শেষবার বাসায় ফিরে হেসে উঠেছিলেন এ টি এম শামসুজ্জামান

এ টি এম শামসুজ্জামানপ্রথম আলো

গতকাল শুক্রবার হাসপাতাল থেকে বাসায় নেওয়া হয় অভিনেতা এ টি এম শামসুজ্জামানকে। বাসায় ফিরে বেশ সুস্থ বোধ করছিলেন তিনি। তাঁর মেয়ে কোয়েল আহমেদের ভাষায়, ‘সে যেন অন্য এক মানুষ। তাঁকে দেখে বোঝার উপায় ছিল না তিনি অসুস্থ।’ পরিবারের সবাইকে পেয়ে বেশ আনন্দিত ছিলেন প্রবীণ এই অভিনেতা। আনন্দে হাসছিলেন তিনি। আজ সবাইকে ছেড়ে পাড়ি জমালেন পরপারে।  

এ টি এম শামসুজ্জামান মাত্র ২০ বছর বয়সে সহকারী পরিচালক হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করেন। সে হিসাবে চলচ্চিত্রে প্রায় পাঁচ যুগের ক্যারিয়ার তাঁর। অভিনেতা হিসেবে তাঁর পর্দায় আগমন ১৯৬৫ সালে। ১৯৭৬ সালে চলচ্চিত্রকার আমজাদ হোসেনের ‘নয়নমণি’ ছবিতে খলনায়ক হিসেবে অভিনয় করে মানুষের নজর কাড়েন তিনি। তারপর থেকে বাড়তে থাকে তাঁর ব্যস্ততা। ক্রমেই পরিবার থেকে বিচ্ছিন্নপ্রায় হয়ে কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন তিনি। এমনও হয়েছে, বাধ্য হয়ে এ টি এমকে এক দিনে দুই-তিনটি ছবির শুটিং ইউনিটে সময় দিতে হয়েছে। প্রতিদিন সকালে বের হতেন, রাতে বাসায় ফিরতেন। তবে এ নিয়ে পরিবারের কারও মধ্যে কোনো আক্ষেপ ছিল না। পরিবারের সবার প্রিয় ছিলেন তিনি। যত রাতই হোক, এই অভিনেতা শুটিং থেকে ফিরে পরিবারের সবার খোঁজ নিতেন। হয়তো এসব কারণেই জীবনের শেষ দিনগুলো পরিবার ছেড়ে বাইরে যাননি।

(ডান থেকে) ফারুক, এ টি এম শামসুজ্জামান ও গোলাম কুদ্দুছকে একসঙ্গে পেয়ে সেলফি তুলছেন অরুণা বিশ্বাস। ছবি : প্রথম আলো

২০১৯ সালে হঠাৎ করেই অসুস্থ হয়ে পড়েন এ টি এম শামসুজ্জামান। তখনো হাতে ছিল একাধিক ধারাবাহিক ও সিনেমার শুটিং। সব ব্যস্ততা রেখে প্রায় দেড় বছরের টানা চিকিৎসায় তিনি ক্রমেই সুস্থ হয়ে ওঠেন। শেষের দিকে চাইতেন অভিনয়ে ফিরবেন। কিন্তু পরিবার ছেড়ে থাকতে হবে বলে অভিনয়ের প্রতি টান কিছুটা কমে গিয়েছিল। তিনি বরং চাইতেন, পরিবারের মধ্যে থেকেই চিত্রনাট্য লিখবেন। অবশ্য সেটাও আর সেভাবে হয়ে ওঠেনি। দীর্ঘ ক্যারিয়ারে পরিবারের সদস্যরা কখনোই তাঁকে শুটিংয়ে যেতে বারণ করেননি। কিন্তু করোনার মধ্যে সেই পরিবারের মানুষেরাই তাঁকে শুটিংয়ে যেতে নিষেধ করতেন। দেশ-বিদেশে নানা জায়গায় শুটিংয়ে থাকা ব্যস্ত এই অভিনেতার মধ্যে হঠাৎ এল বড় এক পরিবর্তন। বাসা থেকে বের হতে আর ভালো লাগত না তাঁর। পরিবারের সঙ্গে যেন তিনি আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে গিয়েছিলেন। বাড়িতে তাঁর ঘরে সব সময় পরিবারের কাউকে না কাউকে থাকতেই হতো।

