‘বাড়ির নাম শাহানা’, নারীর ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প

‘বাড়ির নাম শাহানা’ সিনেমায় দীপা চরিত্রে অভিনয় করেছেন আনান সিদ্দিকাছবি : প্রযোজনা সংস্থার সৌজন্যে

সত্য ঘটনা অবলম্বনে নির্মিত পরিচালক লিসা গাজীর প্রথম চলচ্চিত্র ‘বাড়ির নাম শাহানা’ নামের সিনেমাটি ইতিমধ্যে শিকাগো, মেলবোর্ন, লন্ডন, রোম ও মুম্বাই শহরে প্রদর্শনীর পর বেশ আলোচনায় এসেছে। নব্বই দশকের এক নারীর বিবাহবিচ্ছেদকে কেন্দ্র করে পারিবারিক-সামাজিক নিষ্ঠুরতা, সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়ার মানসিকতা, সামাজিক অসংগতি ও সর্বোপরি দৃঢ়চিত্তে একদম ঘুরে দাঁড়ানোর কাহিনিকে উপজীব্য করে নির্মিত এই সিনেমা।
ফ্ল্যাশব্যাক কৌশলের মাধ্যমে অতীতে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোকে গল্প বলার মতো করে যেভাবে ক্যামেরায় ফুটিয়ে তোলা হয়েছে, সেটা সত্যি চমৎকার। অনেক সময় আর্ট ফিল্ম ও ধীরগতির চলচ্চিত্রে দর্শকের পুরো সিনেমা দেখার আকুলতা আর আকাঙ্ক্ষা অনেক ক্ষেত্রে কমে গেলেও এই সিনেমায় তেমনটা ঘটেনি। তবে নিশ্চিতভাবেই বলা যায় যে ‘বাড়ির নাম শাহানা’ চলচ্চিত্রে পর্দার পুরো সময়টাতে দর্শকদের মধ্যে কোনো রকম বিরক্ত বোধ তো হয়নি, বরং পরের দৃশ্যে কী হবে, সেটা দেখার আগ্রহ বেড়েছে। তা ছাড়া সিনেমার ভাষা ও শব্দ চয়ন, অন্তর্দৃষ্টিমূলক খোঁচামারা কথা, ব্যাঙ্গাত্মক, তীক্ষ্ণ কথোপকথন ব্যতিক্রমধর্মী ছিল, যা দীর্ঘদিন পর সিনেমায় দেখা গেল।

‘বাড়ির নাম শাহানা’ সিনেমাটির স্ক্রিপ্টিংয়ের মুন্সিয়ানা, কাহিনি, দৃশ্যায়নের ধারাবাহিকতা ও সাবলিল উপস্থাপনা দর্শকদের মানসপটে সত্যি দাগ কেটেছে বলেই মনে হয়। এ সিনেমার কেন্দ্রীয় চরিত্র দীপার তালাকের ঘটনা নিয়ে নির্মিত এই চলচ্চিত্রে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, নব্বইয়ের সমকালীন সমাজচিত্র, নারীর ওপর পুরুষতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়ার মানসিকতা, নারীর দ্বিতীয় বিয়ে, মধ্যবিত্তের টানাপোড়েন, সামাজিক নিষ্ঠুরতা, কুসংস্কার, মুক্তমনা নারীর প্রতিকূল পরিবেশে লড়াই, বংশীয় দাম্ভিকতাসহ সমকালীন অনেক কিছুই উঠে এসেছে।

‘বাড়ির নাম শাহানা’ সিনেমাটির স্ক্রিপ্টিংয়ের মুন্সিয়ানা, কাহিনি, দৃশ্যায়নের ধারাবাহিকতা ও সাবলিল উপস্থাপনা দর্শকদের মানসপটে সত্যি দাগ কেটেছে বলেই মনে হয়।
‘বাড়ির নাম শাহানা’ সিনেমার দৃশ্য। ছবি : প্রযোজনা সংস্থার সৌজন্যে

