ছবি প্রতি শতকোটি টাকা আয়, উড়ে এসে জুড়ে বসেননি রাজামৌলি

এস এস রাজামৌলি। ছবি: আইএমডিবি

ছিলেন সিনেমা সম্পাদকের শিক্ষানবিশ সহকারী সম্পাদক। ছয় মাস কাজ করেছেন সেখানে। তখনো ভবিষ্যৎ নিয়ে তাঁর আলাদা ভাবনা ছিল না। বাবার চাপাচাপিতে বাধ্য হয়ে শুরু করেন ক্যারিয়ার গড়ার কাজ। তারপর যেন ইতিহাস বদলে গেল। ভারতে এখন সর্বাধিক আয় করা সিনেমার তালিকায় পরিচালক হিসেবে তাঁর নাম থাকে। তাঁর ক্যারিয়ারে কোনো ফ্লপ সিনেমা নেই। কীভাবে সিনেমা নির্মাণে এলেন, সেটাও নাটকীয়! বললে অত্ত্যুক্তি হবে না, উড়ে এসে জুড়ে বসেননি এস এস রাজামৌলি। একের পর এক ভারতীয় বক্স অফিসের বাজিমাত করা এই পরিচালক সম্পর্কে কতটা জানেন?

সিনেমা বানাবেন সে ইচ্ছা ছিল না। কিন্তু শৈশব থেকেই গল্প পড়তে ভালোবাসতেন। মাত্র সাত বছর বয়সে তাঁর দাদি তাঁকে রামায়ণ, মহাভারতের সঙ্গে পরিচিত করেন। একই সময়ে তাঁর বাবা তাঁকে কমিক বই ‘অমর চিত্রকথা’ সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। এ ছাড়া ভারতের ইতিহাসের বই, ধর্মীয় পণ্ডিতদের জীবনী, ভারতের লোকগল্পসহ নানা বই শৈশবেই পড়েছেন। বইগুলো তাঁর মধ্যে অনেক পরিবর্তন ঘটিয়েছে। একসময় শ্রেণিকক্ষের পাঠ তাঁর ভালো লাগে না। নেশা হয়ে যায় গল্প–উপন্যাস পড়া।
পড়াশোনা, ইংরেজি সিনেমা দেখার পাশাপাশি প্রচুর কমিক পড়েন। একসময় পড়াশোনার প্রতি মনোযোগ কমে যাওয়া দেখে চিন্তিত ছিলেন তাঁর মা–বাবা। বাবা বিভিন্ন সাক্ষাৎকার ছেলেকে নিয়ে বলেন, ‘সে মোটেও উচ্চাকাঙ্ক্ষী ছেলে নয়। দীর্ঘ সময় পর্যন্তও আমরা জানতাম না সে আসলে কী হতে চায়, কোনো বিষয়ে তার আগ্রহ।’ এটা রাজামৌলিও স্বীকার করেছেন। তখন তাঁর জীবনযাপন ছিল ভবঘুরের মতো।

রাজামৌলির বয়স তখন ১১ বছর। সেই সময়ও তাঁদের পূর্বপুরুষদের অনেক সম্পদ বেহাত হয়ে যায়। তখন তাঁর বাবা বিজয়েন্দ্র প্রসাদ ও কাকা শিভা শঙ্খি দত্ত সিনেমা নির্মাণ নিয়ে আগ্রহী হন। তাঁরা সম্পত্তি বিক্রি করে মাদ্রাজ (বর্তমানে চেন্নাই) চলে আসেন। মাদ্রাজে এসে চেয়েছিলেন সম্পত্তি বিক্রি করা টাকা দিয়ে সিনেমা বানিয়ে লাভের মুখ দেখবেন। বেশ কিছু সিনেমার কাজ শেষ করেন। কিন্তু দুঃখের বিষয়, তাঁরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন। একসময় যে রাজামৌলিদের পূর্বপুরুষদের জমিদারি ছিল, তাঁরাই এবার মাদ্রাজে কঠিন সংকটে পড়েন। যৌথ পরিবারে বেড়ে ওঠা রাজামৌলিদের ১৩ জন সদস্যের পরিবারকে থাকতে হতো দুই রুমের একটি বাসায়। তখন রাজামৌলির কষ্টের দিনগুলো খুব কাছ থেকে দেখা।

