পরেশ রাওয়ালকে নিয়ে যত বিতর্ক
পদ্মশ্রী, ফিল্মফেয়ার পুরস্কার পেছনে পড়ে গেছে; আপাতত তাঁর নামের সঙ্গে জুড়ে গেছে ‘বিতর্ক’ শব্দটি। সর্বশেষ ‘হেরা ফেরি ৩’ সিনেমা নিয়ে যে বিতর্ক হয়েছে, তাতে নতুন করে আবার আলোচনায় পর্দার ‘বাবু রাও’। ক্যারিয়ারে অভিনয় করেছেন দুই শতাধিক ছবিতে। ভক্তদের ভালোবাসাও পেয়েছেন। তিনি ভারতীয় অভিনেতা, প্রযোজক ও রাজনীতিবিদ পরেশ রাওয়াল। ১৯৫৫ সালের ৩০ মে জন্ম নেন এই অভিনেতা। আজ তাঁর ৭০তম জন্মদিন। এ উপলক্ষে জেনে নেওয়া যাক তাঁর সম্পর্কে জানা-অজানা কিছু তথ্য।
সিনেমার সংখ্যা ২৪০
জন্ম ও বেড়ে ওঠা ভারতের মুম্বাইয়ে হলেও পরেশ রাওয়াল মূলত গুজরাটি। তাঁর অভিনয়দক্ষতার পেছনে রয়েছে থিয়েটারের ভূমিকা। হিন্দি সিনেমার মাধ্যমে তিনি জনপ্রিয়তা অর্জন করলেও গুজরাটি থিয়েটারে তিনি এখনো অত্যন্ত সফল একজন অভিনেতা হিসেবে পরিচিত। পরেশ রাওয়াল হিন্দি, তামিল, তেলেগু ও গুজরাটি ভাষার ২৪০টির বেশি ছবিতে অভিনয় করেছেন। তাঁর তুমুল জনপ্রিয়তা পাওয়া সিনেমাগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘হেরা ফেরি’, ‘ফির হেরা ফেরি’, ‘হাঙ্গামা’, ‘ভুলভুলাইয়া’, ‘ওহ মাই গড’, ‘ওয়েলকাম’, ‘গরম মাসালা’, ‘নাম’ ইত্যাদি। অভিনয়ের পাশাপাশি তিনি পরিচালনা ও প্রযোজনাও করেছেন।
কমেডি থেকে খল চরিত্র
কমেডিয়ান হিসেবে তিনি যেমন জনপ্রিয়, তেমনি খল অভিনেতা হিসেবে আলোচিত। ২০০০ সালে ‘হেরা ফেরি’ সিনেমায় দুর্দান্ত কমেডি অভিনয় করে ফিল্মফেয়ার সেরা অভিনেতার পুরস্কার জিতে নেন। অন্যদিকে ‘নাম’, ‘স্যার’, ‘আক্রোশ’, ‘টেবিল নাম্বার ২১’ সিনেমায় তাঁর খল চরিত্রের কথা নিশ্চয় এখনো অনেক দর্শকের মনে আছে!
