‘দৃশ্যম’–এর মোহনলাল ছিলেন ঐশ্বরিয়ার প্রথম নায়ক
২০১৩ সালে মুক্তি পাওয়া মালয়ালম চলচ্চিত্র ‘দৃশ্যম’ দেখে মুগ্ধ হননি, এমন দর্শক খুব কমই। একটি সাধারণ পরিবারের হত্যাকাণ্ড লুকানোর থ্রিলিং ছবিটি প্রতি মুহূর্তেই রোমাঞ্চ জাগিয়েছে। একই নামে ছবিটি রিমেক হয় বলিউডেও। অফিশিয়াল রিমেক হিন্দিতেও ঝড় তুলেছিল, যাকে এখন বলিউডের একটি ক্ল্যাসিক থ্রিলার হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সম্প্রতি মূল ‘দৃশ্যম’–এর সিক্যুয়েল ‘দৃশ্যম টু’ মুক্তি পেয়েছে। যথারীতি সাড়া ফেলেছে এটিও। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সিনেমাপ্রেমীদের একাংশের চর্চার বিষয় ‘দৃশ্যম টু’। ‘দৃশ্যম’–এর পাশাপাশি আবার আলোচনায় এসেছেন ছবির কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করা মোহনলাল। নানাভাবে তাঁকে নিয়ে চর্চা হচ্ছে ফেসবুকে, দক্ষিণ ভারতীয় সিনেমার অনুরাগীদের মধ্যে। তাঁর ভক্তরা অবশ্য তাঁকে একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের অভিনেতা হিসেবে মানেন না; বরং তাঁরা মনে করেন, মোহনলাল একজন বৈশ্বিক তারকা।
কেরালার ইলানথুর গ্রামে ১৯৬০ সালের ২১ মে জন্ম নেওয়া ‘কমপ্লিট অ্যাক্টর’খ্যাত এই অভিনেতাকে তাঁর অঞ্চলের মানুষ ‘লালেট্টা’ বলে ডাকে। সেই লালেট্টা যেন মলিউডের বক্স অফিসে সৌভাগ্যের জাদুর কাঠি! ছোট্ট এক ফিল্মপাড়া, যেখানে ৫ থেকে ১০ কোটি রুপি আয়ও একসময় অনেক মনে হতো। অথচ সেখান থেকেই মোহনলাল বের করেছেন ১০০ কোটির সিনেমা! অবাক করার মতো তথ্য হচ্ছে, মলিউডের প্রথম ৫, ১০, ২০, ৩০, ৫০, ১০০ কোটি আয় করা সব কটি সিনেমার অভিনেতা একজনই—মোহনলাল বিশ্বনাথ!
পুরো নাম মোহনলাল বিশ্বনাথ নায়ার। যিনি খল চরিত্র থেকে শুরু করে অ্যাকশন, কমেডি, রোমান্টিক—সবকিছুতে নিজের মুনশিয়ানা দেখিয়ে ৪০ বছরের ক্যারিয়ারে নিজেকে নিয়ে গেছেন অনন্য উচ্চতায়। মেধা আর শ্রমের সম্মিলনে যিনি সাফল্য এনেছেন। বর্তমানে তিনি এমন পর্যায়ে আছেন, যখন কোনো সিনেমায় মোহনলাল থাকা মানে সে সিনেমা যেন সুপারহিট।
দুজন পরিচালক ও একজন অভিনেতার মুখে শোনা যাক মোহনলালের মূল্যায়ন। চার দশকে ৩৪১টি সিনেমা, ২০টি ব্লকবাস্টার উপহার দেওয়া মোহনলাল বলিউডে ২০০২ সালে জুটি বাঁধেন রাম গোপাল ভার্মার সঙ্গে ‘কোম্পানি’ সিনেমায় । এ সিনেমায় তাঁর একটি সংলাপ মনে থাকবে অনেক দর্শকের, ‘পুলিশ সব সময় নিয়মের ভেতরে থেকে কাজ করে, এই কথা কে বলেছে?’ পরিচালক রাম গোপাল ভার্মা বলেছিলেন, ‘কাজ দিয়ে যদি ডিরেক্টরদের শতভাগ খুশি কেউ করতে পারেন, সেটি মোহনলাল।’ মনি রত্নম জানিয়ে দিয়েছেন, ‘তাঁর সঙ্গে কাজ করতে গেলে আমি কাট বলতে ভুলে যাই।’ তামিল সুপারস্টার রজনীকান্ত বলেন, ‘তিনি এমন কিছু চরিত্র করেছেন, যেগুলো আমি স্বপ্নেও ভাবতে পারি না!’