গল্প বা কাহিনিনির্ভর সিনেমা হিসেবে ‘বাড়ির নাম শাহানা’ একটি ব্যাতিক্রমী সিনেমা, যেখানে চরিত্রের চেয়েও গল্প বেশি প্রাধান্য পেয়েছে। এদিকে বর্তমানে নায়ক বা প্রেমনির্ভর বড় বাজেটের বাণিজ্যিক সিনেমা যেভাবে মার-মার, মার-কাট দেখানো হয়ে থাকে, এই সিনেমাতে তেমন কিছু না থাকলেও এই সিনেমার সবচেয়ে বড় দিক হলো গল্প বলার ধারাবাহিকতা। আকস্মিক কোনো ক্লাইমেক্স না থাকলেও এই সিনেমার মধ্যে একটি আবেদন সব সময়ই চলমান ছিল। স্বল্প বাজেটের এ চলচ্চিত্রটির কাহিনি, কলাকুশলীদের অভিনয় দক্ষতা ও দৃশ্যায়ন আমাদের মনস্তত্ত্বে এমনভাবে আঘাত হেনেছে যে ৩০ বছর আগের কাহিনি একদম জীবন্ত বলেই মনে হয়েছে। তবে দীপার প্রথম পালিয়ে বিয়ে করার গল্প বা কেন সেই বিয়েটি টিকেনি, সেটার বিষয়ে সুস্পষ্ট কোনো ইঙ্গিত এই সিনেমায় ছিল না। তা ছাড়া আমাদের জীবনের অনেক অপ্রকাশিত অসম প্রেম, যার কোনো পূর্ণতা নেই, তবুও সেই প্রেম সব সম্পর্ক থেকে আলাদা; এমন একটি প্লেটোনিক ভালোবাসা খুঁজে পাওয়া যায় দুই ধর্মে বিশ্বাসী দীপা আর সুকুমারের রসায়নে। তবে ভালোবাসার কাঙাল হিসেবে প্রেমহীন দীপাকে একাই কী চলতে হবে, বাকিটা জীবন, এমন প্রশ্নের উত্তর না দিয়েই শেষ হলো দীপা আর সুকুমারের সুপ্ত প্রেমের গল্প, যার কোনো পরিণতি এই সিনেমায় দেখানো হয়নি।

আরও পড়ুন
গল্প বা কাহিনিনির্ভর সিনেমা হিসেবে ‘বাড়ির নাম শাহানা’ একটি ব্যাতিক্রমী সিনেমা, যেখানে চরিত্রের চেয়েও গল্প বেশি প্রাধান্য পেয়েছে। এদিকে বর্তমানে নায়ক বা প্রেমনির্ভর বড় বাজেটের বাণিজ্যিক সিনেমা যেভাবে মার-মার, মার-কাট দেখানো হয়ে থাকে, এই সিনেমাতে তেমন কিছু না থাকলেও এই সিনেমার সবচেয়ে বড় দিক হলো গল্প বলার ধারাবাহিকতা।

এদিকে ‘বাড়ির নাম শাহানা’ সিনেমাতে আয়না, টিকটিকি, মাছ কাটার ও মাছ ভাজার দৃশ্য, মার্বেল ইত্যাদি প্রতীক (সিম্বলিজম) ব্যবহার করা হয়েছে, যা এই সিনেমার কাহিনিকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে। তা ছাড়া এই সিনেমার অনেক কথোপকথনে ছিল তীক্ষ্ণ ভাবাবেগ আর ছিল সরব ও নীরব প্রতিবাদ। আর এই প্রতিবাদী স্বভাবই দীপাকে ভেতর থেকে শক্তিশালী করে তুলতে সাহায্য করেছে এবং তাঁর ব্যক্তিস্বাধীনতার চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে গেছে। প্রতিকূল পরিবেশে থেকেও দীপা কিন্তু এমবিবিএস ও বিসিএসে পাস করে নিজে স্বাবলম্বী ও আত্মপ্রত্যয়ী হয়ে পরি নামের একটি বাচ্চা মেয়েকে দত্তকও নিয়েছে। তা ছাড়া ‘আমি অনুমতি নিতে আসি নাই, জানাইতে এসেছি…’, ‘…তালাক কী আমার শরীরে লেখা...?’ কথাগুলোর মাঝে সমকালীন সরব প্রতিবাদের মূর্ত প্রতীক হিসেবেই দীপাকে দেখা যায়।

সিনেমার অনেক কথোপকথনে ছিল তীক্ষ্ণ ভাবাবেগ আর ছিল সরব ও নীরব প্রতিবাদ। আর এই প্রতিবাদী স্বভাবই দীপাকে ভেতর থেকে শক্তিশালী করে তুলতে সাহায্য করেছে এবং তাঁর ব্যক্তিস্বাধীনতার চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে গেছে।

এ ছাড়া চমৎকার চমৎকার বেশ কয়েকটি গান আর গানের দৃশ্যায়ন এই সিনেমাকে একটি বিশেষ মাত্রা দিয়েছে। প্রায় সব গানের কথা, সুর আর ঢঙ রীতিমতো ছিল হৃদয় ছোঁয়ানো, যা নিশ্চিত আমাদের মননকে ভীষণভাবে তাড়িত করে। তা ছাড়া ‘চতুর্দিকে পানি’, ‘জলের পদ্ম জলেই আঁকা’ গানগুলোসহ অন্যান্য সব গানে মানুষের আবেগ, ভালোবাসা, যন্ত্রণার গল্প, নস্টালজিয়া, সংগ্রাম, একাকীত্ব, ব্যক্তিগত যাত্রা এবং সামাজিক বাস্তবতার প্রতিফলন ফুটিয়ে উঠেছে। এ সিনেমার প্রতিটি গানের সঙ্গে দৃশ্যায়ন ও লোকেশনের চমৎকার সামঞ্জস্যতা ছিল, যা সিনেমাকে ভিন্ন মাত্র এনে দিয়েছে।
তা ছাড়া সিনেমার দৃশ্যায়নের সঙ্গে লোকেশনে, পোশাক-পরিচ্ছদ, চমৎকার গান, নেপথ্য সংগীতসহ সবকিছুর মধ্যে ছিল অপূর্ব সামঞ্জস্য। বর্তমানে ধুমধারাক্কা সিনেমাতে প্রচুর পরিমাণে বিভিন্ন দেশের সিনেমার নকল দৃশ্যের সমাহার দেখা যায়।

