হোস্টেলে ইরফানের ঘর ছিল সবচেয়ে অগোছালো
বলিউড তারকা ইরফান খান ও ভারতের জাতীয় পুরস্কারজয়ী পরিচালক-অভিনেতা তিগমাংশু ধুলিয়ার পথচলা শুরু ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামার (এনএসডি) আঙিনা থেকে। তিগমাংশুর পরিচালনায় ‘হাসিল’, ‘চরস’, ‘পান সিং তোমার’, ‘সাহেব বিবি অউর গ্যাংস্টার রিটার্নস’ ছাড়াও একাধিক টেলিভিশন অনুষ্ঠানে কাজ করেছেন ইরফান। দীর্ঘ ৩৪ বছরের বন্ধুত্ব তাঁদের। এ সময়ে তিগমাংশুকে কখনো অভিভাবকের মতো শাসন করেছেন, পরম স্নেহ দিয়েছেন ইরফান; কখনো বড় ভাই হিসেবে সাহস দিয়েছেন, কখনো বন্ধু হিসেবে বুকে আগলে রেখেছেন। পাশাপাশি গুরু হিসেবেও দেখিয়েছেন পথ। এ রকমই ছিল তাঁদের সম্পর্কের রসায়ন। আজ নিজেকে সর্বহারা, নিঃস্ব এক মানুষ বলে মনে করেন তিগমাংশু। ইরফানের প্রয়াণের এক বছর হয়ে গেল। আজও তিগমাংশু বিশ্বাস করেন না যে ইরফান নেই। অতীতের স্মৃতি হাতড়াতে গিয়ে উঠে এল ইরফানের সঙ্গে তাঁর শাসন, অনুশাসন, আবেগ, আবদার, মান-অভিমান, ভালোবাসায় ভরা দিনগুলোর কথা।
নাটকের স্কুল
ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামায় (এনএসডি) আমি পড়তে যাই ১৯৮৬ সালে। সেখানেই ইরফানের সঙ্গে প্রথম পরিচয়। হোস্টেলে তার ঘরটা ছিল সবচেয়ে অগোছালো। আমি তার এক ক্লাস জুনিয়র ছিলাম। তাকে দেখতাম, বেশির ভাগ সময়ই আত্মমগ্ন থাকত। কারও সঙ্গে খুব একটা কথাবার্তা বলত না। একদম মিশুক স্বভাবের ছিল না। তার ছিল হাতে গোনা কয়েকজন বন্ধু। সুতপা (ইরফানের স্ত্রী) তখন আমার ভালো বন্ধু। কলেজের এক নাটকে প্রথম আমি ইরফানের অভিনয় দেখি। ম্যাক্সিম গোর্কির ‘দ্য লোয়ার ডেপথস’-এ। অসাধারণ সে অভিনয় দেখে আমি তার প্রেমে পড়ে যাই। তখনই আমার মনে হয়েছিল, তার মধ্যে আলাদা কিছু আছে। তখন থেকে আমাদের বন্ধুত্বের শুরু। ধীরে ধীরে ইরফানের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব গাঢ় হয়।
ইরফানের নামডাক ছড়িয়ে পড়ল
আমরা দুজনই ছিলাম সিনেমার পাগল। আমাদের চিন্তাভাবনা, পছন্দ-অপছন্দ, দৃষ্টিভঙ্গি—সবকিছুতে অনেক মিল ছিল। ইরফানের বড় গুণ ছিল, তার জানার প্রবল ইচ্ছা। সব বিষয়ে সে ছিল অত্যন্ত কৌতূহলী। সে জন্য প্রচুর পড়াশোনা করত সে। সেই সময় আমাদের প্রিয় অভিনেতা ছিল আল পাচিনো, রবার্ট ডি নিরোসহ আরও অনেকে। এনএসডির এক বছরে ইরফানের অনেক ভালো কাজের সাক্ষী হয়ে ছিলাম আমি। তবে তার অভিনীত একটা নাটক আজও ভুলতে পারি না। ইরফান এনএসডি থেকে পাস করে বের হওয়ার পর একটা নাটকে অভিনয় করেছিল। ‘লাল ঘাস পে নীলে ঘোড়ে’ নাটকে লেনিন চরিত্রে। দুর্দান্ত সে অভিনয়। সেটার পরই ইরফানের প্রচুর নামডাক ছড়িয়ে পড়ে। এর মধ্যে মীরা নায়ারের ‘সালাম বোম্বে’ ছবিতে কাজ করে সে।