প্রেমিকা দিতেন হাতখরচের টাকা
এই অভিনেতা চাকরিজীবন শুরু করেন ব্যাংক কর্মকর্তা হিসেবে। ইচ্ছা ছিল চাকরি আর অভিনয় একসঙ্গে চালিয়ে যাওয়ার। কিন্তু চাকরি ভালো না লাগায় সেটা ছেড়ে দেন। এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়েছিলেন, সে সময় বাসা থেকেও তেমন একটা হাতখরচ পেতেন না। চাকরি ছাড়ার পর প্রেমিকা তাঁকে হাতখরচ জোগাতেন। পরে তিনি ১৯৮৭ সালে তাঁর দীর্ঘদিনের প্রেমিকা স্বরূপ সম্পতকেই বিয়ে করেন। স্বরূপ সম্পত ১৯৭৯ সালে ভারতের সুন্দরী প্রতিযোগিতা মিস ইন্ডিয়া ইউনিভার্সে বিজয়ী হন।
‘দুঃখিত, সকাল সাতটার পরও ঘুমাচ্ছিলাম’
২০২১ সালে কোভিডে আক্রান্ত হন এই অভিনেতা। তিনি সেরে ওঠার পর হঠাৎ ছড়িয়ে পড়ে তাঁর মৃত্যুর গুজব। টুইটারে হঠাৎ ভাইরাল হয় একটি সংবাদ। সেখানে লেখা ছিল, ‘অভিনেতা পরেশ রাওয়াল মারা গেছেন। শনিবার সকাল সাতটা নাগাদ শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেছেন তিনি।’ টুইটারের ওই পোস্ট ছড়িয়ে পড়ার কিছুক্ষণ পর অভিনেতা নিজেই একটি পোস্ট দেন। নিজের মৃত্যুর খবরের পোস্টটির স্ক্রিনশট তুলে তিনি লেখেন, ‘ভুল–বোঝাবুঝির জন্য দুঃখিত, সকাল সাতটার পরও ঘুমাচ্ছিলাম।’ পরেশের এ পোস্ট নিয়ে তারপরই শুরু হয়ে যায় হইচই। কেন তাঁকে অন্যতম সেরা কমেডিয়ান বলা হয়, এমন সরেস উত্তর যেন সেটার মোক্ষম প্রমাণ।
নিজের মূত্র পান করে সেরে ওঠা
পরেশ রাওয়াল নিজের মূত্র পান করার অভিজ্ঞতার কথা ২০২৩ সালে এক সাক্ষাৎকারে প্রকাশ্যে আনেন। তিনি বলেন, কয়েক বছর আগে তিনি হাড়ের গুরুতর সমস্যায় ভুগছিলেন। হাসপাতালে থাকার সময় বিকল্প চিকিৎসার অংশ হিসেবে নিজের মূত্র পান করেন এবং এ পদ্ধতিতে তিনি দ্রুত সেরে ওঠেন।
পরেশ বলেন, বীরু দেবগনের পরামর্শে তিনি ১৫ দিন নিজের মূত্র পান করেছেন। টানা ১৫ দিন ইউরিন থেরাপিতে তাঁর উন্নতি দেখে অবাক হন চিকিৎসকেরা। এক্স–রেতে দেখা যায়, যে হাঁটুর চোট ঠিক হতে দুই থেকে আড়াই মাস লাগার কথা, তা পুরোপুরি ঠিক হয়ে যায় দেড় মাসের মাথায়। পরেশ রাওয়ালের ভাষায়, ‘এ যেন ছিল ম্যাজিক!’ তবে তাঁর এ বক্তব্য নিয়ে অনেক বিশেষজ্ঞের ভিন্নমত রয়েছে।
অরুন্ধতী রায়–বিতর্ক
২০১৭ সালে অরুন্ধতী রায়কে নিয়ে বিতর্কিত এক টুইট করে ব্যাপকভাবে সমালোচিত হন পরেশ। সে সময় কাশ্মীরে ভারতীয় সেনাবাহিনীর একটি গাড়িতে একজন নাগরিককে মানবঢাল হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে—এমন একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়। এ ঘটনা নিয়ে দেশজুড়ে বিতর্ক শুরু হয়। এ সময় পরেশ রাওয়াল একটি বিতর্কিত টুইট করেন, ‘সেনাবাহিনীর জিপে পাথর ছোড়ার বদলে অরুন্ধতী রায়কে বেঁধে দেওয়া উচিত ছিল!’ তাঁর এ অসৌজন্যমূলক ও দায়িত্বজ্ঞানহীন টুইটের ব্যাপক সমালোচনা হয়। বিতর্কের মুখে এ টুইট সরিয়ে ফেলতে বাধ্য হন তিনি।
‘গ্যাস সিলিন্ডার নিয়ে কী করবেন? বাঙালিদের জন্য মাছ ভাজবেন?’
