ক্ষুধার্ত আর কৌতূহলী এক শিল্পীমন, বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত

‘তাঁর শুধু ভালো লাগত আলমারি খুলতে। যখনই কোনো কাজ থাকত না, কিংবা কিছুতেই আসত না ঘুম, আলমারি খুলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা তাকিয়ে থাকত আলমারির ভেতরে। দশ জোড়া শার্ট–প্যান্ট তাঁকে লক্ষ্য করত। এমনকি দুটো পাল্লাও তাঁকে লক্ষ্য করত। শেষে আস্তে আস্তে আলমারি তাঁকে ভালোবাসতে শিখল। একদিন অবশেষে যখন সে খুলল পাল্লা ভেতর থেকে এসে শার্টের লম্বা হাত জড়িয়ে ধরল তাঁকে। টেনে নিল ভেতরের দিকে। বন্ধ হয়ে গেল পাল্লা। এবং নানা রঙের জামারা তাঁকে শেখাল, কী করে মাসের পর মাস, বছরের পর বছর, এক জন্ম থেকে আরেক জন্ম, ঝুলে থাকা যায় শুধুমাত্র একটা হ্যাঙ্গার ধরে...’

আজ সকালে বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের জন্মদিনে তাঁর গলায় তাঁর কবিতাটা শুনছিলাম ইউটিউবে। শুনতে শুনতেই মনে হলো, এই আলমারি কেবল একটা সাধারণ, যেনতেন আলমারি নয়। এই আলমারি হলো একটা জাদুর বাক্স। সেই জাদুর বাক্সের ভেতর বন্দী হয়ে আছে একটা জগৎ। সেই জগৎ সিনেমার, সেই জগৎ কবিতার, সেই জগৎ পেইন্টিংয়ের। একজন বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত শারীরিকভাবে বিশ্বের যে প্রান্তেই থাকুন না কেন, মনে মনে তিনি আসলে থাকেন সেই জগতের ভেতরে। যে জগতের সবকিছু হাত বাড়িয়ে শার্টের লম্বা হাতা হয়ে তাঁকে জড়িয়ে ধরল। বন্ধ হয়ে গেল পাল্লা। আর তিনিও শিখে গেলেন কী করে মাসের পর মাস, বছরের পর বছর, এক জন্ম থেকে আরেক জন্ম, ঝুলে থাকা যায় শুধু একটা হ্যাঙ্গার ধরে। জেনে গেলেন কীভাবে স্বপ্ন, কল্পনা আর বাস্তবতা ‘ঘুঁটে’ সিনেমা যাপন করে পার করে দিতে হয়ে ছোট্ট এক জীবন।

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত
ইনস্টাগ্রাম

বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের মা ছিলেন ঢাকার মেয়ে। মায়ের বাবা ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার। এই পরিচালকের ভাষায়, ‘আমার মা সাংঘাতিক মেয়ে ছিলেন! এই পিয়ানো বাজাচ্ছেন, এই চিংড়ি দিয়ে কচুটা রান্না করছেন, এই কবিতা পড়ছেন।’ সেই মা–ই তাঁকে প্রথম ভাবতে শিখিয়েছিলেন, শিখিয়েছিলেন চোখ বন্ধ করে ‘ইমেজ’ দেখতে। প্রায়ই বিকেলে, সন্ধ্যায় তাঁর মা কবিতা পড়তেন, গাইতেন বা পিয়ানো বাজাতেন। আর ৯ ভাইবোনের ভেতর ‘তৃতীয়’ বুদ্ধদেব হাঁ করে তাকিয়ে দেখতেন মাকে। তাই দেখে মা খুবই বিরক্ত হতেন। বলতেন চোখ বন্ধ করে শুনতে। যখনই বুদ্ধদেব চোখ বন্ধ করে শুনতে শুরু করলেন, সেই তখন থেকেই তিনি নানা কিছু দেখতে শুরু করলেন। সেই যে দেখতে শুরু করলেন, একসময় সেগুলোই ডালপালা মেলে হয়ে উঠল একেকটা ‘বাঘ বাহাদুর’, ‘লাল দরজা’, ‘মন্দ মেয়ের উপাখ্যান’, ‘স্বপ্নের দিন’, ‘ফেরা’র মতো মানুষের মনে জায়গা করে নেওয়া, বিশ্বনন্দিত সব সিনেমা।

পাউলি দামের সঙ্গে বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত। টোপ সিনেমার শুটিংয়ে তোলা
সংগৃহীত

সে কবেকার কথা। বুদ্ধদেবের বয়স তখন তেরো কী চৌদ্দ। তখন দুপুরে খেয়ে একটা ভাতঘুম দেওয়ার রেওয়াজ ছিল তাঁদের বাড়িতে। সেই সময় বালক বুদ্ধদেব ঘরের ঘুলঘুলি দিয়ে আছড়ে পড়া রোদের দিকে তাকিয়ে থাকতেন। কত দুপুর এভাবেই ঘুলঘুলির ফাঁক গলে আলপনার মতো ছড়িয়ে, গড়িয়ে বিকেল হতো। সেই সময় থেকেই কবিতারা আসতে শুরু করল বুদ্ধদেবের কাছে। প্রথম একটা পত্রিকার সাহিত্য পাতায় ছাপা হলো তাঁর কবিতার ছয় লাইন। একটা গল্প ছাপার পর যেটুকু জায়গা খালি ছিল, সেখানে ওই ছয় লাইনের বেশি আর আঁটানো সম্ভব হয়নি। সেই কবিতার জন্য পাঁচ টাকা পারিশ্রমিক পেয়েছিলেন ‘সদ্য জন্মানো’ সেই কবি। সেই পাঁচ টাকা হাতে নিয়ে সেই কিশোর কবি ভুলে গিয়েছিলেন পুরো কবিতা ছাপা না হওয়ার দুঃখ। সেই পাঁচ টাকা হাতে ক্ষণিকের জন্য হাওয়ায় মিলে গিয়েছিল জীবনের যাবতীয় দুঃখ শোক। সেই প্রথম ছাপা হলো কবিতা। তারপর থেকে ছাপা হতেই থাকল। এখানে, সেখানে, কবিতার বই হয়ে। আর একসময় সেই কবিতাগুলো ছবি হয়ে, দৃশ্য হয়ে, হয়ে যেতে থাকল সিনেমা। সর্বশেষ ‘উড়োজাহাজ’ হয়ে দর্শকদের ঘুরিয়ে নিয়ে আনল বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের নিজের সেই আলমারি থেকে, সেই জগৎ থেকে।

