জীবন থেকে আর নেওয়া যায় না

জহির রায়হান পরিচালিত ‘জীবন থেকে নেয়া’ ছবির এই গল্প ছিল যেন স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের এক সাংস্কৃতিক মুখবন্ধ। ছবি: সংগৃহীত

সংসারে এক নারী ছিল, যার সিদ্ধান্তের ওপরে কোনো কথা বলা যেত না। তিনি অত্যাচার করতেন, কথা বলতে দিতেন না, গান করতেও দিতেন না। প্রতিবাদ করলে অত্যাচারের মাত্রা যেত বেড়ে। পশ্চিম পাকিস্তানের স্বৈরাচার সরকারের অত্যাচারকে প্রতীক করে নির্মাতা জহির রায়হান সেই ১৯৭০ সালে বানিয়েছিলেন ‘জীবন থেকে নেয়া’ ছবিটি।

‘জীবন থেকে নেয়া’ চলচ্চিত্রের একটি দৃশ্য। ছবি: সংগৃহীত

আজকের দিনে, অর্থাৎ ১০ এপ্রিল মুক্তি পেয়েছিল ছবিটি। সে বছর বাংলাদেশ ছিল পরাধীন। সেই হিসেবে ছবিটি মুক্তির আজ ৫১ বছর। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর। আমাদের মুক্তিযুদ্ধেরও ৫০ বছর। কিন্তু মুক্তি কতটা মিলেছে? সে হিসাব মিলবে না। কারণ, এখন সিনেমা বানানোর নানা প্রতিবন্ধকতা, নানা বিধিনিষেধ। বাস্তব জীবনে যত চরিত্র আছে, তাঁরা কেউ সিনেমার পর্দায় নিজেদের প্রতিচ্ছবি দেখতে চান না। তাই জীবন থেকে এখন আর তেমন কিছুই নেওয়া যায় না।

‘জীবন থেকে নেয়া’ চলচ্চিত্রের একটি দৃশ্যে রাজ্জাক ও সুচন্দা। ছবি: সংগৃহীত

গত ৫১ বছরে ঘাটতি তৈরি হয়েছে চলচ্চিত্রে। নানা রকম ক্ষয় আর অবক্ষয়ে জেরবার হয়ে গেছে বাংলাদেশের সিনেমা। সময় এগিয়েছে, বাংলাদেশের সিনেমা যেন পিছিয়েছে। নানা গতিরোধকে ধাক্কা খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়েছে। জহির রায়হানের মতো সমাজ ও রাজনীতিসচেতন মেধাবী পরিচালক তেমন আসেননি। বরং ‘জীবন থেকে নেয়া’র যত মেধাবী কুশলী, একে একে তাঁদের প্রায় সবাইকে হারিয়েছে বাংলাদেশ। ছবিটির চিত্রনাট্যকার ও অভিনেতা আমজাদ হোসেন, অভিনেতা ও সংগীত পরিচালক খান আতাউর রহমান, অভিনেতা আনোয়ার হোসেন, রাজ্জাক, শওকত আকবর, বেবি জামান, অভিনেত্রী রওশন জামিল, রাজী আফসারিরা নেই।

কী ছিল না সেই ছবিতে! কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আমার সোনার বাংলা’, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘কারার ওই লৌহ-কবাট’, আবদুল গাফফার চৌধুরীর লেখা ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো’ গানগুলো ছবিটায় এসেছে যেন গল্পের হাত ধরে। এগুলোর সংগীত পরিচালনা করেছিলেন বহু গুণের আধার খান আতাউর রহমান।

জীবন থেকে নেয়া। ফাইল ছবি

ছবির অন্যতম অভিনেত্রী ও পরিচালক জহির রায়হানের স্ত্রী সুচন্দা এখনো জীবিত। জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার-২০১৯-এ আজীবন সম্মাননা দেওয়া হয় তাঁকে। অভিনেতা সোহেল রানার সঙ্গে যৌথভাবে এ সম্মাননা পান তিনি। গত ১৭ জানুয়ারি পুরস্কারটি অবশ্য সশরীরে নিতে যেতে পারেননি তিনি। শরীর সে সুযোগ দেয়নি কোহিনুর আক্তার সুচন্দাকে। সদ্য ওপেন হার্ট সার্জারি হয়েছে তাঁর।

‘জীবন থেকে নেয়া’ ছবিতে একাকার হয়ে গিয়েছিল রওশন জামিল ও তৎকালীন স্বৈরশাসকের কর্মকাণ্ড। ছবির অন্যতম অভিনেতা আনোয়ার হোসেন ছিলেন তখনকার জনপ্রিয় ও সচেতন দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক নেতা, রাজ্জাক এক প্রতিবাদী বিদ্রোহী ছাত্র আন্দোলনের প্রতিনিধির ভূমিকায়। এ রকম চরিত্র বাস্তবে খুঁজে পাওয়া হবে কঠিন, আর পর্দায় তুলে আনা নানা কারণে আরও কঠিন। ‘জীবন থেকে নেয়া’ ছবিটিকে তাই বলা যায়, বাঙালির দুঃসাহসের সোনালি অতীত, যার দিকে তাকালেও কিছুটা শক্তি ফিরে পাওয়া যায়।