২০২২ সালের ডিসেম্বরে গুজরাটের বিধানসভা নির্বাচনের ঠিক আগে দুটি বিস্ফোরক মন্তব্য করেন পরেশ রাওয়াল। বিজেপির হয়ে প্রচারে নেমে বাংলাদেশি ও বাঙালিদের নিয়ে কটূক্তি করেন। এক সমাবেশে তিনি বলেন, গুজরাটের জনগণ মূল্যস্ফীতি সহ্য করতে পারে কিন্তু পাশের ঘরে ‘বাংলাদেশি বা রোহিঙ্গাদের’ সহ্য করতে পারবে না। তাঁর ওই মন্তব্য তুমুল সমালোচনার জন্ম দেয়। তবে এখানেই শেষ নয়। ওই সমাবেশে পরেশ আরও বলেন, ‘মুদ্রাস্ফীতি সহ্য করতে পারবেন গুজরাটের মানুষ। কিন্তু পাশের বাড়িতে যদি রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু কিংবা বাংলাদেশিরা এসে ওঠেন, তখন গ্যাস সিলিন্ডার নিয়ে কী করবেন? বাঙালিদের জন্য মাছ ভাজবেন?’
পরেশের ভাষণ গণমাধ্যমে আসামাত্র সমালোচনার ঝড় ওঠে। কারও মতে, এটা ‘ঘৃণাভাষণ’। কেউ বলেন, বাংলাদেশি ও রোহিঙ্গাদের নিয়ে পরেশ আতঙ্ক ছড়াচ্ছেন। কেউ কেউ পরেশের নিন্দা করে তাঁর কাছে জানতে চান, তিনি অহেতুক কেন মাছের প্রসঙ্গ টানলেন? সমালোচনার বাণে জর্জরিত হয়ে পরেশ টুইট করে তাঁর ভাষণের ব্যাখ্যা দেন। ক্ষমা চাইতে বাধ্য হন।
রাহুল গান্ধী বনাম গাধা
পরেশ রাওয়াল ২০১৪ সালে বিজেপির টিকিটে গুজরাট থেকে রাজ্যসভায় নির্বাচিত হন। ২০১৪ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত তিনি সংসদ সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এ সময় ভারতের প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেস ও গান্ধী পরিবারকে নিয়ে কটাক্ষ করতে থাকেন তিনি। বছরের শুরুতে এক্স হ্যান্ডলে রাহুল গান্ধীকে নিয়ে তাঁর বিতর্কিত মন্তব্য আবার আলোচনার জন্ম দিয়েছে। একটি সম্পাদনা করা ছবি এক ব্যক্তি তাঁর এক্সে পোস্ট করেন। যেখানে দেখা যায়, রাহুল গান্ধী একটি গাধার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে আছেন। এ ছবির ক্যাপশনে লেখা ছিল, ‘কেউ কি এই ছবি থেকে গাধাটিকে সরিয়ে দিতে পারবেন?’ পরেশ রাওয়াল এ ছবি শেয়ার করে লেখেন, ‘তাহলে পুরো ফ্রেমটাই ফাঁকা করতে হবে!’ তাঁর এ মন্তব্যে এ ইঙ্গিত স্পষ্ট—ছবিতে দুটি গাধা রয়েছে।
নেটিজেনদের কেউ মজা পেয়ে হেসেছেন, আবার কেউ সমালোচনা করে বলেছেন, পরেশের উচিত আরও সচেতন হয়ে মন্তব্য করা।
সিনেমা ছেড়েছেন অনেক
