কৃষিকাজে ফিরে যাবেন ‘সেক্রেড গেমস’-এর গুরুজি

পূজা–পার্বণের সময় পাড়াগাঁয়ের থিয়েটারে মেয়ে সাজতেন পঙ্কজ। সেটাই ছিল তাঁর শৈশবের বড় আনন্দ। ভারতের বিহার রাজ্যের সেই যাত্রা তাঁকে একদিন বলিউডে পৌঁছে দেবে, কে জানত? পঙ্কজ এখন জাঁদরেল অভিনেতা। বলিউড বড় পর্দার ছবি বা ওয়েবে—পঙ্কজের অভিনয় সবার চোখে লেগে থাকে, আলাদা করে।

বলিউড বড় পর্দার ছবি বা ওয়েবে পঙ্কজ ত্রিপাঠির অভিনয় সবার চোখে লেগে থাকেসংগৃহীত

কদিন ধরে ভালো ঘুম হচ্ছে না পঙ্কজ ত্রিপাঠির। রাতভর হোটেলে কাজ করার পর দিনে যেটুকু সময় পান, সেটা ঘুমের জন্য যথেষ্ট নয়। সর্বসাকল্যে পাঁচ ঘণ্টা। শরীর যা–ই বলুক, মন শক্ত পঙ্কজের। চোখে লেগে আছে থিয়েটারশিল্পী প্রণিতা জসওয়ালের মুখ। যাঁর অভিনয় দেখে পঙ্কজের চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ে ফোঁটা ফোঁটা জল। মনে হয়, ইশ্ অমন অভিনয় যদি করতে পারতাম! তাই কম ঘুমেও দুঃখ নেই। বিকেলটা তিনি রেখে দেন থিয়েটারের জন্য। অভিনয় তাঁকে শিখতেই হবে।

পঙ্কজ ত্রিপাঠি
সংগৃহীত

পূজা–পার্বণের সময় পাড়াগাঁয়ের থিয়েটারে মেয়ে সাজতেন পঙ্কজ। সেটাই ছিল তাঁর শৈশবের বড় আনন্দ। ভারতের বিহার রাজ্যের সেই যাত্রা তাঁকে একদিন বলিউডে পৌঁছে দেবে, কে জানত? পঙ্কজ এখন জাঁদরেল অভিনেতা। বলিউড বড় পর্দার ছবি বা ওয়েবে—পঙ্কজের অভিনয় সবার চোখে লেগে থাকে, আলাদা করে। ২০১৭ সালের কথা। ভারত থেকে অস্কারে গেল সিনেমা ‘নিউটন’। এই ছবিতে পঙ্কজ ত্রিপাঠির অভিনয় চোখ ধাঁধিয়ে দিয়েছিল বলিউডের বড় বড় চলচ্চিত্র সমালোচকদের। জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার জিতে নিলেন এই অভিনেতা। এমন পুরস্কার ও প্রশংসা ঝুলিতে ভরেছেন আরও।

বিহারের এক হতদরিদ্র কৃষক পরিবারের ছোট ছেলে পঙ্কজ। বলিউডের ঝলমলে দুনিয়ায় জায়গা করে নিতে কম কাঠখড় পোড়াতে হয়নি তাঁকে। তাই একবার চোখ বুলিয়ে নিতে হবে তাঁর শৈশবের দিনগুলোতে, বিহারের গোপালগঞ্জ জেলার বেলসান্দ গ্রামে। ১৯৭৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর বানারস ত্রিপাঠি আর হেমন্তি দেবীর ঘরে এল তাঁদের সবচেয়ে ছোট সন্তান। নাম রাখা হলো পঙ্কজ। কৃষক বাবার সঙ্গে ফসলের খেতে যাওয়াই ছিল পঙ্কজের নিয়তি। তবে স্থানীয় স্কুলে কোনোরকমে পড়ালেখাও শিখতেন তিনি। পূজা–পার্বণে পাড়ায় পাড়ায় যখন থিয়েটার হতো, তখন মেয়েদের চরিত্রে অভিনয় করার জন্য তেমন কাউকে পাওয়া যেত না। সেই সংকট পূরণ করত কিশোর পঙ্কজ।

