জুটি থেকে প্রেম? রাজ্জাক, কবরী থেকে শাকিবরা কীভাবে সামলেছেন
ঢালিউড সিনেমার জুটি থেকে প্রেমের গুঞ্জন দীর্ঘদিনের। একসঙ্গে একের পর এক সিনেমা মুক্তি পাওয়ায় এমনও হয়েছে, ভক্তরা একসময় ধরেই নিয়েছেন প্রিয় তারকা প্রেম করছেন বা বিয়ে করেছেন। এসব নিয়ে কখনো তারকাদের বিব্রত হতে হতো, কখনো প্রশ্নের মুখে পড়তে হতো।
বিব্রত হওয়ার একটি গল্প বলা যাক। ৮০’দশকের কথা। শুটিং ইউনিটে নায়ক রাজ্জাক দাঁড়িয়ে আছেন। হঠাৎ হন্তদন্ত হয়ে ছুটে তাঁর সামনে এসে দাঁড়ালেন কবরী। মুখে প্রচণ্ড রাগ। কিন্তু কী কারণে রাগ, সেটা কিছুই বুঝতে পারলেন না রাজ্জাক। সিনেমার চরিত্রের মতোই অভিমান করে রইলেন কবরী।
মুখে কোনো কথা নাই দেখে রাজ্জাক চিরচেনা নায়োকোচিত ভঙ্গিতে জানতে চাইলেন, ‘হয়েছেটা কী?’ কিছুক্ষণ চুপ থেকে কবরী বলেন, ‘কী আর হবে যেখানেই যাই, রাজ্জাক–কবরী হয়ে যাই। ডাকেও আমার নামের আগে আপনার নাম নিয়ে। বলে ওই যে “রাজ্জাক–কবরী যায়”।’ এ কথা শুনে হাসতে হাসতে রাজ্জাক বলেছিলেন, ‘সবাই আপনাকে মিসেস রাজ্জাক বলতে পছন্দ করে।’ এ কথা শুনে আরও রেগে গেলেন কবরী। শুটিংয়ের সূত্রে তারকাদের এমন ভালোবাসা, রাগ, অভিমানের সম্পর্ক থাকলে তাঁদের নিয়ে গুঞ্জন ছড়ানোটাই স্বাভাবিক। সেসব প্রশ্ন সময়ের সঙ্গে কীভাবে সামলান তারকারা?
কবরী নিজেই একটি সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন, একসঙ্গে ‘ময়নামতি’ সিনেমার শুটিং করতে গিয়ে রাজ্জাকের সঙ্গে ভালো বন্ধুত্ব হয়। তাঁদের মধ্যে প্রেম ও বন্ধুত্বের গল্প ভক্তদের কাছে জীবন্ত হয়ে উঠেছিল। দর্শকদের মুখে মুখে থাকত তাঁদের নাম। একটা সময় এমনটাও জানা যায়, বহু দর্শক মনেই করতেন তাঁরা বাস্তবেও জুটি। কিন্তু এ জুটি সম্পর্ক নিয়ে নানা সময় কথা বললেও কোথাও না কোথাও একটা রহস্য জিইয়ে রেখেছেন।
এ সম্পর্কের রহস্য নিয়ে বহুবার গণমাধ্যমের মুখোমুখি হতে হয়েছে কবরীকে। সম্পর্ক ঘিরে প্রশ্নে কবরী এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘আমরা দীর্ঘ সময় একসঙ্গে শুটিং করেছি। একসঙ্গে শুটিংয়ে যেমন ব্যস্ত থাকেছি, তেমনি একের পর এক রোমান্টিক সিনেমায় দর্শক আমাদের দেখেছেন। প্রেমিক জুটি হওয়ার কারণে অনেকেই মনে করেছেন আমাদের ভালোবাসার সম্পর্ক রয়েছে। পর্দায় গল্প উপস্থাপন করতে গিয়ে নিজেদের ভালোবাসার সম্পর্ক গড়ে ওঠা মোটেও অস্বাভাবিক নয়।’ এর মানে কি আপনারা প্রেম করছেন—সেই প্রশ্নে সাক্ষাৎকারে তেমন কোনো কথা বলেননি।
