ফাঁকা ঘরে পড়ে আছে অক্সিজেন সিলিন্ডার, এই বুঝি ডাকবেন স্মৃতি...

দুজন ছিলেন দুজনার পৃথিবী। বিভিন্ন সময় তাঁদের কথাবার্তায়ও তেমনটা উঠে আসত। নানা-নাতনির এই পৃথিবীতে ছিল শুধু ভালোবাসা, মায়া, বন্ধন ও দায়িত্ব। অল্প বয়সে মা-বাবাহারা যে নাতনিকে লালন–পালন করেছেন নানা শামসুল হক গাজী, জীবনের একটা সময়ে শতবর্ষী সেই নানুর অবলম্বন হয়ে ওঠেন যেন নাতনি পরীমনি।

নানা শামসুল হক গাজীর সঙ্গে পরীমনি। এই ছবি এখন স্মৃতি
ছবি: সংগৃহীত

চলচ্চিত্রের আলোচিত এই নায়িকার পরিচিতি বাড়ার সঙ্গে তাঁদের নানা-নাতনির সম্পর্কও প্রকাশ্যে আসে। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নানুর হাত ধরে আসতেন পরীমনি, অনুষ্ঠান শেষে হাত ধরাধরি করে চলেও যেতেন। নানু তাঁর সেই অবলম্বনের বন্ধন ছিন্ন করে অন্য পৃথিবীতে পাড়ি জমিয়েছেন, যেখান থেকে ফেরার সুযোগ নেই। নানাবিহীন পরীমনি যেন অন্য একজন, বদলে যাওয়া মানুষ। গতকাল শুক্রবার দুপুরে পরীমনির বাসায় গিয়ে তেমনটাই দেখা গেল। এ কথা, সে কথা, নানান কথায় উঠে আসেন তাঁর সদ্য প্রয়াত নানু।

আরও পড়ুন

অভিনয়ের টানে পিরোজপুরের মেয়ে পরীমনির ঢাকায় আসা। এই রাজধানীর যেখানে তিনি ছিলেন, সেখানেই ছায়া-মায়ানির্ভরতা এবং সর্বোপরি অভিভাবক হয়ে পরীমনির পাশে ছিলেন তাঁর নানা শামসুল হক গাজী। এর আগে লম্বা সময় ধরে বনানীতে থাকলেও গত এক বছরের বেশি সময় ধরে পরীমনি বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার একটি বাড়িতে বসবাস শুরু করেন। বিয়ে করে একসময় সংসারী হওয়া পরীমনি তাঁর নানুভাইকে নিজের কাছ থেকে দূরে রাখেননি। কয়েক মাস ধরে অবশ্য একমাত্র সন্তান রাজ্য ও নানুভাইকে নিয়ে সাজিয়েছিলেন পরীমনি তাঁর পৃথিবী।

নানা শামসুল হক গাজীর সঙ্গে চিত্রনায়িকা পরীমনি
ছবি : ফেসবুক

বসুন্ধরার আবাসিক এলাকার বাড়িটিতে নানা-নাতনি দুজনের ঘরটা ছিল পাশাপাশি। নানুর থাকার সেই ঘরটা এখন ফাঁকা। খাটটা দেখিয়ে পরীমনি বললেন, এটাতেই ঘুমাতেন নানুভাই। শেষ দিকে শ্বাসকষ্টে ভোগা নানুর ব্যবহৃত অক্সিজেন সিলিন্ডারটা পড়ে আছে দরজার পেছনে। পরীমনি ওটা দেখিয়ে বললেন, ‘নানুর সবকিছু যেভাবে ছিল, ওভাবেই রয়ে গেছে। এই যে সিলিন্ডার, এটা নানুর ব্যবহারের ছিল। সিলিন্ডারের দিকে তাকালে বুকের মধ্যে কেমন জানি করে। মোচড় দিয়ে ওঠে। ঘরটার দিকে কিছুতেই তাকাতে পারি না। যেদিকে তাকাই, মনে হয়, নানুভাই যেন পায়চারি করেন। কাপড়চোপড়ও পড়ে আছে। এই বুঝি ডাকবেন, স্মৃতি (শামুসন্নাহার স্মৃতি, পরীমনির আসল নাম) বলে। কী করিস নানুভাই?’

আরও পড়ুন

আড্ডা দেওয়াটা পরীমনি খুব পছন্দ করতেন। আত্মীয়স্বজন যখই বাসায় আসতেন, আড্ডা, হাসি-মজা—সবই চলত। সেই সময়ের স্মৃতি মনে করে পরীমনি বললেন, ‘আমরা যখন ঘরে বসে আড্ডা দিচ্ছি বা জোরে হাসাহাসি করতাম, দৌড় দিয়ে নানুভাই আসতেন। জানতে চাইতেন, এত হাসাহাসির কারণ কী। কী বলছিস তোরা, বল। ঘরের কোনায় কোনায়, দেয়ালে দেয়ালে নানুভাই রয়েছেন।’