শুটিংয়ের ফাঁকে এস এস রাজামৌলি। ছবি: আইএমডিবি

এমন পরিস্থিতিতে রাজামৌলি কোনো কিছু নিয়ে কাজ না করায় তাঁর ওপর চড়াও হন তাঁর বাবা। সেই সময় নিয়মিত বাবার কাছে গালি খেতে হতো রাজামৌলিকে। কারণ, তাঁর ভবিষ্যৎ নিয়ে কোনো পরিকল্পনাই ছিল না, এমনকি জীবনের লক্ষ্যও ছিল না। বাবা চাইতেন আপাতত একটা লক্ষ্য ঠিক করুক। সেসব স্মৃতি স্মরণ করে রাজামৌলি ভারতীয় গণমাধ্যমে বলেন, ‘আমি ফিল্মে যোগ দিয়েছিলাম শুধু বাবার বকা থেকে বাঁচতে। এডিটিং দিয়ে এই যাত্রা শুরু হয়। পরে একটা সময় সিনেমার মধ্যে থাকতে গিয়ে সিনেমার প্রেমে পড়ে গেলাম। এভিএম রেকর্ডিং থিয়েটার চেন্নাইতে চলে এলাম। এখানে এসে করানার্থ কুমারের সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ শুরু করি। পরে ছয় বছর বাবার সিনেমার কাজ করি।’

এদিকে তাঁর বাবা সিনেমা পরিচালনায় ক্ষতির মুখে পড়ে পরে সিনেমা লেখালেখি ও সিনেমা নির্মাণ করতে থাকেন। সুনাম বাড়তে থাকে। খুব আগ্রহ নিয়ে রাজামৌলি সিনেমার চিত্রনাট্য লেখা শুরু করেন। কিন্তু তাঁর গল্পগুলো নিয়ে অন্য পরিচালকেরা সব সময় নিরাশ হতেন। দেখা যেত প্রতিবার এক্সিকিউশনে গিয়ে বাদ পড়ত। এ ঘটনা বেশ কয়েকবার ঘটে। পরে তিনি হতাশা থেকে উৎসাহিত হন লেখালেখি থেকে সিনেমা নির্মাণে। এবার উদ্দেশ্য নির্মাতা হওয়ার।

এস এস রাজামৌলি। ছবি: আইএমডিবি

রাজামৌলি এবার চলে আসেন চেন্নাই থেকে হায়দরাবাদ। তাঁর এক আত্মীয় গুনাম গঙ্গারাজুর সঙ্গে সিনেমা নির্মাণের খুঁটিনাটি নিয়ে কাজ করতে থাকেন। সে সময় বেশ কিছু সামাজিক বার্তানির্ভর বিজ্ঞাপন নির্মাণের টিমে ছিলেন। পরে হাত পাকান কিছু বিজ্ঞাপন বানিয়ে। পরে তিনি দেড় বছর নির্মাতা হিসেবে তেলেগু ইন্ডাস্ট্রির টেলিভিশনে ধারাবাহিক নাটক নির্মাণ করেন। শান্তি নিবাসমসহ বেশ কিছু নাটকের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তখন তাঁকে নিয়মিত ১৭ ঘণ্টা করে পরিশ্রম করতে হতো। তবে ছদ্মনামে তিনি বেশ কিছু কাজের সঙ্গে থেকেছেন। কিন্তু সিনেমা বানানোর স্বপ্ন থেকে কখনোই দমে যাননি। হায়দরাবাদে এসে প্রভাবশালী পরিচালক ও প্রযোজক কে রাঘবেন্দ্র রাওয়ের সঙ্গে কাজ শুরু করেন। তিনিই প্রথম রাজামৌলিকে সিনেমা বানানোর প্রস্তাব দেন। তখন তিনি অন্যান্য কাজ কমিয়ে দেন।