পাড়াগাঁয়ের থিয়েটারে মেয়ে সাজতেন পঙ্কজ ত্রিপাঠি
ত্র্রিপাঠির ফেসবুক থেকে

মাধ্যমিকের পর ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়লেন পঙ্কজ। বিহারের পাটনায় গিয়ে শহুরে থিয়েটার দেখে তিনি ‘থ’। অভিনয় করে এমন মুগ্ধ করে ফেলা যায় মানুষকে! অবাক ত্রিপাঠি। তাঁকে পেয়ে বসল থিয়েটারের নেশা। উচ্চমাধ্যমিকের ছাত্র ত্রিপাঠি যেন খাওয়াদাওয়া ভুলে থিয়েটার দেখতে শুরু করলেন। পাটনার কোথাও থিয়েটার প্রদর্শনী হলে সেখানে পাওয়া যেত তাঁকে। একবার ‘আন্ধা কৌন’ নামে এক নাটকে পারফর্ম করলেন প্রণিতা জসওয়াল। তাঁর অভিনয় দেখে কেঁদেই ফেললেন ত্রিপাঠি। সেদিন থেকে অভিনয় হয়ে গেল পঙ্কজ ত্রিপাঠির ধ্যানজ্ঞান।

কিছুদিন যেতেই থিয়েটার পাড়ার অনেকের সঙ্গেই পরিচয় হয়ে যায় ত্রিপাঠির। কিন্তু দরিদ্র পরিবারের ছেলে, পাটনায় থিয়েটার করার সামর্থ্য ছিল না। পঙ্কজ খুঁজতে থাকেন বিকল্প উপায়। কী করে থাকা–খাওয়ার পয়সা জোগাড় করা যায়, থিয়েটারও করা যায়। পথ পেয়ে গিয়েছিলেন তিনি। তবে তা ছিল কঠিন ও শঙ্কায় ভরা।

থাকা–খাওয়ার পয়সা জোটাতে রেস্তোরাঁয় কাজ নিলেন পঙ্কজ ত্রিপাঠি। রাতে কাজ করতেন, সকালে পৌঁছে যেতেন থিয়েটারে কাজ করতে। দুপুরে ঘরে ফিরে ঘুমাতেন। ঘুমের জন্য সর্বসাকল্যে বরাদ্দ ছিল পাঁচ ঘণ্টা। বিকেলে আবার থিয়েটারে। সন্ধ্যায় ফিরতেন হোটেলে। এভাবে এক কঠোর রুটিন মেনে জীবন ও থিয়েটারকে পাশাপাশি চালিয়ে গেছেন পঙ্কজ ত্রিপাঠি।

থাকা–খাওয়ার পয়সা জোটাতে রেস্তোরাঁয় কাজ নিলেন পঙ্কজ ত্রিপাঠি। রাতে কাজ করতেন, সকালে পৌঁছে যেতেন থিয়েটারে কাজ করতে। দুপুরে ঘরে ফিরে ঘুমাতেন। ঘুমের জন্য সর্বসাকল্যে বরাদ্দ ছিল পাঁচ ঘণ্টা। বিকেলে আবার থিয়েটারে। সন্ধ্যায় ফিরতেন হোটেলে। এভাবে এক কঠোর রুটিন মেনে জীবন ও থিয়েটারকে পাশাপাশি চালিয়ে গেছেন পঙ্কজ ত্রিপাঠি।
নানা চরিত্রে নিজেকে তুলে ধরেছেন বলিউড সিনেমায়।
সংগৃহীত

এমন করে চলল দুই বছর। কিন্তু অভিনয়ে ঠিক মন ভরছিল না তাঁর। এমন কোথাও যাওয়া দরকার, যেখানে অভিনয়টা ঠিকঠাক শিখে আসা যাবে। খোঁজ পেলেন ভারতের বিখ্যাত নাট্যপীঠ ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামার। কিন্তু সেখানে ভর্তি হতে অন্তত স্নাতক হতে হবে। এবার মাথায় হাত ত্রিপাঠির! উচ্চমাধ্যমিকেই পড়ালেখার পাট চুকিয়ে, নিয়েছিলেন হোটেল ম্যানেজমেন্টের প্রশিক্ষণ। এখন উপায়? অভিনয়ের কি এখনেই কবর হয়ে যাবে?

ভেঙে পড়েননি পঙ্কজ ত্রিপাঠি। দিল্লিতে চলে আসেন। শুরু হয় নতুন যুদ্ধ, স্নাতক হওয়ার। হিন্দি সাহিত্যে স্নাতকে ভর্তি হলেন। এ প্রসঙ্গে ত্রিপাঠি বলেন, ‘ভাবলাম, আমাকে অভিনয়ে থাকতে হলে স্নাতক হতে হবে। কিন্তু আমি উচ্চমাধ্যমিক পেরিয়ে পড়ালেখা বন্ধ করে দিই। হোটেল ম্যানেজমেন্টে প্রশিক্ষণ নিই। তাই আবার কলেজে ভর্তি হলাম, হিন্দি সাহিত্যে। আর রেস্তোরাঁয় রাতের কাজও চলতে থাকল, সঙ্গে থিয়েটারে অভিনয়।’