সংগ্রাম হলো শুরু
ইরফান মুম্বাই যাওয়ার কয়েক বছর পর আমিও যাই। তার সঙ্গে আমারও সংগ্রাম শুরু হয়। সেই দিনগুলো ছিল অন্য রকম। আমরা সারা দিন একসঙ্গে কাটাতাম। সারা দিন সিনেমা নিয়ে আড্ডা দিতাম। ধীরে ধীরে ইরফানকে অন্য উচ্চতায় উঠে যেতে দেখি। অভিনেতা আর মানুষ—দুই ইরফানের মধ্যেই অনেক পরিবর্তন আসে। সে নিজেকে আরও পরিপক্ব করে তোলে। ইরফান সব সময় চেষ্টা করত, অভিনেতা হিসেবে নিজেকে আরও উচ্চতায় নিয়ে যেতে।
অসাধারণ হয়েও সাধারণ ছিল ইরফান
জয়পুরের এক প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে উঠে আসা সাধারণ ইরফান অসাধারণ হয়েও সাধারণই রয়ে গেল। তার মধ্যে কোনো অহংকার বা সেই ধরনের কোনো পরিবর্তন আসেনি। আর ইরফানের এই গুণই তাকে সবার থেকে আলাদা করে ফেলেছিল। সফলতার ভারে সে কখনো নুয়ে পড়েনি। বরং সফলতা থেকে আরও শিক্ষা নিয়েছে। ছোট শহর থেকে আসা অনেককেই দেখেছি যে সফলতা তাদের মাথায় চড়ে বসেছে। এরপর কোথাও তারা হারিয়ে গেছে অথবা যায়নি। কিন্তু ইরফান ছিল সত্যিই ব্যতিক্রম। সে সফলতাকে খুব সুন্দরভাবে সামলাতে পারত। ইরফান সব ছবির শুরুতে মনে করত, সেটা দিয়েই তার অভিনয়জীবন শুরু হচ্ছে। হলিউডে ইরফান অনেক কাজ করেছে। আর সব সময় তার মধ্যে ছিল শেখার মানসিকতা। এত বড় স্টার হয়েও ইরফান মাটিতে পা রেখে চলত। অসম্ভব বিনয়ী, জ্ঞানী, হাসিখুশি, প্রাণবন্ত, বিন্দাস এক মানুষ ছিল সে। তার সেন্স অব হিউমার ছিল দুর্দান্ত। তাই ইন্ডাস্ট্রির সবাই তাকে দারুণ ভালোবাসত।
অসাধারণ ইয়াকনি পোলাও
ফিল্ম ছাড়া ক্রিকেট, ওয়াইল্ড লাইফ, পরিবেশ নিয়ে কথা বলতে ভালোবাসত ইরফান। রাজনীতি নিয়েও আগ্রহ ছিল। দেশের পরিস্থিতি নিয়ে ইরফানকে অনেক সময় উদ্বিগ্ন হতে দেখেছি। বেড়াতে অসম্ভব ভালোবাসত, বিশেষ করে জঙ্গলে। আমরা একসঙ্গে অনেকবার জিম করবেট ন্যাশনাল পার্কে গেছি। তবে সিনেমার পর তার সবচেয়ে প্রিয় বিষয় ছিল ক্রিকেট। লন্ডনে চিকিৎসার জন্য সে দীর্ঘদিন সেখানে ছিল। ইরফান তখন নিজের কাছে সব সময় ফোন রাখত না। সুতপার সঙ্গে আমার স্ত্রীরও ছিল দারুণ বন্ধুত্ব। আমি তার কাছ থেকেই সব খবরাখবর পেতাম। লন্ডনে