মাল্টিপ্লেক্সেই ভরসা

মধুমিতা, বলাকা, জোনাকী, আনন্দসহ ঢাকার সিনেমা হলগুলো একসময় জমজমাট ছিল। সিনেমার আগে–পরে দর্শকদের ভিড়ে পা ফেলা যেত না। এমনও দেখা যেত, দর্শক টিকিটের লাইনে দাঁড়িয়েই দেখতেন অন্য পাশে হাউস ফুল লেখা বোর্ড ঝুলছে। সোনালি দিনের সিনেমার মতো এসবই এখন অতীত। ধুঁকে ধুঁকে কিছু হল চললেও বাকি সিনেমা হলগুলোর কোনোটা বন্ধ, কোনোটা মৃতপ্রায়। এ অবস্থা শুধু ঢাকাতেই নয়। দেশের নানা প্রান্তে এখন হাতে গোনা সিনেমা হল। একের পর এক যেখানে কমতে শুরু করেছে সিনেমা হল, সেখানে দেশের সিনেমার দর্শকদের জন্য সুখবর নিয়ে আসছে মাল্টিসিনেপ্লেক্সগুলো। হল–সংকটে কতটা আশার আলো দেখাতে পারে এসব সিনেপ্লেক্স?

একে তো ভালো মানের সিনেমা কমে গেছে, তার ওপর সেসব ছবি দেখতে ভাঙা চেয়ার আর স্যাঁতসেঁতে বিশাল গুদামঘরে দর্শক কেন যাবেন, এ প্রশ্ন সিনেমা নির্মাণসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের। তাঁরা মনে করেন, তরুণ দর্শক এখন ঘরে বসেই দেশ-বিদেশের ওটিটিতে সিনেমা দেখছেন। সেখানে নানা নতুনত্ব থাকছে। সিনেমা পরিচালক ও সমালোচক মতিন রহমান মনে করেন, দর্শক ভাঙা হলে এই সময়ে যাবে না। এখন দর্শকদের রুচি, চিন্তা, সময়ের রুটিন বদলে গেছে। মানুষ পরিবর্তিত হচ্ছে। সেখানে সমন্বিতভাবে সিনেমা হলকে বদলাতে হবে। তাহলে এর বিকল্প কী? এমন প্রশ্নের জবাবে মতিন রহমান বলেন, ‘ভবিষ্যতে সিনেপ্লেক্সগুলোই আশা দেখাবে। সিঙ্গেল হল একদম ভেঙে যাবে। তখন আরও ভালো সিনেমা নির্মিত হবে। কারণ, সিনেপ্লেক্সের দর্শক রুচি আলাদা। তারা দর্শক টানতে মানহীন সিনেমা চালাবে না।’
শুরুতে ঢাকায় সিনেপ্লেক্স চালুর সময় ঢালিউডের অনেক সিনেমাই সিনেপ্লেক্স কর্তৃপক্ষ চালায়নি। সিনেপ্লেক্স তাদের মতো করেই বিদেশি ছবির দর্শক ধরার চেষ্টা করেছে। আস্তে আস্তে চিত্রটা বদলে যেতে থাকে। এ অবস্থা থেকে সরে এসেছে সিনেপ্লেক্স। এখন তাদেরও ঢাকাই সিনেমার দর্শক তৈরি হয়েছে।

সিনেপ্লেক্সে দর্শক আগের চেয়ে এখন অনেক বেশি। একসময় যে সিনেপ্লেক্সে বাংলা ছবির দর্শক ছিল না, এখন হলিউডের সিনেমার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দর্শক ভিড় করছেন দেশের সিনেমা দেখার জন্য। সেই জায়গা থেকে চলচ্চিত্র নির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী বলেন, ‘এই মুহূর্তে সিনেমা দেখানোর জন্য সিনেপ্লেক্সের কোনো বিকল্প নেই। দর্শক এখন সিনেপ্লেক্সে সিনেমা দেখতে চান। সেই পরিবেশ সারা দেশের দর্শকদের জন্য তৈরি করে দিতে হবে। সারা দেশের ছোট বড় শহরে সিনেপ্লেক্স নির্মাণ এখন সময়ের দাবি।’