বাবা মায়ের সঙ্গে পঙ্কজ ত্রিপাঠি
ত্রিপাঠির ফেসবুক পেজ থেকে

২০০৪ সাল। এনএসডি থেকে অভিনয়ের পাট শেষ করলেন পঙ্কজ ত্রিপাঠি। নিজেকে বেশ আত্মবিশ্বাসী লাগছিল তখন। কারণ তাঁরই সিনিয়র সহপাঠী ছিলেন নওয়াজুদ্দিন সিদ্দিকী। চোখভরা স্বপ্ন নিয়ে পঙ্কজ পাড়ি জমালেন অভিনেতাদের স্বপ্নের শহর মুম্বাইতে। পকেটে তখন ৪৬ হাজার রুপি। কিন্তু মুম্বাই যে চোরাবালির শহর। হাজার হাজার স্বপ্নালু মানুষের ভিড় সেখানে। কজনই বা পঙ্কজ বা নওয়াজুদ্দিন হয়ে ওঠেন? পঙ্কজ ত্রিপাঠির শুরুটাও ছিল সে রকম। মুম্বাইয়ে পাটনার সেই ছেলেটি খুব একটা সুবিধা করে উঠতে পারেননি। দুই মাসেই সব টাকা শেষ করে ফেলেন পঙ্কজ। ৪৬ হাজার রুপি নিয়ে মুম্বাইতে এসেছিলেন ১৬ অক্টোবর, ২৫ ডিসেম্বর তাঁর হাতে ছিল মাত্র ১০ রুপি। তখনকার স্মৃতি হাতড়ে তিনি বলেন, ‘আমি এই তারিখটি স্মৃতিপটে রেখে দিয়েছি। কারণ সেদিন ছিল আমার স্ত্রীর জন্মদিন। তার জন্য একটা কেক কেনার টাকাও ছিল না আমার কাছে। আমার মতো যারা স্বপ্ন নিয়ে এই শহরে আসে, জীবনে ঘটে যাওয়া গুরুত্বপূর্ণ তারিখগুলো তারা মনে রাখে।’

সঙ্কটে স্ত্রী মৃদুলা ছিলেন পঙ্কজ ত্রিপাঠির পাশে
সংগৃহীত
আমি এই তারিখটি স্মৃতিপটে রেখে দিয়েছি। কারণ সেদিন ছিল আমার স্ত্রীর জন্মদিন। তার জন্য একটা কেক কেনার টাকাও ছিল না আমার কাছে। আমার মতো যারা স্বপ্ন নিয়ে এই শহরে আসে, জীবনে ঘটে যাওয়া গুরুত্বপূর্ণ তারিখগুলো তারা মনে রাখে।
পঙ্কজ ত্রিপাঠি, অভিনেতা

দমে যাননি পঙ্কজ। এক স্টুডিও থেকে ঢুঁ মারেন আরেক স্টুডিওতে। ছোটখাটো দু–একটা চরিত্র পেয়েও যান। তাঁর পুরোটা পথে ছায়া হয়ে পাশে ছিলেন স্ত্রী মৃদুলা। মুম্বাইয়ের পুরোটা সময় পঙ্কজের পরিবারকে দেখে রেখেছিলেন তিনি। একদিন আচমকাই পঙ্কজের কাছে ধরা দিল স্বপ্নের সোনার হরিণ। পরিচালক অনুরাগ কাশ্যপের বলিউড কাঁপানো চলচ্চিত্র ‘গ্যাংস অব ওয়াসিপুর’–এ নাম লেখালেন পঙ্কজ ত্রিপাঠি। ছবিতে সহশিল্পী হিসেবে পেলেন এনএসডির বড় ভাই নওয়াজুদ্দিন সিদ্দিকীকে। এই ছবি বলিউডকে উপহার দিল অভিনয়ের দুই রত্নকে। এভাবেই শুরু হলো বলিউডের ঝলমলে দুনিয়ায় পঙ্কজ ত্রিপাঠির স্বপ্নীল যাত্রা। প্রথম ১০টি বছর ছিল নিরেট টিকে থাকার। সেই লড়াই তিনি চালিয়ে গেছেন দাঁতে দাঁত চেপে। যদিও এর আগেই কয়েকটি ভালো সিনেমায় ছোট চরিত্র ছিল তাঁর। সেগুলো হলো ‘রান’, ‘অপহরণ’, ‘সূর্য’, ‘চিল্লার পার্টি’ ও ‘ওমকারা’।