থাকতে আমার সঙ্গে বেশ কয়েকবার কথা হয়েছে। তবে সিনেমা নিয়ে নয়। তখন বিষয় ছিল ক্রিকেট। ক্রিকেট নিয়েই আমরা কথা বলতাম। ভারতের ইংল্যান্ড সফর নিয়ে আমাকে অনেক কিছু বলেছিল সে। লর্ডসে গিয়ে ইংল্যান্ড-পাকিস্তান ম্যাচ দেখেছিল ইরফান। এ বিষয় নিয়ে সে ছিল ভীষণ রোমাঞ্চিত। আমাকে ফোনে সেই ম্যাচের বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছিল। খাওয়াদাওয়ার বিষয়ে সে ছিল খুবই শৌখিন। কোনো দিনই পরিমাণে বেশি খেতে পারত না। তবে সুস্বাদু খাবার ছাড়া ইরফান মুখে তুলত না। রান্নাবান্নাও করতে পারত। ইরফান দারুণ ‘ইয়াকনি পোলাও’ রাঁধত। আমি তার রান্না করা ওই পোলাও খেতে খুব পছন্দ করতাম। আর সে ভালো ঘুড়ি ওড়াতে পারত। আমরা সবাই মিলে ঘুড়ি ওড়াতাম।
ইরফান জন্মায় এক শতকে দু-একজন
আমার পরম সৌভাগ্য যে ইরফানের মতো অভিনেতাকে নিয়ে আমি প্রচুর কাজ করার সুযোগ পেয়েছি। আমার মতো অন্য কেউ তার সঙ্গে এত কাজ করেনি। ইরফানকে নিয়ে সিনেমা করার সময় আমার চেষ্টা থাকত তাকে সেই উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার। এমনকি লেখক হিসেবেও আমাকে অনেক ভাবনাচিন্তা করতে হতো। ইরফান যে দৃশ্যে আছে, সেই দৃশ্যের মধ্যে আরও বেশি সৃজনশীলতা যোগ করতে হতো আমাকে। বাড়তি যত্ন নিয়ে সেই দৃশ্যটা করতে হতো আমাকে। আমি জানি, সে–ই পারবে দৃশ্যটাকে অন্য মাত্রায় নিয়ে যেতে। ইরফান যখন কোনো চরিত্রের জন্য নিজেকে তৈরি করত, সেই চরিত্রের মধ্যেই ডুবে থাকত। সে অত্যন্ত সমঝদার অভিনেতা ছিল। চিত্রনাট্য তার অভিনয়গুণে জীবন্ত হয়ে উঠত। সেটে জানপ্রাণ দিয়ে অভিনয় করত সে। সত্যি বলতে, সে ছিল অভিনয়ের জাদুকর। তার মতো অভিনেতা এক শতকে দু-একজন জন্মায়। আর মানুষ ইরফান তো একজনই। আমাদের সম্পর্কটা ছিল ভারি অদ্ভুত। আমি তাকে কখনো বাবা হিসেবে পেয়েছি, কখনো বড় ভাই হিসেবে। আমার সবচেয়ে প্রিয় এবং কাছের বন্ধু ইরফানই। কখনো গুরু হিসেবে সে আমাকে পথ দেখিয়েছে। তাই আমি এক জীবনে তার সঙ্গে সব রকম সম্পর্কের স্বাদ পেয়েছি।
আমার মননে, সৃষ্টিতে, আমার মধ্যে চিরকাল জীবন্ত হয়ে থাকবে প্রাণের ইরফান। শেষ বেলায় আমাদের কোনো কথা হয়নি। হাসপাতালে গিয়ে দেখি হাসিখুশি, প্রাণবন্ত মানুষটা অচেতন; পড়ে আছে বিছানায়। অথচ আমাদের আরও কত কথা বলার ছিল। আরও কত সৃষ্টির উল্লাসে মেতে ওঠা বাকি ছিল। আরও কত পথচলা বাকি ছিল!
অনুলিখন: দেবারতি ভট্টাচার্য, প্রতিনিধি, মুম্বাই