যুগে যুগে বলিউডের গানে কবিগুরুর প্রভাব

বলিউডের সিনেমাও বারবার প্রভাবিত হয়েছে রবীন্দ্রনাথের গানেকোলাজ

পঁচিশে বৈশাখ আজ। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অনন্য সন্তান রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬০তম জন্মবার্ষিকী। ১২৬৮ বঙ্গাব্দের (১৮৬১ খ্রিষ্টাব্দ) পঁচিশে বৈশাখ ভারতের কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে কবির জন্ম। তাঁর রচনাসম্ভার বিপুল ও বৈচিত্র্যময়। সাহিত্যের প্রায় সব শাখায়ই ছিল তাঁর উজ্জ্বল উপস্থিতি। বিস্ময়কর সৃজন প্রতিভা দিয়ে তিনি সমৃদ্ধ করেছেন বাংলা সাহিত্যকে। তাঁর কবিতা, ছোটগল্প, প্রবন্ধ, নাটক, সংগীত, শিশুতোষ রচনা, পত্রসাহিত্য বাংলা সাহিত্যের অমর সংযোজন। রবীন্দ্রনাথ প্রথম থেকেই জানতেন, তিনি কী কারণে পৃথিবীতে এসেছেন। তিনি জানতেন, তাই নির্মোহভাবেই বলেছেন, ‘আমার গান তোমাদের গাইতেই হবে।’
তাঁর জন্মের ১৬০ বছর পেরিয়ে যাচ্ছে। লোকান্তরিত হয়েছেন সেও প্রায় ৮০ বছর পেরিয়ে গেছে। তাঁর গান বাঙালিসহ উপমহাদেশের মানুষের নিত্যদিনের জীবনচর্চায় মিশে আছে গভীরভাবে।

তাঁর গান মঞ্চ, ছোট পর্দা, বড় পর্দার নির্মাণে প্রভাব সৃষ্টি করেছে নানাভাবে, নানা সময়ে। উপমহাদেশসহ সারা পৃথিবীতে প্রভাবশালী বলিউডের সিনেমাও বারবার প্রভাবিত হয়েছে রবীন্দ্রনাথের গানে। ‘মনে রবে কি না’ কিংবা ‘ভেঙে মোর ঘরের চাবি’র মতো কালজয়ী গানগুলো অনুকরণের প্রচেষ্টা ছিল বলিউডে।

রবীন্দ্রসংগীতকে হিন্দি ভাষার চলচ্চিত্রে যোগ করার ব্যাপারে সবার চেয়ে এগিয়ে আছেন শচীন দেববর্মন। এ কথা জোর দিয়ে বলা যায়, বলিউডে রবীন্দ্রসংগীত নিয়ে কাজ করে স্বাক্ষর রেখেছিলেন কিংবদন্তিসম সুরকার শচীন দেববর্মন। এর অবশ্য একটা বড় কারণ, শচীন মূলত বাঙালি। ছিলেন বাংলাদেশের কুমিল্লা জেলার মানুষ। ছোটবেলা থেকেই রবীন্দ্রসংগীত শুনে বড় হয়েছেন। তাঁর মতো আরও বেশ কজন সুরকার আছেন যাঁরা বলিউডে রবীন্দ্রসংগীত যুক্ত করেছিলেন।

শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উপন্যাস ‘পরিণীতা’ নিয়ে প্রদীপ সরকারের চলচ্চিত্র ‘পরিণীতা’তেও আছেন রবিঠাকুর

‘ফুলে ফুলে ঢলে ঢলে’ গানের ছায়ায় ‘পরিণীতা’র গান
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উপন্যাস ‘পরিণীতা’ নিয়ে প্রদীপ সরকারের চলচ্চিত্র ‘পরিণীতা’তেও আছেন রবিঠাকুর। ‘ফুলে ফুলে ঢলে ঢলে’ গানের ছায়া অবলম্বনে শান্তনু মৈত্র সুর করেন এ ছবির একটি গান। সোনু নিগম ও শ্রেয়া ঘোষাল কণ্ঠ দিয়েছেন এ গানে। অভিনয় করেছেন বিদ্যা বালান ও সাইফ আলী খান।

‘রোদন ভরা এ বসন্ত’র প্রভাবে ‘মেরা সুন্দার স্বপ্না বিত গায়া’
১৯৪৯ সালে মুক্তি পাওয়া ‘দো ভাই’ ছবিতে রবীন্দ্রনাথের জনপ্রিয় ‘রোদন ভরা এ বসন্তে’ গানটির অনুকরণে ‘মেরা সুন্দার স্বপ্না বিত গায়া’ গানটি করেছিলেন শচীন দেববর্মন। সুরের সঙ্গে শতভাগ মিল থাকলেও নতুন কথা নিয়ে গানটি করেছিলেন শচীন।

‘পাগলা হাওয়ার বাদল দিনে’ থেকে ‘বান্ধান খুলা পানছি উড়া’
এই তো সেদিনের কথা। ১৯৯৭ সালে মুক্তি পাওয়া নানা পাটেকার ও মনীষা কৈরালা অভিনীত ‘যুগপুরুষ’ ছবিটি দারুণ হিট হয়। ওই ছবিতে ‘বান্ধান খুলা পানছি উড়া’ গানের সঙ্গে মনীষার নাচ ভীষণ আনন্দ দিয়েছিল দর্শকদের। রাজেশ রোশনের ‘বান্ধান খুলা পানছি উড়া’ সুর নেওয়া হয় ‘পাগলা হাওয়ার বাদল দিনে’ থেকে। মূল কথার সঙ্গে কোনো মিল না থাকলে, ভিডিওটি দেখলে মনে হয় রবীন্দ্রনাথের কথার সঙ্গে মিল আছে দৃশ্যায়নে।

