ঢাকায় আসা কিছু মানুষের স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গের গল্প

গতকাল মুক্তি পেয়েছে ঢাকা ড্রিম

সারা দেশ থেকে ঢাকায় আসা মানুষদের নিয়ে একটি ছবি করার চিন্তা প্রসূন রহমানের মাথায় প্রথম ঢুকিয়েছিল আসলে প্রথম আলো। ঢাকায় আসা মানুষদের নিয়ে সাত–আট বছর আগে পত্রিকাটি তাদের প্রথম পাতায় একটি প্রতিবেদন করে। সেটি পড়েই প্রসূন প্রথম জানতে পারেন, ঢাকা শহরের জনসমুদ্রে প্রতিদিন স্থায়ীভাবে যুক্ত হচ্ছেন প্রায় ১ হাজার ৭০০ নতুন মানুষ। এই প্রতিবেদনটি প্রসূন রহমানের মনে কতকগুলো প্রশ্নের জন্ম দেয়। এই শহরে প্রতিদিন এত মানুষ কেন আসেন? কোন স্বপ্ন তাঁদের তাড়িত করে? তাঁরা কি আসতে বাধ্য হন নাকি স্বেচ্ছায় আসেন? এসব প্রশ্নই আস্তে আস্তে একটি চিত্রনাট্যের রূপ লাভ করে।

২০১৪ সালে বেঙ্গল ফাউন্ডেশন নবীন‌ নির্মাতা প্রকল্পের আওতায় যে চিত্রনাট্য প্রতিযোগিতার আয়োজন করে, তাতে জমা পড়া ১৩৪টি চিত্রনাট্যের মধ্য থেকে সেরা ১০-এ জায়গা করে নেয় ঢাকা ড্রিম নামের সেই চিত্রনাট্য। এই ১০টি চিত্রনাট্যই বেঙ্গলের প্রযোজনায় নির্মিত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু নানা কারণে প্রকল্পটি পরে আর বাস্তবে রূপ লাভ করেনি। তাই একসময় নিজেই স্বাধীনভাবে ছবিটি বানানোর সিদ্ধান্ত নেন প্রসূন। ২০১৬ সালে কুমার বিশ্বজিতের স্টুডিওতে বারী সিদ্দিকীর কণ্ঠে একটি গান রেকর্ডিংয়ের মধ্য দিয়ে শুরু হয় কাজ।

সেই কাজ শেষ হতে পাঁচ বছর লেগে গেল। ‘ভাগ্যিস ছবিতে কোনো শিশুশিল্পী ছিল না; তাহলে এতদিনে সে কিশোর হয়ে যেত,’ দীর্ঘসূত্রতা নিয়ে মজা করতে গিয়ে বলেন পরিচালক।

রাজধানীতে আসতে চাওয়া কিংবা আসতে বাধ্য হওয়া কিছু মানুষের স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গের গল্প নিয়ে নির্মিত হয়েছে চলচ্চিত্র ঢাকা ড্রিম

অবশেষে গতকাল মুক্তি পেয়েছে ঢাকা ড্রিম। তার আগে ছবিটি অবশ্য টরন্টোর ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল অব সাউথ এশিয়া থেকে ঘুরে এসেছে । ঢাকার স্টার সিনেপ্লেক্সের বসুন্ধরা ও সনি সিনেপ্লেক্স, যমুনা ব্লকবাস্টার ও শ্যামলী এবং নারায়ণগঞ্জের সিনেস্কোপ ও কিশোরগঞ্জের রাজ সিনেমা হলে মুক্তি পেয়েছে ঢাকা ড্রিম।

‘ঢাকা ড্রিম’ ছবির গান রেকর্ডিংয়ের ফাঁকে কুমার বিশ্বজিৎ, বারী সিদ্দিকী ও প্রসূন রহমান