থিয়েটার ছিল পঙ্কজ ত্রিপাঠির অভিনয় শেখার পাঠশালা
সংগৃহীত

তারকাখ্যাতির জন্য ছুটছেন না পঙ্কজ। অভিনয় ভালো লাগত। তবে পরিবার চালাতেই অভিনয়ে টিকে থাকতে হয়েছে তাঁকে। নিজে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘আমি এখানে তারকা হতে আসিনি। এটা আমার কাছে পরিষ্কার যে আমি অভিনয় দিয়ে সংসার চালাতে চেয়েছি। আমি জানি, হিন্দি সিনেমায় আমি অভিনয় দিয়েই টিকে থাকতে পারব।’

নানা চরিত্রে অভিনয় করে দর্শকের মনে জায়গা করেছেন পঙ্কজ ত্রিপাঠি
সংগৃহীত

শুধু টিকেই থাকেননি, সংসারই চালাননি পঙ্কজ ত্রিপাঠি, তারকাখ্যাতিও পেয়েছেন। বলিউডে শক্তিশালী অভিনেতার তালিকা করলে পঙ্কজ ত্রিপাঠিকে রাখতে হবে প্রথম পাঁচে। ‘গ্যাংস অব ওয়াসিপুর’–এর সুলতান কোরেশি ‘মাসান’, ‘নিল বাট্টে সান্নাটা’, ‘নিউটন’, ‘গুরুগাঁও’, ‘বারিলি কি বরফি’, ‘স্ত্রী’, ‘লুকা ছুপি’, ‘সুপার থার্টি’সহ অসংখ্য সিনেমায় এসেছেন নানাভাবে, নানারূপে।

বিনোদন দুনিয়ার নতুন কনটেন্ট, ওয়েব সিরিজেও নাম লিখিয়েছেন তিনি। পেয়েছেন প্রশংসাও। ‘সেক্রেড গেমস’–এর গুরুজি, ‘মির্জাপুর’–এর মাদক মাফিয়াকে কে না চেনে? তবে শুধু অভিনয়ই নয়, নানা গুণে সমৃদ্ধ এই অভিনেতা। তিনি নাচতেও জানেন। এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, যেকোনো তাল সহজেই আত্মস্থ করে ফেলতে পারেন তিনি। এটাও জানিয়ে রাখা যাক, ‘উড়তা পাঞ্জাব’ ছবিতে আলিয়া ভাটকে বিহারি ভাষার আঞ্চলিক চলন শিখিয়েছিলেন তিনি। শুধু তা–ই নয়, হিন্দি সাহিত্যে পড়ার সুবাদে হিন্দি ভাষাটাও বেশ ভালোভাবে রপ্ত করেছিলেন তিনি। শুটিং সেটে মাঝেমধ্যে নতুন অভিনেতাদের হিন্দি ভাষার শিক্ষক বনে যান পঙ্কজ।

‘গুঞ্জন সাক্সেনা: দ্য কারগিল গার্ল’ ছবিতে জাহ্নবী কাপুরের বাবার চরিত্রে পঙ্কজ ত্রিপাঠি
সংগৃহীত
উড়তা পাঞ্জাব’ ছবিতে আলিয়া ভাটকে বিহারি ভাষার আঞ্চলিক চলন শিখিয়েছিলেন তিনি। শুধু তা–ই নয়, হিন্দি সাহিত্যে পড়ার সুবাদে হিন্দি ভাষাটাও বেশ ভালোভাবে রপ্ত করেছিলেন তিনি। শুটিং সেটে মাঝেমধ্যে নতুন অভিনেতাদের হিন্দি ভাষার শিক্ষক বনে যান পঙ্কজ।
স্ত্রী মৃদুলা ও মেয়ে আশির সঙ্গে পঙ্কজ ত্রিপাঠি
সংগৃহীত

২০০৪ সালে বিয়ে করেন ত্রিপাঠি। তাঁর স্ত্রী মৃদুলা শিক্ষকতা করেন। তাঁদের ১৩ বছরের মেয়ের নাম আশি। এখন অভিনয়ে তাঁর পরিপূর্ণ মনোযোগ। তবে জীবনের অপরাহ্নে পাড়ি জমাবেন বিহারের গোপালগঞ্জের সেই বেলসান্দ গ্রামে। যেখানে জন্মের পর বাবার হাত ধরে তিনি মাঠে কাজ করতে গিয়েছিলেন। সেখানে একটি খামারবাড়ি করবেন। মৃত্যুর আগে কৃষক হয়েই কাটাবেন জীবনের শেষ দিনগুলো।