প্রথম সিনেমার মুক্তি ২৫ বছর পর
ক্যামেরার সামনে প্রথম দাঁড়ান ১৯৭৮ সালে। বন্ধুরা মিলে তৈরি করেন ‘তিরানোট্টাম’ নামে একটি সিনেমা। তাতে কুটাপ্পা চরিত্রে অভিনয় করেন মোহনলাল। কুটাপ্পার চরিত্র ছিল মানসিক বিপর্যস্ত ব্যক্তির। প্রথম ছবিতেই ভিন্নধর্মী কিছু করার চেষ্টা সফলতার মুখ দেখেনি। সেন্সর জটিলতায় সে সময় মুক্তি পায়নি ছবিটি। পরে যখন এটি মুক্তি পেল, তত দিনে পেরিয়ে গেছে ২৫ বছর। ২০১৩ সালে ‘তিরানোট্টাম’ দর্শকের সামনে হাজির হয়।
অবশ্য মোহনলালের প্রথম মুক্তি পাওয়া সিনেমা ‘মনজিল ভিরিঞ্জা পুক্কাল’। ১৯৮০ সালের গোড়ার দিকে পরিচালক ফাজিল প্রথম ছবির জন্য এক নতুন মুখ খুঁজছিলেন। এর আগে কখনো পরিচালনা না করা ফাজিল নিজেও ছিলেন নতুন মুখ। ‘মঞ্জিল ভিরিঞ্জা পোক্কাল’ নামের ছবিতে ভিলেনের ভূমিকায় অভিনয় করেন মোহনলাল। প্রচলিত ভাষায় ‘দুর্ধর্ষ’ ছিল তাঁর অভিনয়। তারপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। পরের চার বছরে একে একে ২৫টি সিনেমায় কাজ করেন মোহনলাল, যার অধিকাংশ নেতিবাচক ভূমিকায়। আলোর মুখ না দেখা ‘তিরানোট্টাম’ ছবিতে সহকারী হিসেবে ছিলেন বন্ধু প্রিয়দর্শন। তত দিনে পরিচালনায় নাম লিখিয়েছেন তিনি। ১৯৮৪ সালে বন্ধু মোহনকে দিয়ে করিয়ে নেন কমেডি ড্রামা ‘পোচাক্করু মক্কুত্তি’, বক্স অফিসে পায় বিগ হিটের তকমা। ১৯৮৬ সাল মোহনলাল ক্যারিয়ারের সবচেয়ে সফল বছর। এক বছরে ৩৪টি সিনেমা রিলিজ করার রেকর্ড হয় তাঁর নামে।
১৯৮৮ সালে বন্ধু প্রিয়দর্শনের সঙ্গে আবার জুটি বাঁধেন। ‘চিত্রম’ নামের সিনেমাটি গড়ে এক অনন্য রেকর্ড! ৩৬৫ দিন, অর্থাৎ গোটা এক বছর কেরালার কোনো না কোনো সিনেমা হলে চলেছে এটি! সেখানকার মানুষ সাক্ষী হয় নতুন ইতিহাসের। সিনেমাতে সহজ-সরল বালক কিরেদামের চরিত্র রূপায়ণ করে হাতে তোলেন জুরিবোর্ড ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড। ১৯৮৮ সালে জুরিবোর্ডের মেনশনে পুরস্কার জিতলেও সেরা অভিনেতা হিসেবে প্রথম জাতীয় পুরস্কার পান ১৯৯১ সালে ‘ভারাতাম’ সিনেমার মাধ্যমে। আট বছর পর ১৯৯৯ সালে আবার পান ‘ভানাপ্রস্থাম’ ছবির জন্য। এরপর একে একে অসংখ্য হিট ছবি উপহার দিয়ে স্থানীয় চলচ্চিত্র শিল্পে বড় ভূমিকা রাখেন। ‘থুভানাথুম্বিকাল’, ‘নারোদিকাতু’, ‘আক্কারে আক্কারে আক্কারে’, ‘চন্দ্রলেখা’, ‘উড়ায়ানানানু থারাম’, সব কটিই ব্যবসা সফল ছবি! কমেডিয়ান শ্রীনিবাস আর মোহনলালকে মুভিতে নাও, হিট নিশ্চিত, নব্বইয়ের দশকে মালয়ালম ইন্ডাস্ট্রিতে সাফল্যের ‘পাসওয়ার্ড’ ছিল অনেকটা এমনই! এই জুটির অধিকাংশ সিনেমা পায় হিটের তকমা।
রেকর্ড আর রেকর্ড
এ কথা অনেকেই জানেন, ভারত থেকে সবচেয়ে বেশি আয় করা সিনেমা ‘বাহুবলী টু’। ভারতের প্রায় সব রাজ্যের সব রেকর্ড চুরমার করে প্রভাসের ছবিটি। কিন্তু অক্ষত থাকে কেরালার রেকর্ড, যেটি যথারীতি মোহনলালের দখলে।
কেরালার সর্বোচ্চ ১৬৫ কোটি রুপি আয় করা ‘পুলি’কে টপকাতে পারেনি ‘বাহুবলী’। তেলেগু ভাষায় ‘জনতা গ্যারেজ’ নামে ছবিতে এনটিআর জুনিয়রের সঙ্গে জুটি বাঁধেন লালেট্টা। বক্স অফিসে ১০০ কোটি ছাড়ায় সেটি। অর্জনের মুকুটে যুক্ত হয় দারুণ এক পালক। একমাত্র মলিউড অভিনেতা হিসেবে মালয়ালম এবং তেলেগু, দুই জায়গায় ১০০ কোটি রুপি আয় করা ছবি রয়েছে তাঁর ঝুলিতে।
ঐশ্বরিয়া রাইয়ের প্রথম নায়ক মোহনলাল ছিলেন পেশাদার কুস্তিগির
