিন্তু একটা জায়গায় ভুল হয়েছে। আপনি নিজে জানালে আমি কষ্ট পেতাম না, কিন্তু শশী এসে বলেছে, সেটাই আমাকে আঘাত দিয়েছে।’ যশ চোপড়া লজ্জিত স্বরে স্বীকার করেছিলেন, ‘তুমি ঠিক বলেছো। আমি জানতাম, এটা ভুল ছিল, কিন্তু আমি লজ্জা পেয়েছিলাম।’

‘নমক হালাল’–এর অস্বস্তিকর দৃশ্য
অমিতাভ বচ্চনের সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতাও স্মিতার জন্য সহজ ছিল না। ‘নমক হালালে’ তিনি ছিলেন নায়কের প্রেমিকা—একেবারে তথাকথিত ‘নায়িকা’র চরিত্রে। ছবির বিখ্যাত বৃষ্টির গানের দৃশ্য ‘আজ রাপাত যায়ে তো’ করতে গিয়ে তিনি ভীষণ অস্বস্তি বোধ করেছিলেন। বছর কয়েক পর অমিতাভ নিজেই ব্লগে লেখেন, ‘স্মিতা পুরো ছবির শুটিংয়েই অস্বস্তিতে ছিল। কারণ, তাকে যা করতে বলা হচ্ছিল, সে তা বুঝে উঠতে পারছিল না।’

‘মন্থন’ সিনেমায় স্মিতা পাতিল। আইএমডিবি

২০১৫ সালে স্মিতা পাতিলকে নিয়ে একটি বই প্রকাশ অনুষ্ঠানে অমিতাভ স্মৃতিচারণা করে বলেন, ‘ও বলেছিল, এই গানটা তার সংস্কৃতি ও চিন্তার বাইরে। একেবারেই তার স্বভাববিরুদ্ধ। একবার এয়ারপোর্টে কেউ ওকে “নমক হালালের” জন্য চিনে ফেললে সে নাকি লজ্জা পেত। অথচ ও এত ভালো ভালো ছবিতে কাজ করেছিল।’

‘নমক হালাল’–এর গানের দৃশ্যে অমিতাভ ও স্মিতা পাতিল। আইএমডিবি

নিজের অবস্থানে অনড় স্মিতা
অভিনয়ের মতো ব্যক্তিজীবনেও স্মিতা ছিলেন স্পষ্টবাদী। লুকিয়ে রাখেননি বিবাহিত রাজ বব্বরের সঙ্গে সম্পর্ক। এই সম্পর্কের জন্য প্রতিভাময়ী অভিনেত্রী হয়ে উঠেছিলেন ইন্ডাস্ট্রির মুখরোচক আলোচনা। তাঁর বোন মান্য পাতিল পরে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, নিজের পরিসরে স্মিতা ছিলেন নিঃসঙ্গ। রাজ বব্বরের সঙ্গে সম্পর্ক অস্বীকার করতে পারেননি। আবার রাজ-নাদিরার সংসার ভাঙার জন্য অপরাধবোধেও কষ্ট পেতেন। চলচ্চিত্রজগতেও তাঁর এমন ব্যক্তিত্বের ছাপ দেখা যায়।

মান্য পাতিল এক সাক্ষাৎকারে জানান, ‘একবার একটা দৃশ্যে ওকে বলতে হতো, “ম্যায় তোমহারে বাচ্চে কি মা বাননে ওয়ালি হুঁ।” তখন ও চেঁচিয়ে বলেছিল, “আমি এই বাজে ক্লিশে সংলাপ বলব না!” অনেক আলোচনার পর অবশেষে সংলাপটা বদলে দেওয়া হয়—“ম্যায় মা বাননে ওয়ালি হুঁ।” এত বড় পরিচালক বা সহ–অভিনেতার সামনে থেকেও ও নিজের অবস্থান ছাড়েনি।’
অভিনয়ের পাশাপাশি স্মিতার শখ ছিল ফটোগ্রাফি। ভালবাসতেন গাড়ি চালাতে, ভলিবল খেলতে।