‘মুন্না ভাই এমবিবিএস’ সিনেমায় একটি চরিত্র করার প্রস্তাব এসেছিল পরেশের কাছে। কিন্তু প্রযোজক বিধু বিনোদ চোপড়া তাঁকে যে পারিশ্রমিকের প্রস্তাব দেন, এটি পরেশের কাছে ঔদ্ধত্যপূর্ণ মনে হয়। এর ফলে তিনি ১৫ লাখ রুপি পারিশ্রমিকের জায়গায় ৫০ লাখ রুপি পারিশ্রমিক দাবি করেন। পরে তিনি সিনেমাটি ছেড়ে দেন।
আরও যত ছেড়ে আসা চরিত্র
মাধুরী দীক্ষিতের ‘সংগীত’ নামে একটি চলচ্চিত্রে পরিচালকের সঙ্গে জটিলতার কারণে পরেশ এ সিনেমায় অভিনয় করা ছেড়ে দেন। ‘ওহ মাই গড’ সিনেমাটি বিপুল জনপ্রিয়তা পাওয়ার পরও এর সিকুয়েল ‘ওহ মাই গড ২’ না করার সিদ্ধান্ত নেন। কেউ কেউ বলেন, গল্প পছন্দ হয়নি তাঁর। কেউ বলেন, তিনি অনেক পারিশ্রমিক চেয়েছিলেন।
‘হেরা ফেরি ৩’–বিতর্ক
একজন রাজু, আরেকজন বাবু রাও। পর্দায় তাঁদের কাণ্ডকীর্তি দেখে হাসেননি, এমন দর্শক খুঁজে পাওয়া মুশকিল। আপনি যদি জনপ্রিয় ধারার হিন্দি সিনেমার দর্শক হয়ে থাকেন, তাহলে ‘হেরা ফেরি’ ফ্র্যাঞ্চাইজি নিয়ে যে কথা হচ্ছে, সেটা এতক্ষণে বুঝে যাওয়ার কথা। তাহলে এটাও জানার কথা, ২০০০ সালে ‘হেরা ফেরি’, ২০০৬ সালে ‘ফির হেরা ফেরি’র পর ‘হেরা ফেরি ৩’ নিয়ে আসার পরিকল্পনা চলছিল। এর মধ্যেই হঠাৎ ছবিটি থেকে বেরিয়ে গেছেন বাবু রাও চরিত্রের অভিনেতা পরেশ রাওয়াল, যা নিয়ে শুরু হয়েছে তুলকালাম। এরপর তাঁর বিরুদ্ধে ২৫ কোটি রুপির ক্ষতিপূরণের মামলার কথা জানায় অক্ষয়ের কুমারের প্রযোজনা সংস্থা।
দিন কয়েক আগে জানা যায়, পরেশ সুদসহ টাকা ফেরত দিয়ে বিবাদ মিটিয়ে নিয়েছেন। পরে এক্সে পরেশ লিখেছেন, ‘সিনেমা থেকে বেরিয়ে আসা নিয়ে আমার আইনজীবী অমিত নায়েক একটি উপযুক্ত জবাব পাঠিয়েছেন। তারা সেটি পড়লেই সব বিতর্কের অবসান হবে।’ অমিত নায়েক এর আগে অমিতাভ বচ্চন ও অনিল কাপুরের হয়ে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ মামলায় আইনি লড়াই করেছেন। এ ঘটনায় অবেশেষে কথা বলেছেন অক্ষয় কুমারও। দিন দুই আগে মুম্বাইয়ে ‘হাউসফুল ৫’ সিনেমার ট্রেলার প্রকাশ অনুষ্ঠানে পরেশ রাওয়ালকে নিয়ে প্রশ্ন করা হলে অক্ষয় সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমার সহ-অভিনেতাকে “ফুলিশ” বলা মোটেও ঠিক নয়। আমরা ৩২ বছর ধরে একসঙ্গে কাজ করছি। আমি ওনাকে শ্রদ্ধা করি। আমাদের মধ্যে যা ঘটেছে, তা নিয়ে এখানে কিছু বলা ঠিক হবে না। বিষয়টি আদালতের দেখভালের মধ্যে আছে।’ তবে যা পরিস্থিতি, এ বিতর্ক শিগগিরই থামবে না মনে হয়।
তথ্যসূত্র: ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, হিন্দুস্তান টাইমস, বলিউড হাঙ্গামা, পিংকভিলা