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত
ফেসবুক

প্রথম কীভাবে সিনেমা বানালেন এই কবি? সে এক মজার গল্প। কলকাতায় একবার এক পরিচালকের বাড়ি গেলেন বুদ্ধদেব। তখন তিনি একেবারেই তরুণ। বললেন, ‘আমি সিনেমা বানাতে চাই।’ সেই পরিচালক বলেন, ‘তো বানিয়ে ফেলো।’ তখন বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত বললেন, ‘কিন্তু কীভাবে?’ তখন সেই পরিচালক বললেন, ‘এই যে যেভাবে তুমি আমার কাছে এলে। বাসে চেপে। সেভাবেই বাসে করে ফিরে যেতে যেতে একটা সিনেমা বানিয়ে ফেল।’ ব্যস, বুদ্ধদেব সেদিন বাসে ফিরতে ফিরতে সিনেমা বানিয়ে ফেললেন। তাঁর প্রথম সিনেমা। বাসে চেপে ঘরে ফিরতে ফিরতে তিনি কল্পনা করলেন, এই তাঁর সেট, এই তাঁর ক্যামেরা, এই তিনি নির্দেশনা দিচ্ছেন। এমন সময় স্পটবয় তাঁকে এই কথা বলল। নায়িকার পানির তেষ্টা পেয়েছে। চা জুড়িয়ে যাচ্ছে। শটটা কিছুতেই ওকে হচ্ছে না...এভাবে কল্পনায় সিনেমা বানাতে থাকলেন বুদ্ধদেব। প্রায়ই প্রতিদিন একটা করে সিনেমা বানাতে লাগলেন। তারপর দেখলেন, কিছু সিনেমা তাঁকে কিছুতেই ছেড়ে যাচ্ছে না। তখন বাধ্য হয়ে বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত ওই সিনেমার ভেতর ডুব দেন। ওই গল্পের আগে পরে, অলিগলি ঘুরতে শুরু করেন। একসময় লাইট–ক্যামেরা নিয়ে লেগে যান সিনেমাটা বানাতে।

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত পরিচালিত আনোয়ার কা আজব কিসসা সিনেমার পোস্টার
সংগৃহীত

এত যে বছরের পর বছর ধরে সিনেমা বানান, বুদ্ধদেবের কিন্তু কখনো ক্লান্ত বা বিরক্ত লাগে না। কেন? এমন এক প্রশ্নের জবাবে তিনি উত্তর দিয়েছেন মাত্র দুটো শব্দে। ‘খিদে’ আর ‘কৌতূহল’। সিনেমার খিদে তাঁর কখনো ফুরায় না। যতটা খিদে নিয়ে প্রথমবার ছবি বানিয়েছিলেন, ততটা খিদে নিয়েই নাকি মারা যাবেন তিনি। এই অতৃপ্তিই তাঁকে প্রতিদিন, প্রতিবার ঠেলে দেয় সিনেমার সঙ্গে জীবন যাপন করতে। তাই তো প্রতিবার তিনি একই রকম কৌতূহল নিয়ে তাকান ক্যামেরার চোখে। চোখ বন্ধ করে দেখেন নানা কিছু। সেই তখনো। আর এখনো। ভাবনার দুয়ার কখনো বন্ধ হয় না তাঁর। তাই তো বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত বলেন, ভাবনারাও মানুষ। বলেন, ‘ভাবো। তবে ভাবলেই স্ক্রিপ্ট লিখবে না। ভাবনার সঙ্গে থাকবে। ভাবনার সাথে বসবাস করা একটা বড় বিষয়। প্রেমিকের সাথে বসবাস করলে বুঝতে পারবে, সে কেমন, সে তোমাকে চায় কি না, তুমি তাকে চাও কি না? তোমাকে যদি না চায়, তবে তিন মাস পর ফুস! তোমাকে ছেড়ে যাবে। তেমনি একটা ভাবনাকেও প্রেমিকের মতো বুঝতে হয়। কতটা সে আমার কাছের। কতটা নিতে পারব। তিন মাস পর যদি সে তোমার সাথে থাকে, তাহলে বুঝতে পারবে, ভারী মজার তো। এই তো সেই মানুষ, যাকে আমি খুঁজছিলাম।’

বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের সিনেমার পোস্টার
সংগৃহীত

ভাবনার জগতে হারিয়ে যাওয়া সেই মানুষের আজ জন্মদিন, যাঁর কাছে জীবন একটা জার্নি। সেই জার্নি কেউ বোঝে, কেউ বোঝে না। তিনিও বেশ খানিকটা বুঝে, কিছুটা না বুঝে, বাকিটা কল্পনার রঙে এঁকে সেই জার্নির কিছু কিছু অনুভব তুলে ধরেন। সেসব বোধ নিয়ে তিনি জায়গা করে নেন সীমানার এ পার থেকে ও পারে, অগণিত মনে, মনের মণিকোঠায়।

তিনিই একজন বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত
ফেসবুক