নারীর চরিত্র নিয়ে স্পষ্ট মত
দূরদর্শনে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে স্মিতা বলেছিলেন, ‘মূলধারার ছবিতে নারী চরিত্রগুলো সব এক রকম—তাঁরা হয় দুর্বল, বশ্য বা কষ্টভোগী; না হলে খল চরিত্র। আমি ভাগ্যবতী যে এমন নারীর চরিত্রে কাজ করেছি, যেখানে তাঁদের আসল সত্তা দেখানো হয়েছে।’

মাত্র এক দশকের কর্মজীবনেই ভারতীয় সিনেমায় তিনি রেখেছেন অমলিন ছাপ। খুব অল্প বয়সেই জীবন থেমে গেলেও তাঁর অভিনয়, অবস্থান আর আত্মসম্মানের দৃষ্টান্ত আজও অনন্য। সমান্তরাল ধারার সিনেমার নীরব বিপ্লবী এই অভিনেত্রী দেখিয়ে গেছেন—একজন নারীর ‘না’ বলার সাহসই হতে পারে তাঁর সবচেয়ে শক্তিশালী সংলাপ।

তিনি নিজের ‘ভূমিকা’ও ‘মন্থনের’ মতো ছবির উদাহরণ টেনে বলেন, ‘ওই নারীরা কেবল ভুক্তভোগী নন, তাঁদের ভেতরের শক্তিও দেখানো হয়েছে। এটাই তো আসল নারীচিত্র।’
স্মিতা আরও যোগ করেন, ‘বাণিজ্যিক সিনেমায় নারীর শরীরকেই প্রলোভনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়। তাই আমি চাই, আমরা নিজেদের এমনভাবে উপস্থাপন করি, যাতে মানুষ চরিত্রটাকে দেখে, শরীরকে নয়।’

সিনেমার দৃশ্যে স্মিতা পাতিল। আইএমডিবি

নির্মাতা শ্যাম বেনেগাল এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘স্মিতা ছিলেন বহুমাত্রিক এক নারী, অভিনয় করতেন খুব সাবলীলভাবে। খুব সহজেই যেকোনো চরিত্রের অংশ হয়ে যেতে পারতেন। যেমন ‘মন্থনে’ কত সহজে বিন্দুর চরিত্রে নিজেকে বসিয়ে দিয়েছিলেন। মন্থনের শুটিংয়ের সময় কুঁড়েঘরে থেকে ঘুঁটে দেওয়া, গরুর দুধ দোয়ানো, বালতিতে জল তোলা… সবকিছুই শিখেছিলেন। ক্যামেরার সঙ্গে স্মিতার রসায়ন ছিল অনবদ্য। ক্যামেরা যেন সবার মাঝখানে তাঁকে খুঁজে নিতে পারত। এটাই ছিল স্মিতার প্লাসপয়েন্ট।’

স্মিতার শেষ দিনগুলো
রাজ-স্মিতার একমাত্র সন্তান প্রতীকের জন্ম হয় ১৯৮৬ সালের ২৮ নভেম্বর। সন্তান জন্মের পর থেকেই শারীরিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েন স্মিতা। ১৩ ডিসেম্বর জ্বর আসে, এতটাই যে শিশুকে কোলে নেওয়ার শক্তিও ছিল না তাঁর। সন্ধ্যার পর হঠাৎ খিঁচুনি ওঠে, শুরু হয় রক্তবমি। দ্রুত হাসপাতালে নেওয়া হলে তিনি কোমায় চলে যান। মাত্র দুই সপ্তাহ বয়সী সন্তানকে রেখে ১৯৮৬ সালের ১৩ ডিসেম্বর মাত্র ৩১ বছর বয়সে পৃথিবী ছেড়ে যান স্মিতা পাতিল।

মাত্র এক দশকের কর্মজীবনেই ভারতীয় সিনেমায় তিনি রেখেছেন অমলিন ছাপ। খুব অল্প বয়সেই জীবন থেমে গেলেও তাঁর অভিনয়, অবস্থান আর আত্মসম্মানের দৃষ্টান্ত আজও অনন্য। সমান্তরাল ধারার সিনেমার নীরব বিপ্লবী এই অভিনেত্রী দেখিয়ে গেছেন—একজন নারীর ‘না’ বলার সাহসই হতে পারে তাঁর সবচেয়ে শক্তিশালী সংলাপ।