নানা শামসুল হক গাজীর সঙ্গে চিত্রনায়িকা পরীমনি
ছবি : ফেসবুক

বার্ধক্যজনিত অসুস্থতায় ভুগে গত ২৪ নভেম্বর মারা যান পরীমনির নানা শামসুল হক গাজী। দিনটির কথা মনে করে পরীমনি বললেন, ‘আমার জীবন থেকে ২৪ তারিখটা হারাইয়ে গেল। এই দিনটা আমার কষ্টের দিন হয়ে থাকবে। আমি এদিনটায় ঢাকায় থাকতে পারব না। ছুটে যাব নানুভাইয়ের কাছে। কয়েকটা দিন থেকে আবার ঢাকায় ফিরব।’ পরীমনির মায়েরা তিন বোন। এর মধ্যে তাঁর মা ও আরেক খালা মারা গেছেন। একজন বেঁচে আছেন। তাঁকে পরীমনি মা বলে ডাকেন। সেই মা বললেন, ‘আব্বা মারা যাওয়ার আগে স্মৃতিকে বলে গেছেন, সবাইকে তুমি দেখে রেখো। তুমিই সবার অভিভাবক।’

আরও পড়ুন

গতকাল পরীমনি তাঁর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার বাসায় নানুর জন্য দোয়া ও মিলাদ অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। এতিম বাচ্চাদের খাওয়াদাওয়া করান। অন্য খাবারের পাশাপাশি তাঁর নানুভাইয়ের খুব পছন্দের পায়েস রান্না করেছেন। আত্মীয়–পরিজন ও সবাইকে নিজে বেড়ে খাইয়েছেন।

সন্তান রাজ্যর ১১ মাস পূর্তিতে পরীমনি ও তাঁর নানা শামসুল হক
ছবি : পরীমনির ফেসবুক

পরীমনির জীবনে অনেক ওঠানামা। তাঁর জীবন ঘিরেও রহস্যের শেষ নেই যেন। তাঁর হেন বিষয় নেই, যা নিয়ে মানুষের কৌতূহল নেই। অবশ্য তাঁকে নিয়ে মানুষের ভাবনার ব্যাপারে মোটেও চিন্তিত নন পরী। খেয়ালখুশিমতো চলাতেই যেন তাঁর আনন্দ। শুধু একটি জায়গায় পরীমনিকে থমকে যেতে দেখা যেত। শতবর্ষী সেই মানুষকে নিয়েই ছিল তাঁর যত উৎকণ্ঠা। নিজের কঠিনতম সমস্যায় যে বিন্দু পরিমাণ ভেঙে পড়তেন না, সেই পরীমনি শুধু এই মানুষটার হাসপাতালে ভর্তির খবরে ভেঙে পড়েছিলেন। কয়েক দফা হাসপাতালে যাওয়া-আসায় ঘাবড়ে যান। তিনি অবসরপ্রাপ্ত স্কুলশিক্ষক নানা শামসুল হক গাজী, বিনোদন অঙ্গনের সবাই যাঁকে পরীমনির নানা হিসেবেই চিনে থাকেন।

রাজ্যকে নিয়ে পরীমনি
প্রথম আলো

পরীমনির নানা শামসুল হক গাজী পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ার মানুষ। মঠবাড়িয়ার ভগীরথপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের স্কুলশিক্ষক এই মানুষটি এলাকার সবার কাছে সমাজসেবক হিসেবে পরিচিত। বেশ কয়েক বছর আগে অবসর নিলেও স্কুলের যেকোনো প্রয়োজনে পরীমনির নানাকে ঠিকই পাওয়া যেত। তাঁর স্ত্রী, অর্থাৎ পরীমনির নানি শেফালি হাওলাদার এক যুগ আগে মারা যান। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রয়াত প্রধান শিক্ষক নানির পাশেই সমাহিত করা হয়েছে নানাকেও।

আরও পড়ুন

মাত্র তিন বছর বয়সে মা হারানোর পর পিরোজপুরে নানা শামসুল হক গাজীর কাছেই বেড়ে ওঠেন পরীমনি। নানার তত্ত্বাবধানে থেকেই তিনি এসএসসি ও এইচএসসি পাস করেছিলেন। মা-বাবার স্নেহ পরীমনি তাঁর নানার কাছেই পেয়েছেন। সম্পর্কে নানা হলেও তাঁকে বাবাও বলতেন পরীমনি। বিভিন্ন সময় আলাপে এমনটা বলেছিলেনও।

২০১৭ সালের ১৮ জুন বাবা দিবসে পরীমনি ফেসবুকে একটি পোস্ট দিয়েছিলেন। ওই পোস্টে তিনি লেখেন, শামসুল হক গাজী তাঁকে জন্ম দেননি, তবে তিনিই তাঁর বাবা।

পরীমনি
ছবি : শিল্পীর সৌজন্যে

সেদিন পরীমনি এ-ও লিখেছিলেন, ‘আজ সত্যি যদি বলি, আমার বাবা হলেন আমার নানুভাই শামসুল হক গাজী। ওহ, একটা মজার বিষয় বলি, অনেকের আমার নাম নিয়ে কৌতূহল দেখেছি। আসল নাম, ডাকনাম, কে রেখেছে ইত্যাদি ইত্যাদি...আমার সার্টিফিকেট নাম শামসুন্নাহার স্মৃতি। শামসুন মানে সূর্যের আলো। নানুভাইয়ের নামের সঙ্গে মিল করে এই নাম।’