শুক্রবার সারা দিন দলসহ ঢাকা এবং নারায়ণগঞ্জের হলগুলোতে ঘুরে বেড়িয়েছেন প্রসূন রহমান। দুপুরে এসেছিলেন স্টার সিনেপ্লেক্সে, সেখানেই পরিচালকের সঙ্গে কথা হয়। শুরুতেই তিনি জানান, বাস্তু হারিয়ে, জীবিকার প্রয়োজনে এবং উন্নত জীবনের আশায় ঢাকায় আসতে ‌চাওয়া, আসতে বাধ্য হওয়া কিছু প্রান্তিক

মানুষের স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গের গল্প নিয়ে এ ছবি। নানা চরিত্রের সমন্বয়ে আলাদা ১০টি গল্পকে এক সুতায় গাঁথা হয়েছে। ছাত্র, যৌনকর্মী, স্বল্পশিক্ষিত বেকার, অন্ধ ভিক্ষুক, খুনি, রিকশাচালক, নরসুন্দর, রিয়েলিটি শোর প্রতিযোগী এবং নদীভাঙনে গৃহহারা পরিবারের প্রতিনিধি—সমাজের নানাস্তর থেকে উঠে আসা এসব মানুষের দেখা মিলবে ছবিতে। প্রত্যেকেই তাঁরা গ্রাম থেকে ঢাকায় যাওয়ার স্বপ্ন দেখেন।

‘ঢাকা ড্রিম’ ছবির দৃশ্যে শাহাদাত হোসেন ও জয়িতা মহলানবীশ

যে কেউ এসব গল্পের কোনো না কোনোটার সঙ্গে নিজেকে মেলাতে পারবেন। চরিত্রগুলো সব আমাদের দেখা, আমাদের চেনা ‌পরিপার্শ্ব থেকে নেওয়া। তাঁরা আমাদেরই একজন। কেউ হয়তো বলপূর্বক উচ্ছেদ হয়ে এসেছেন, কেউ হয়তো রাজনৈতিক হঠকারিতার শিকার, কেউ–বা উন্নত জীবনের আশায় রাজধানীমুখী হয়েছেন।

গতকাল শুক্রবার ছবিটির দর্শক ছিল আশানুরূপ। ছবি দেখা দর্শকের প্রতিক্রিয়াও ইতিবাচক। বিশেষ করে চেনা মানুষদের নিয়ে একটি সহজ–সরল ও সফল দেশি ছবি হিসেবে মূল্যায়ন করেছেন অনেকে।
ঢাকা ড্রিম চলচ্চিত্রে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয় করেছেন এস এম মহসীন, ফজলুর রহমান বাবু, মনিরা মিঠু, শাহাদাত হোসেন, জয়িতা মহলানবীশ, পূর্ণিমা বৃষ্টি, আবদুল্লাহ রানা, হিন্দোল রায়, শাহরিয়ার সজীব, সুজাত শিমুল প্রমুখ।

চরিত্রগুলো সব আমাদের দেখা, আমাদের চেনা ‌পরিপার্শ্ব থেকে নেওয়া

ঢাকা ড্রিমের সংগীত পরিচালনা করেছেন কুমার বিশ্বজিৎ। ছবিতে গান আছে তিনটি। গেয়েছেন বারী সিদ্দিকী, মমতাজ ও কুমার বিশ্বজিৎ। এর মধ্যে ‘একদিন আমারও ছিল ঘর হায়রে, আমারও ছিল ঘর নদীর স্রোতে ভাইঙ্গা নিল, ভাঙ্গিল অন্তর’ গানটি গেয়েছেন বারী সিদ্দিকী। গান গাওয়ার কিছুদিন পরই মারা যান তিনি। আরও মর্মান্তিক গানটির চিত্রায়ণে অভিনয় করেছিলেন যে শিল্পী, সেই এস এম মহসীনও গত বছর করোনায় মারা গেছেন। শিল্পীদ্বয় নেই, কিন্তু তাঁদের কাজ রয়ে গেছে। ছবিটি বারী সিদ্দিকীর স্মৃতির উদ্দেশে উৎসর্গ করেছেন পরিচালক।