প্রায় সব গানের কথা, সুর আর ঢঙ রীতিমতো ছিল হৃদয় ছোঁয়ানো, যা নিশ্চিত আমাদের মননকে ভীষণভাবে তাড়িত করে। তা ছাড়া ‘চতুর্দিকে পানি’, ‘জলের পদ্ম জলেই আঁকা’ গানগুলোসহ অন্যান্য সব গানে মানুষের আবেগ, ভালোবাসা, যন্ত্রণার গল্প, নস্টালজিয়া, সংগ্রাম, একাকীত্ব, ব্যক্তিগত যাত্রা এবং সামাজিক বাস্তবতার প্রতিফলন ফুটিয়ে উঠেছে।
‘বাড়ির নাম শাহানা’ সিনেমার দৃশ্য। ছবি : প্রযোজনা সংস্থার সৌজন্যে

তা ছাড়া সিনেমার প্রতিটি দৃশ্যেই এমন খোলামেলা অশ্লীল বাক্যে ভরপুর থাকে, যা পরিবার নিয়ে দেখা যায় না, যেটা আমাদের ছবিতে একদমই ছিল না। এই সিনেমায় প্রধান চরিত্র আনান সিদ্দিকা, লুৎফর রহমান জর্জ, ইরেশ যাকের, কাজী রুমা, কামরুন্নাহার মুন্নীসহ কলাকুশলীর অধিকাংশই চমৎকার অভিনয় করেছেন। তবে বড় পর্দায় নবাগত হিসেবে আনান সিদ্দিকা নান্দনিক অভিনয় কৌশল, সরল চাহনি, সহজ বাচনভঙ্গী দিয়ে ইতিমধ্যে দর্শকদের মনে বিশেষ একটা জায়গা করে নিয়েছেন।
বিশ্ব সাহিত্য ও চলচ্চিত্রে অন্যতম সংগ্রামী নারীকেন্দ্রিক সিনেমাগুলোর মধ্যে ম্যাক্সিম গোর্কির ‘মাদার’, ‘মাদার ইন্ডিয়া’ (১৯৫৭), ‘সারেং বউ’ (১৯৭৮), ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’ (১৯৭৮), ‘গেরিলা’ (২০১০), ‘ন ডরাই’ (২০১৯), ‘রেহানা মরিয়ম নূর’ (২০২১) নামক চলচ্চিত্রে তালিকায় ‘বাড়ির নাম শাহানা’ নিশ্চিতভাবেই জায়গা করে নিয়েছে। উল্লেখিত প্রতিটি চলচ্চিত্রে সংগ্রামী নারী চরিত্র সব পারিবারিক ও সামাজিক প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লড়াই করে এগিয়ে যাওয়া বিষয়টি উঠে এসেছে। তবে এখানে বলে রাখা দরকার যে ওপরে বর্ণিত চলচ্চিত্রগুলোর পরিচালক সবাই পুরুষ হলেও ‘বাড়ির নাম শাহানা’ সিনেমার চিত্রনাট্যকার ও পরিচালক দুজনই নারী, যার ফলে খুব দরদ দিয়ে নারীর ভাবাবেগকে ক্যামেরার মাধ্যমে সিনেমায় ফুটিয়ে তুলতে পেরেছেন।

এদিকে বাস্তবভিত্তিক ও গল্পনির্ভর চলচ্চিত্র নির্মাণে নবাগত হিসেবে লিসা গাজী যে সুনিপুণ পারদর্শিতা, দক্ষতা আর মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন, সেটা অনেক সিনেমা পরিচালকদের জন্য একটি অনুকরণ হতে পারে।
আরও পড়ুন

এদিকে বাস্তবভিত্তিক ও গল্পনির্ভর চলচ্চিত্র নির্মাণে নবাগত হিসেবে লিসা গাজী যে সুনিপুণ পারদর্শিতা, দক্ষতা আর মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন, সেটা অনেক সিনেমা পরিচালকদের জন্য একটি অনুকরণ হতে পারে। নব্বই দশকের তালাকপ্রাপ্ত অধিকাংশ নারীরা সমাজের নোংরা অপবাদের বলি হয়ে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের অতলান্তিতে হারিয়ে যেত বা আত্মহত্যার পথ বেছে নিত। কিন্তু ‘বাড়ির নাম শাহানা’ সিনেমার দীপা কিন্তু একাই সংগ্রাম করে নিজের কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে পৌঁছেছেন।

লেখক: উপসচিব, কৃষি মন্ত্রণালয়