সিনেমায় নাম লেখানোর আগে মোহনলাল ছিলেন একজন পেশাদার কুস্তিগির। ১৯৭৭-৭৮ সালে কেরালায় কুস্তিতে তিনি চ্যাম্পিয়ন হন। জাতীয় পর্যায়ে কুস্তি প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের কথাও ছিল। কিন্তু সেই প্রতিযোগিতায় তাঁর আর যাওয়া হয়নি। কারণ, প্রথম সিনেমার অডিশন দেওয়ার জন্য ডাক আসে তাঁর। ১৯৯৪ সালে ঐশ্বরিয়া রাই মিস ওয়ার্ল্ড খেতাব জয় করেন। মনি রত্নমের সিনেমা দিয়ে চলচ্চিত্রের ভুবনে পা রাখেন তিনি। ‘ইরুবার’ নামে এই সিনেমায় ঐশ্বরিয়া রাইয়ের বিপরীতে অভিনয় করেছেন এই মোহনলাল।
তায়কোয়ান্দোতে ব্ল্যাক বেল্ট মোহনলাল একজন ব্যান্ড তারকাও
২০০১ সালে ভারতের চতুর্থ বেসামরিক সম্মাননা পদ্মশ্রী এবং ২০১৯ সালে তৃতীয় সম্মান পদ্মভূষণ লাভ করা মোহনলাল নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন একজন প্রসিদ্ধ ব্যবসায়ী হিসেবে। চলচ্চিত্র প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে দুবাইয়ে রেস্টুরেন্ট কিংবা কেরালার নামকরা মসলা ব্যবসায়ী হিসেবে লালেট্টা পৌঁছেছেন খ্যাতির শিখরে।
২০১২ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার সিউলে তায়কোয়ান্দোর সদর দপ্তরে সম্মেলন অনুষ্ঠানে তায়কোয়ান্দোতে ব্ল্যাক বেল্ট প্রদান করা হয় মোহনলালকে, যা এর আগে অভিনেতা হিসেবে পেয়েছিলেন কেবল শাহরুখ খান। শুধু কী তিনি অভিনয় দিয়ে রুপালি পর্দা কাঁপান? শুধু তা নয়, তিনি বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। নানা দিকে পদচারণ তাঁর। এ তারকার একটি ব্যান্ড দলও আছে। নাম ল্যালিসন: দ্য লাল ইফেক্ট।
লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহনলাল ব্লগারও
ভারতীয় অভিনেতাদের মধ্যে তিনিই প্রথম অভিনেতা, যাঁকে ভারতীয় টেরিটোরিয়াল সেনাবাহিনী সম্মানসূচক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মর্যাদা প্রদান করেছে।
একটা বয়সে ইচ্ছা ছিল সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার, হয়ে ওঠেনি। হলে হয়তো পাওয়া হতো না এমন সব্যসাচী অভিনেতাকে। আবার মাথাচাড়া দেয় পুরোনো খায়েস। ভারতীয় সেনা দপ্তর বরাবর আবেদন করেন। তারা সাদরে গ্রহণ করে দেশের এমন রত্নকে। বিশেষ প্রশিক্ষণের পর প্রথম ভারতীয় অভিনেতা হিসেবে ২০০৯ সালে তাঁকে দেওয়া হয় সম্মানসূচক কর্নেল উপাধি।
মোহনলাল একজন ব্লগারও। সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সংশ্লিষ্ট অনেক বিষয় নিয়ে তিনি লেখালেখি করেন ব্লগে। ফিল্মফেয়ার, নন্দী, স্টেট অ্যাওয়ার্ড, কেরালা ফিল্ম সোসাইটির পক্ষ থেকে আজীবন সম্মাননাসহ অজস্র স্মারক আছে তাঁর ক্যারিয়ারে। ফেসবুক, টুইটারের মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো প্রতিনিয়ত সরগরম থাকে লালেট্টার নিত্যনতুন লুক, চ্যালেঞ্জিং কাজের জন্য।
বুর্জ খলিফায় ২৯ তলায় তাঁর ফ্ল্যাট
পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু ভবন দুবাইয়ের বুর্জ খলিফা। সেই বুর্জ খলিফার ২৯ তলায় আছে তাঁর একটি সুবিশাল অভিজাত ফ্ল্যাট। মোহনলাল ১৯৮৮ সালের ২৮ এপ্রিল তামিল চলচ্চিত্র প্রযোজক কে বালাজির কন্যা সুচিত্রাকে বিয়ে করেন। এই দম্পতির দুই সন্তান রয়েছে, প্রণব ও বিস্ময়া মোহনলাল। প্রণব কয়েকটি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন, তাঁর অভিষেক ঘটে মোহনলালের ‘অন্নমন’ চলচ্চিত্রে। মোহনলাল চেন্নাইয়ে থাকেন। প্রায়ই তাঁর নিজ শহর তিরুবনন্তপুরম ও কোচিতে যাওয়া–আসা করেন।