বিরতি দিয়ে গল্প নিয়ে ভাবতে থাকেন। কারণ, নাটকে কাজ করতে গিয়ে দীর্ঘদিন তিনি গল্প ভাবতে পারেননি। দর্শকদের আগ্রহের কথা বিবেচনা করে তরুণদের নিয়ে গল্প ভাবেন। ২০০১ সালে শুরু করেন ‘স্টুডেন্ট নাম্বার ওয়ান’ সিনেমার শুটিং। শিক্ষার্থীদের প্রেমের গল্প। সিনেমায় প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেন জুনিয়র এনটিআর। সেই থেকেই রাজামৌলি ও এনটিআর জুটি। দুজনেরই অভিষেক সিনেমা ছিল ‘স্টুডেন্ট নাম্বার ওয়ান’। এনটিআর আগে একটি সিনেমা করলেও সেটি পরে মুক্তি পায়। যাই হোক ‘স্টুডেন্ট নাম্বার ওয়ান’ মুক্তির পর সিনেমাটি প্রশংসা পায় ও ব্যবসায়িক সফলতা অর্জন করে। এই সফলতা তাঁকে আগ্রহী করে তোলে। পরে ২০০৩ সালে শুরু করেন দ্বিতীয় সিনেমার কাজ। সিনেমার নাম ‘সিংহদ্রি’। সিনেমার সঙ্গে যুক্ত হন তাঁরা বাবা।

শুটিংয়ের ফাঁকে এস এস রাজামৌলি। ছবি: আইএমডিবি

এই সিনেমাটিও ব্লকবাস্টার হয়। সেই সময়ই তেলেগু ইন্ডাস্ট্রির সর্বোচ্চ আয় করা সিনেমার তালিকায় জায়গা করে নেয়। সেই ধারা ২০ বছর ধরে অব্যাহত রেখেছেন এই পরিচালক। তবে শুধু তেলেগু নয়, ভারতে এখন তিনি আলোচিত পরিচালক।
ভারতের এযাবৎকালের সর্বোচ্চ আয় করা সিনেমার তালিকায় ২ নম্বরে জায়গা পেয়েছে রাজামৌলির ‘বাহুবলী–২: দ্য কনক্লুসন’ সিনেমাটি। এর আয় ১ হাজার ৭৪২ কোটি রুপি। এ ছাড়া ‘আরআরআর’ গত বছর সাড়া জাগিয়েছিল। সিনেমাটিও আয়ে রেকর্ড গড়ে। সর্বাধিক আয় করা ভারতীয় সিনেমার তালিকায় ৩ নম্বরে রয়েছে সিনেমাটি। আয় ১ হাজার ২৫০ কোটি রুপি। তার সিনেমা মানেই বক্স অফিসে হিট। পারিশ্রমিকে তারকাদের চেয়ে তিনিও কম নন। ভারতে সবচেয়ে বেশি পারিশ্রমিক তিনিই পান। সিনেমাপ্রতি তাঁর পারিশ্রমিক ৭৫ থেকে ১০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে রয়েছে প্রতিটি সিনেমা থেকে লভ্যাংশ।

সিনেমা নিয়ে প্রথম দিকে ব্যর্থতা আর কষ্টের জীবনযাপনই কি তাঁকে সফলতার শিক্ষা দিয়েছে? সেটা কখনোই তিনি গণমাধ্যমে বলেননি। কিন্তু সিনেমা মানেই তাঁর কাছে সমর্থক শব্দ সফল। ভারতীয় দর্শকদের রুচি বুঝে সিনেমা বানানোতে তাঁর চেয়ে এগিয়ে দ্বিতীয় কেউ নেই। এর মূল কারণ গল্প ও উপস্থাপনা।

এস এস রাজামৌলি। ছবি: আইএমডিবি

তাঁর ছবিতে নানা পৌরাণিক কাহিনি, পুনর্জন্ম বারবার উঠে আসে। প্রসঙ্গে তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘তরুণ বয়সেই আমি অনেক কিছু কল্পনা করতাম। বাবার সিনেমার কোনো দৃশ্য নিয়ে কল্পনা করতাম। আমি অবিশ্বাস্য অবস্থাকে দর্শককে বিশ্বাস করানোর চেষ্টা করি। আমার ছবিতে বারবার নানা পৌরাণিক কাহিনির ছাপ পাওয়া যায়। কারণ, ছোটবেলা থেকেই আমি “রামায়ণ”, “মহাভারত” পড়ে বড় হয়েছি। সিনেমা নির্মাণের ক্ষেত্রে কাহিনিগুলো আমাকে বারবার অনুপ্রাণিত করেছে। পুরাণের প্রভাব আমার ছবিকে ভিন্নমাত্রা দেয়। এ জন্য আমি গর্ব করি।’ এ কারণে হয়তো তিনি বক্স অফিসের হিসেবে নিয়মিত আলোচনায় জায়গা করে নেন।

সূত্র: আল–জাজিরা, ইন্ডিয়া টুডে, টাইমস অব ইন্ডিয়া, এনডিটিভি