সাংবাদিকদের মুখোমুখি হলেই রাজ্জাকের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে প্রশ্ন শুনতে হয়েছে কবরীকে। উত্তরেও তিনি একই কথা বলতেন, ‘বিষয়টি এমন না যে তাঁর (রাজ্জাক) সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে আমার প্রেম হয়ে গেল, জুটি হয়ে গেল কিংবা বন্ধুত্ব হয়ে গেল। এটা মোটেও তেমন নয়। একসঙ্গে কাজ করতে গেলে একটা বোঝাপড়া তৈরি হয়। সেটাই হয়েছে আমাদের ক্ষেত্রে।’
নির্মাতা সুভাষ দত্তের ‘আবির্ভাব’ সিনেমায় একসঙ্গে প্রথম জুটি হয়ে কাজ করেন রাজ্জাক ও কবরী। সেই জুটিকে দর্শক শুরু থেকে পছন্দ করেন। ১৯৬৮ সালে সিনেমাটি মুক্তির পর দর্শক একের পর এক পর্দায় দেখতে পান রাজ্জাক–কবরীর সিনেমা। এই জুটি নিয়ে কবরীর মতো রাজ্জাকের কাছেও প্রেমের সম্পর্ক নিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্ন থাকত। এমন প্রশ্নে একবার রাজ্জাক উল্টো সাংবাদিকদের কাছে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘আপনাদের মা–খালাদের কাছে প্রশ্ন করেন আমাদের জুটি নিয়ে। দেখবেন কী বলে। তারা ফিসফিস করে বলবে, সে কি প্রেম করেছি আমরা।’
ভক্ত–সহকর্মীদের মধ্যে ছড়ানো এই প্রেমের কথা ভালো করেই জানতেন রাজ্জাক। কারণ, সে সময় এই জুটির মধ্যে মান–অভিমান হলেও সেগুলো গণমাধ্যমে চলে আসত। এগুলোও দর্শকমনে আরও বেশি প্রেমের গুঞ্জন তৈরিতে প্রভাব রেখেছিল। রাজ্জাক তাঁর ৭৬তম জন্মদিনে সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘আসলে আমার আর কবরীর পর্দার প্রেমটাকে দর্শকেরা বাস্তব মনে করতেন। তখন আমাদের ছবি ভক্তদের ঘরে ঘরে থাকত। ভিউকার্ড নিয়ে ঘুরতেন। আমাদের মতো করে সবাই প্রেম করতে কিংবা প্রেম নিবেদন করতে পছন্দ করতেন। এমনও হয়েছে, আমাদের সংলাপও হুবহু ব্যবহার করতেন। এগুলো নিয়ে বেশ মজা হতো।’
তখনো প্রেমের সত্যিকার সম্পর্ক নিয়ে মুখ খোলেননি তিনি। ‘কিন্তু মন থেকে কি কোনো টান ছিল কবরীর প্রতি?’ সেই প্রশ্ন করে বসেন এক সাংবাদিক। জন্মদিনে এসব নিয়ে খোলামেলা কথা বলেন এই তারকা।