২০০৪ সালের পরে একের পর এক নতুন সিনেপ্লেক্স বানিয়ে সুখবর দিচ্ছে স্টার সিনেপ্লেক্স কর্তৃপক্ষ। সম্প্রতি তারা সিনেপ্লেক্সের পঞ্চম শাখা হিসেবে ১২ মে থেকে বঙ্গবন্ধু সামরিক জাদুঘরে চালু করেছে নতুন সিনেপ্লেক্স। ১৮৬ আসন নিয়ে চলছে এটি। বরাবরের মতো মনোরম পরিবেশ, আধুনিক প্রযুক্তিসংবলিত সাউন্ড সিস্টেম, জায়ান্ট স্ক্রিনসহ বিশ্বমানের সিনেমা হলের যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা রয়েছে। শুধু তা–ই নয়, চট্টগ্রাম, বগুড়াসহ তিনটি বড় শহরে এ বছরই সিনেপ্লেক্স চালু হবে।

স্টার সিনেপ্লেক্সের জ্যেষ্ঠ বিপণন কর্মকর্তা মেজবাহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘শুরু থেকে আমরা দর্শকদের জন্য পরিবেশ ও মুভি সিলেক্টকে গুরুত্ব দিয়েছি। অশ্লীল সিনেমার যুগে আমরা শুধু ভালো বাংলা সিনেমাগুলোই দর্শকদের দেখিয়েছি। যে কারণে কাস্টমার আমাদের সাপোর্ট দিয়েছে। আমাদের ওপর আস্থা রেখেছে। তার ফল হিসেবে ঈদেও গলুই এবং শান সিনেমায় অভাবনীয় সাড়া পেয়েছি। আমরা বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে দেশের দর্শকদের সেরা পরিবেশে সেরা সিনেমা দেখার সুযোগ করে দিচ্ছি। কারণ, আজকের সিনেমার যুগটাই মাল্টিপ্লেক্সের।’
হলে সিনেমা চালাতে প্রযোজকদের গুনতে হয় বাড়তি অনেক টাকা। পাওয়া যায় না আর্থিক কোনো সঠিক হিসাব। বকেয়া অর্থ পাওয়ায় জটিলতা আছে। যে কারণে সিনেমার পরিচালক ও প্রযোজক এখন মাল্টিপ্লেক্সের ওপর বেশি নির্ভর হচ্ছেন। গত ৪ মার্চ মোশাররফ করিম ও পরীমনি অভিনীত সিনেমা মুখোশ মুক্তি পেয়েছিল।

সিনেমাটি মাত্র এক সপ্তাহ হলে চলে। পরে প্রায় দুই মাস সিনেপ্লেক্সে চলে। অনুদানের সিনেমাটির পরিচালক ইফতেখার শুভ বলেন, ‘দেশের বড় শহরগুলোতে সিনেপ্লেক্স নির্মাণ করা হলে পরিচালক–প্রযোজকেরাও লগ্নি ফিরিয়ে আনতে আশাবাদী হবে। কারণ, প্রতিনিধি না পাঠিয়েই সিনেপ্লেক্স থেকে ঠিকমতো অর্থ পেয়েছি। হলের তুলনায় সিনেপ্লেক্সে সিনেমা চালাতেও অনেক কম টাকা খরচ হয়। সারা দেশে সিনেপ্লেক্স বানালে সিনেমার ৮০ ভাগের বেশি হলবিমুখ দর্শককে ফেরানো সম্ভব।’
এদিকে সিনেমা ও এর সঙ্গে জড়িত মানুষদের কথা ভেবে সরকারও সিনেপ্লেক্স নির্মাণের জন্য কাজ করছে। সরকার মনে করে, দেশে সিনেপ্লেক্স নির্মিত হলে দেশের অর্থনীতি চাঙা হবে। একই সঙ্গে মানুষের কর্মসংস্থান বাড়বে, বাড়বে সাংস্কৃতিক চর্চাও।