তাঁকে ভুলতে বসেছে ঢাকার চলচ্চিত্র
সেই অর্থে কেউ তাঁকে মনে রাখেনি। মনে রাখেনি এফডিসি, মনে রাখেনি চলচ্চিত্রের কোনো সমিতি। অথচ তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। ঢাকাই চলচ্চিত্রের সাদাকালো যুগ থেকে শুরু করে রঙিন যুগেরও অনেক সফল চলচ্চিত্রের সঙ্গে জড়িয়ে আছে এম এ সামাদের নাম। সমকালীন অনেক প্রতিষ্ঠিত সিনেমাটোগ্রাফারের মুভি ক্যামেরার হাতেখড়ি তাঁর কাছে। একাধারে চলচ্চিত্র গ্রাহক, চলচ্চিত্র শিক্ষক, পরিচালক-প্রযোজক এই মানুষটাকেই ভুলতে বসেছে ঢাকার চলচ্চিত্র।
২০০৪ সালের ২৮ অক্টোবর ঢাকায় মারা যান এম এ সামাদ। আজ তাঁর ১৭তম মৃত্যুবার্ষিকী। এই সূত্রে ফেসবুকে তাঁর ছবি ভেসে উঠেছে। কয়েকজন অনুরাগী ছবি দিয়ে স্মৃতিকথায় স্মরণ করেছেন তাঁকে। এর বাইরে এফডিসির ভেতরে–বাইরে চলচ্চিত্রের সংগঠন, সমিতি কোনো আনুষ্ঠানিক আয়োজন করেনি।
১৯৩৭ সালের ৮ জুলাই সিলেটের হবিগঞ্জ জেলায় জন্মগ্রহণ করেন এম এ সামাদ। বাবার ইচ্ছা ছিল ছেলে বড় আইনজীবী হবে, তাই গ্র্যাজুয়েশন শেষ করেই ব্যারিস্টারি পড়ার জন্য ১৯৫৭ সালে লন্ডনে চলে যান তিনি। কিন্তু সেখানে লিঙ্কনস ইন কলেজে ছয় মাস পড়ার পর আর আইন নিয়ে লেখাপড়া তাঁর ভালো লাগেনি। ভর্তি হন চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্সিতে। সেখানেও খুব বেশি দিন মন টেকেনি। এরপর তিনি ব্রিটিশ ফিল্ম ইনস্টিটিউটের দ্য লন্ডন স্কুল অব ফিল্ম টেকনিকে চলচ্চিত্র প্রোডাকশন টেকনিক কোর্সে ভর্তি হন। প্রথম বছরের চূড়ান্ত পরীক্ষায় ভালো করায় প্রিন্সিপাল রবার্ট ডানবার তাঁকে পরবর্তী তিন বছরের জন্য বৃত্তির ব্যবস্থা করে দেন। পাশাপাশি রয়্যাল একাডেমি অব ড্রামাটিক আর্টস থেকে অভিনয় ও মেকআপের ওপরও প্রশিক্ষণ নেন তিনি।
লন্ডন স্কুল অব ফিল্ম টেকনিকে পড়ার সময়েই তিনি বিশ্বখ্যাত ‘গানস অব নাভারন’, ‘দ্য ব্রিজ অন দ্য রিভার কাওয়াই’ ছবিতে শিক্ষানবিশ চিত্রগ্রাহক হিসেবে কাজ করেন। ১৯৬২ সালে বিবিসিতে ক্যামেরাম্যান হিসেবে যোগ দেন তিনি। মা–বাবার আহ্বানে বিবিসির চাকরি ছেড়ে দিয়ে দেশে ফিরে আসেন।
দেশে ফিরে এসে তিনি খ্যাতিমান চিত্রগ্রাহক সাধন রায়ের সহযোগী হিসেবে কাজ শুরু করেন। একসময় একক চিত্রগ্রাহক হিসেবে কাজ শুরু করেন। এম এ হামিদ পরিচালিত ‘অপরাজেয়’ তাঁর একক চিত্রগ্রাহক হিসেবে প্রথম কাজ। কিন্তু চিত্রগ্রাহক হিসেবে মুক্তিপ্রাপ্ত তাঁর প্রথম ছবি কাজী জহিরের ‘বন্ধন’ (১৯৬৪)।
‘রূপবান’, ‘১৩ নং ফেকু ওস্তাগার লেন’, ‘অপরাজেয়’, ‘ইন্ধন’, ‘নবাব সিরাজউদ্দৌলা’, ‘ঈশা খাঁ’, ‘আবির্ভাব’, ‘ভাগ্যচক্র’, ‘ওরা ১১ জন’, ‘সংগ্রাম’সহ প্রায় বেশ কিছু চলচ্চিত্রের চিত্রগ্রহণের কাজ করেছেন এম এ সামাদ। একসময় চলচ্চিত্র প্রযোজনা ও পরিচালনাতেও হাত দেন তিনি।
তাঁর প্রযোজিত ও পরিচালিত চলচ্চিত্রের মধ্যে আছে‘সূর্যগ্রহণ’, ‘সূর্য সংগ্রাম’ ও ‘শিরি ফরহাদ’। পাশাপাশি তিনি ‘প্রসন্ন পানি’ নামে একটি প্রামাণ্যচিত্রও নির্মাণ করেন। ১৯৮৭ সালে আবদুস সামাদের সর্বশেষ ছবি ‘ধাক্কা’র কাজ মাঝপথে বন্ধ হয়ে যায়।
নব্বইয়ের দশকের গোড়ার দিকে চলচ্চিত্র নির্মাণ থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেন আবদুস সামাদ, প্রতিষ্ঠা করেন ফিল্ম ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ। চলচ্চিত্রের জটিল, কারিগরি ও তাত্ত্বিক দিকগুলো সহজ করে চলতি প্রজন্মকে হাতে–কলমে শেখাতেই এ উদ্যোগ নিয়েছিলেন তিনি। তাঁর ইনস্টিটিউট থেকে ১০টির মতো ব্যাচ হাতে–কলমে চলচ্চিত্রবিষয়ক শিক্ষা লাভ করে। প্রশিক্ষিত চলচ্চিত্রকর্মী গড়ে তুলতে এফডিসিতে প্রথম চলচ্চিত্র প্রশিক্ষণকেন্দ্র প্রতিষ্ঠায়ও তাঁর ভূমিকা ছিল। স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির ফিল্ম অ্যান্ড মিডিয়া বিভাগের শিক্ষক ও বিভাগীয় চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করে গেছেন আমৃত্যু। এম এ সামাদ বাংলাদেশ ক্যামেরাম্যান অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন।
স্বাধীনতাযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছেন এম এ সামাদ, ছিলেন সেক্টর কমান্ডার খালেদ মোশাররফের ক্র্যাক প্লাটুনের গেরিলা সদস্য। প্রগতিশীল, আধুনিক চিন্তাচেতনার মানুষটি তাঁর ধ্রুপদি ক্যামেরার কাজের মাধ্যমে পেয়েছেন বাংলাদেশের অন্যতম সেরা চিত্রগ্রাহকের সুনাম। বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে ও চলচ্চিত্রশিল্পে তাঁর অবদান, অবশ্য অবশ্যই স্মরণযোগ্য। তাঁকে স্মরণ করা আমাদের দায়িত্ব।
তথ্যসূত্র: অনুপম হায়াৎ, ফকরুল আলম