নায়ক রাজ্জাকের সেই কথা সে সময় হুবহু প্রকাশ করেছিল অনলাইন গণমাধ্যম জাগো নিউজ। সেদিন এই নায়ক বলেছিলেন, ‘আসলে কী বলব, প্রেম তো ছিলই। এই প্রেমের কোনো সংজ্ঞা নেই। তবে এই প্রেম উপভোগ করতাম। দুজন একসঙ্গে হলে কেমন একটা পরিবর্তন বোধ করতাম। খুব সহজেই মিশে যেতে পেরেছিলাম আমরা। শুটিং স্পটে স্বামী-স্ত্রীর মতোই থাকতাম। কত মুখরোচক গল্প ছড়িয়েছে আমাদের দুজনকে নিয়ে। কত পত্রিকায় কত গল্প-উপন্যাস! মাঝে মাঝে মন খারাপ করতাম। কবরীও অনেক আপসেট হয়ে যেত। কিন্তু জহির রায়হান সাহেবের একটা কথা আমি সব সময় মনে রেখেছি। সেটি হলো, যত দিন তোমাকে নিয়ে কাগজে গালগল্প লেখা আসবে, তত দিন তুমি সুপারস্টার। যেদিন আর কেউ তোমাকে নিয়ে কৌতূহলী হবে না, সেদিন তুমি কেউ নয়। তাঁর এ কথাটা ভেবে আমি আর মন খারাপ করিনি কখনো।’
চলতি শতকের শুরু থেকে একটু একটু করে ঢালিউডে নিজের জায়গা করে নিচ্ছিলেন শাকিব খান। ‘চাচ্চু’, ‘কোটি টাকার কাবিন’সহ একাধিক সিনেমা তুমুল ব্যবসা সফল হয়। তারপর টানা পর্দায় শাকিবের জুটি ছিলেন অপু বিশ্বাস। একসঙ্গে তাঁদের নিয়মিত সিনেমা পর্দায় দেখে গুঞ্জন তৈরি হয়। এ নিয়ে শাকিবকে নানা রকম প্রশ্নের মুখে পড়া স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। সে সময় এটাও চাউর হয়, শাকিব ও অপু বিশ্বাস বিয়ে করেছেন।
একবার হঠাৎ করেই অপু বিশ্বাসের সঙ্গে শাকিবের তুমুল মনোমালিন্যের খবর প্রকাশ্যে আসে। বিষয়টা এমন হয়ে দাঁড়িয়েছিল যে তাঁরা একসঙ্গে আর ছবি করছেন না। মুখ দেখাও নাকি বন্ধ। সেটা নিয়ে একের পর এক খবর হতে থাকে। তাঁর মধ্যেই শাকিব ভক্তদের খবর দেন, তাঁরা ভুল–বোঝাবুঝি মিটিয়ে ‘মনেপ্রাণে আছো তুমি’ নামে একটি সিনেমায় চুক্তি হয়েছেন। তখন নতুন করে প্রেমের গুঞ্জন তৈরি হয়।
সে সময় একটি গণমাধ্যমের প্রশ্নের মুখোমুখি হন শাকিব।
তাঁকে প্রশ্নে করা হয়, ‘অনেকে মন্তব্য করছেন আপনি এখন বড় প্রেমিক। চলচ্চিত্রে প্রায় সব নায়িকার সঙ্গেই সম্পর্ক গড়ছেন, তা আবার ভাঙছেন?’ এমন প্রশ্নের উত্তরে শাকিব বলেন, ‘কাজ করতে গেলে সবার সঙ্গেই আমার ভালো সম্পর্ক হয়। কিন্তু কেউ যখন মনের ভুলে বলে, “তুমি দেখতে খুব সুন্দর, তোমার সঙ্গে কথা আছে, রাতে ফোন খোলা রেখো”, তখন তাকে আমি বলি, আজ রাতে আমিই যে একজনকে ফোন করব। তবে এই একজন যে কে তা আমি নিজেই জানি না। সে শুধু আমার কল্পনায় থাকে।’
তবে যা রটে কিছু তো বটে। শাকিব খানের ক্ষেত্রে কথাটা যে সত্যি, সেটা এর মধ্যেই জেনে গেছেন পাঠকেরা। কারণ, তাঁর পর্দার দুই জুটি অপু বিশ্বাস ও শবনম বুবলীর সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন ঢাকাই সিনেমার এই নায়ক।