বান্ধান খুলা পানছি উড়া’ গানের সঙ্গে মনীষার নাচ ভীষণ আনন্দ দিয়েছিল দর্শকদের

‘সেদিন দুজনে’ থেকে ‘নায়েন দিভানি’
১৯৫০ সালে মুক্তি পাওয়া ‘আফসার’ ছবিতে শচীন দেববর্মন আবারও আশ্রয় নেন রবীন্দ্রনাথের। ওই ছবিতে ‘নায়েন দিভানি এক নাহি মানে’ গানটির সুর পুরোপুরি ‘সেদিন দুজনে দুলেছিনু বনে’ গানের অনুকরণে করেছেন।

‘ভেঙে মোর ঘরের চাবি’ থেকে ‘নানহা সা পাঞ্চি’
১৯৭৭ সালে মুক্তি পায় ‘টটি খিলানে’ ছবিটি। এ ছবিতে বাপ্পি লাহড়ি রবীন্দ্রনাথের ‘ভেঙে মোর ঘরের চাবি নিয়ে যাবি’ অনুকরণে করেন ‘নানহা সা পাঞ্চি রে তু’ গানটি। এ গানে কণ্ঠ দেন কিশোর কুমার।

কিশোর কুমার

‘তোমার হলো শুরু আমার হলো সারা’ গানের সুরে করা ‘ছুঁ কার মেরে মান কো’
‘তোমার হলো শুরু আমার হলো সারা’ গানটি বহুশ্রুত রবীন্দ্রসংগীত। এ গানের সুর অনুকরণে করা ‘ছুঁ কার মেরে মান কো’ বলিউডে রবীন্দ্রসংগীত ব্যবহারের আরেক মাইলফলক। ১৯৮১ সালে রাজেশ রোশনের সংগীতায়োজনে ‘ইয়ারানা’ ছবির এই গানে কণ্ঠ দেন কিশোর কুমার। অমিতাভ ঠোঁট মিলিয়েছেন রোমান্টিক এ গানের সঙ্গে।

‘দিদার’ ছবির এই গানটি পুরোপুরি কবিগুরুর ‘মনে রবে কি না রবে আমারে’ গানটির অনুকরণ

‘মনে রবে কি না’ যখন ‘বাচপান কে দিন’
‘পেয়ারকিয়া তো ডরনা কেয়া’র স্রষ্টা নওশাদ আলীকে ভারতীয় চলচ্চিত্রের সর্বকালের অন্যতম সেরা সংগীত পরিচালক বলা হয়ে থাকে। বলিউডের সবচেয়ে হিট বেশ কিছু ছবির সংগীত পরিচালনা করেছেন তিনি। মেলোডি সুরকার হিসেবে অতুলনীয় এ সুরকার রবীন্দ্রনাথ দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন তাঁর অন্যতম আলোচিত ‘বাচপান কে দিন ভোলা না দেনা’ গানটিতে। ১৯৫১ সালে মুক্তি পাওয়া ‘দিদার’ ছবির এই গানটি পুরোপুরি কবিগুরুর ‘মনে রবে কি না রবে আমারে’ গানটির অনুকরণ।

‘হে ক্ষণিকের অতিথি’র আশ্রয়ে ‘জায়েন তো জায়েন কাহা’
আবার শচীন দেব। ১৯৫৪ সালে মুক্তি পাওয়া ‘ট্যাক্সি ড্রাইভার’ ছবিতে ‘হে ক্ষণিকের অতিথি’ গানটি রূপান্তর করেন ‘যায়ে তো যায়ে কাহা’ শিরোনামে। তালাত মাহমুদের কণ্ঠে গানটি শোভা বাড়িয়েছে অভিনেতা দেব আনন্দের ঠোঁটে।

‘ওরে গৃহবাসী’র সুরে ‘রাহি মাতওয়ালি’
একই বছর সুরকার অনিল বিশ্বাস বিখ্যাত ‘ওয়ারিশ’ ছবিতে ‘রাহি মাতওয়ালি’ গানটি পুরোপুরি করেছেন রবীন্দ্রনাথের ‘ওরে গৃহবাসী খোল্ দ্বার খোল্’ গানের অনুকরণে। এ গানেও কণ্ঠ দিয়েছেন দুজন বিখ্যাত কণ্ঠশিল্পী, তালাত মাহমুদ ও সুরাইয়া জামাল শেখ।

‘তেরে মেরে মিলন কি ইয়ে র‍্যায়না’ গানটি পুরোপুরিই ‘যদি তারে নাই চিনি গো’ গানের অনুকরণে

‘যদি তারে নাই চিনি’ যখন ‘তেরে মেরে মিলন কি’
অমিতাভ-জয়া জুটির ‘অভিমান’ ছবিটি দেখেননি, বয়স্কদের ভেতর এ রকম দর্শক খুঁজে পাওয়া কঠিন হবে। এ ছবির সব কটি গানই জনপ্রিয় হয়েছিল। অমিতাভ ও জয়া দুজনই ছবিতে কণ্ঠশিল্পীর ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। এ ছবিতে জনপ্রিয়তা পাওয়া ‘তেরে মেরে মিলন কি ইয়ে র‍্যায়না’ গানটি পুরোপুরিই ‘যদি তারে নাই চিনি গো’ গানের অনুকরণে। গানটির সুর গ্রহণ করলেও নতুন কথায় বেঁধেছিলেন শচীন দেববর্মন। কণ্ঠ দিয়েছিলেন কিশোর কুমার ও লতা মঙ্গেশকর। ছবিটি মুক্তি পেয়েছিল ১৯৭৩ সালে।