গত ২৫ জানুয়ারি প্রয়াত এই অভিনেতার স্ত্রী রুনি জামান ফোনে প্রথম আলোকে জানিয়েছিলেন, এ টি এম শামসুজ্জামান একা থাকতে চান না। পরিবারের কেউ না কেউ পাশে থাকলে তাঁর ভালো লাগে।’ প্রতিবারই পরীক্ষা করাতে হাসপাতালে গেলে ডাক্তারেরা তাঁকে হাসপাতালে ভর্তির পরামর্শ দিতেন। সেসব শুনে এ টি এম বিরক্ত হতেন। হাসপাতাল তাঁর ভালো লাগত না। এ প্রসঙ্গে রুনি জানান, তাঁর চিকিৎসা করানো হতো বাসায়। হাসপাতালে গেলেই চিকিৎসকেরা তাঁকে ভর্তি করে নিতে চাইবেন। এ জন্য তিনি হাসপাতালে যেতেই চাইতেন না।

যে কোনো চরিত্র নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারতেন এ টি এম শামসুজ্জামান। ছবি : সংগৃহীত

গত বুধবার তীব্র শ্বাসকষ্ট নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছিল এ টি এমকে। দুই দিন তাঁর শরীরের সব রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়। চিকিৎসকেরা তাঁর শরীরে তেমন কোনো রোগ খুঁজে পাননি। চিকিৎসকদের বরাতে এই অভিনেতার মেয়ে কোয়েল আহমেদ জানান, ওষুধ খেলেই তাঁর বাবা ভালো হয়ে উঠবেন। কোনো কিছু নিয়ে মান-অভিমান ছিল না তাঁর। কেবল খেতে চাইতেন না। কিন্তু পরিবারের সবাই তাঁকে শিশুর মতো আদর করে খাওয়াতেন। এতে এ টি এম বিরক্ত হতেন। জেদ করতেন, খেতে চাইতেন না। জাউভাত, তরকারি, ভর্তা তাঁর ভালো লাগত না। যদিও অন্য খাবার তাঁর জন্য নিষেধ ছিল। গতকাল ১৯ ফেব্রুয়ারি বেলা চারটার দিকে হাসপাতাল থেকে তাঁকে বাসায় আনা হয়। সে সময় হাসি ছড়িয়ে পড়ে তাঁর মুখে।

বরেণ্য এই অভিনেতার মৃত্যুর গুজব ছড়িয়েছিল বেশ কয়েকবার। এবার আর কোনো গুজব নয়। আজ ২০ ফেব্রুয়ারি শনিবার সকাল ৮টায় নিজ বাসায় শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। প্রথম আলোকে তাঁর মৃত্যুর খবর জানিয়েছেন কোয়েল আহমেদ।

১৯৪১ সালের ১০ সেপ্টেম্বর নোয়াখালীর দৌলতপুরে নানাবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন এ টি এম শামসুজ্জামান। গ্রামের বাড়ি লক্ষ্মীপুর জেলার ভোলাকোটের বড়বাড়ি, আর তিনি ঢাকায় থাকতেন দেবেন্দ্র নাথ দাস লেনে। পড়াশোনা করেছেন ঢাকার পোগোজ স্কুল, কলেজিয়েট স্কুল ও রাজশাহীর লোকনাথ হাইস্কুলে। ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন ময়মনসিংহ সিটি কলেজিয়েট হাইস্কুল থেকে। তারপর জগন্নাথ কলেজে ভর্তি হন।